দলীয় পরিচয়, দলীয় প্রতীক ও দলীয় নেতাকর্মীদের শ্রমের মধ্য দিয়েই সাংসদ নির্বাচিত হন। পরে সাংসদ থেকে কেউ মন্ত্রী, কেউ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি, কেউ স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার হয়ে থাকেন। স্পিকার থেকে রাষ্ট্রপতিও হয়ে থাকেন। রাজনৈতিক পদমর্যাদার এই স্তরগুলোতে পৌঁছার তাদের মূল শেকড় দল। দলীয় নেতাকর্মীদের দলগত আবেগই ধাপে ধাপে তাদের রাজনৈতিক পরিপুষ্টতা অর্জনে নির্যাসের ভূমিকা রাখে।
কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাওয়ার পরে আর অনেকেরই শেকড় নিয়ে ভাবার ও এতে অধিকতর রস সঞ্চারের আগ্রহ থাকে না।আত্মীয়-স্বজন প্রীতি মগ্ন হয়ে তখন আর দলকে নিয়ে কেউ ভাবে না। দল ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন এপিএসরা। অথচ এই এপিএস নিয়োগে দলীয় নেতাকর্মীদের মতামতের কোনো বিষয় থাকে না।
মন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সাংসদেরা নিজ নিজ ইচ্ছায় ও নিজেদের সুবিধামত এপিএস নিয়োগ দেন। এমনও দেখা যায় তারা যে এলাকার ভোটে ও দলীয় নেতাকর্মীদের প্রচারণায় নির্বাচিত হয়েছেন এপিএস সে এলাকার কেউ নন। এমন কি তার দলেরও কেউ নন। অথচ দলীয় নেতাকর্মীদের বাধ্য হয়ে তখন এই এপিএসের পিছেই দৌড়াতে হয়। চাকরি, দলীয় নমিনেশন, স্কুল কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য পদ প্রাপ্তি, নদী-খাল-বিল ইজারা, টেন্ডার, টিআর, কাবিখা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী সবই এপিএসের মাধ্যমেই হয়। দলের দুর্দিনের কাণ্ডারিদেরও অসহায়ের মতো এপিএসের তোয়াজ করতে হয় তাদের নানা নাগরিক ন্যায্য অধিকার অর্জনে।
ক্ষমতার বাইরে থাকার সময়ে নির্যাতিত নেতাকর্মীদের খুব কম সংখ্যককেই এপিএস হতে দেখা যায়। এপিএস হয় রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সাংসদের নিকটাত্মীয় ও ঘনিষ্ট জন। যাদের আবির্ভাব অনেকটা মৌসুমী পাখির মতো। মুদী দোকানদার,বখাটে, বেসরকারী কোম্পানিতে চাকরি করা ব্যক্তি এপিএস হয়ে রাতারাতি বনে যায় বাড়িগাড়ির মালিক। তাদের আয়ের উৎস থাকে অজানা। সকল দুর্নীতি, অনিয়ম ও আর্থিক কেলেংকারিতে জড়িত থাকেন এই এপিএসরা আর ক্ষমতার পট পরিবর্তনে জেলে যান মন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সাংসদেরা। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে তারা এপিএসদের দিয়ে অপকর্ম করিয়েও থাকেন। আবার অনেকেই মন্ত্রী ও সাংসদদের অজ্ঞাতে রেখে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেরা ফুলে ফেঁপে ওঠেন।
এপিএসরা গোটাকয়েক সুবিধাভোগী নিয়ে গড়ে তুলেন সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের দ্বারাই পরিচালিত হয় খাল, বিল, নদী ইজারা, ডিও লেটার, সুপারিশ বাণিজ্য, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য সহ ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিবিধ সুবিধা লুণ্ঠন প্রক্রিয়া। এপিএসদের কার্যক্রমে জনপ্রতিনিধিদের প্রতি তৃণমূলে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। তারা জনগণের মাঝে হন বিতর্কিত। তাদের কারণে মন্ত্রীত্ব হারানোর ঘটনাও ঘটে। ঘটে ক্ষমতা হারিয়ে বিরোধী শিবিরে যাওয়ার সময় কারান্তরীণ হওয়ার ঘটনা। কিন্তু এপিএসরা রয় বহাল তবিয়তে। তারা ভোল পাল্টে মিশে যায় নতুন ক্ষমতাসীন দলের সাথে। এরকম নজির ভুরিভুরি। বাংলাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক আবহটা এরকম যে দল এপিএসদের চালাতে পারেনা এপিএসরাই দলকে চালাতে পারে।
‘মৌসুমী পাখিদের ঠাঁই নেই’ – এরকম কথা কেবলই ফাঁকা বুলি। সাংসদের এপিএসরা এলাকায় গেলে স্থানীয় ওসি, ইউএনওদের তাদের তোয়াজ করতে দেখা যায়। এরকম তোয়াজ সরকার দলের সেই নেতাদের ললাটে জুটে না যারা দল করতে গিয়ে দুর্দিনে নির্যাতিত হয়েছে কিংবা স্বজন হারিয়েছে। দলীয় মতের ভিত্তিতে এপিএস নিয়োগ না হওয়ায় দল হয় উপেক্ষিত। এপিএসের অনুমতি ছাড়া দলীয় নেতারা সাংসদের সাথে দেখা করার সুযোগই পায় না এরকমই নজরদারী ও নিয়ন্ত্রণ তাদের সাংসদ ও মন্ত্রীদের উপরে থাকে। মন্ত্রী,সাংসদরাও কেন জানি তাদের এই নজরদারী ও নিয়ন্ত্রণকে সুমিষ্ট প্রলেপ হিসেবেই মেনে নেন। ক্ষমতা হারানোর কালে এই সুমিষ্ট প্রলেপ রূপ নেয় তিক্ত ব্যথাময় ঘা’য়ে।
এপিএস নিয়োগে দলীয় মতের ভূমিকা থাকলে কি দলীয়করণ বাড়বে? দলীয় মতামতের বাইরে মন্ত্রী, সাংসদদের একক সিদ্ধান্তে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ায় কি তা কমছে? প্রতিটা নিয়োগেরই একটা নীতিমালা থাকে। এপিএস নিয়োগে হয়তো নেই? দলীয় ভিত্তিতে না হলে সেটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমেও তো হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সিটি করপোরেশন কার্যালয়, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রের কার্যালয় প্রভৃতিতে কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগে যদি সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রদান করা যেতে পারে মন্ত্রী, সাংসদের এই কর্মকর্তা নিয়োগে কেন নয়?
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিবিহীন নিয়োগপ্রাপ্ত এপিএসদের নিয়োগ প্রক্রিয়া কি চুক্তিভিত্তিক? তাদের নিয়োগপত্রে কে স্বাক্ষর করেন? তাদের বেতন কাঠামো কী? বেতন ভাতা কি সরকারি খাত থেকে আসে নাকি মন্ত্রী সাংসদদের ব্যক্তিগত খাত থেকে? এই প্রশ্নগুলোর সুস্পষ্ট কোনো উত্তর মানুষের কাছে নেই। দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ যদি দলীয়করণ দোষে দোষী হয়, ব্যক্তি পছন্দে নিয়োগ কেন ব্যক্তিতান্ত্রিকতা দোষে দোষী হবে না? একজন মন্ত্রীর কতজন এপিএস থাকে, একজন সংসদীয় কমিটির সভাপতির কতজন এপিএস থাকে, একজন সাংসদের কতজন এপিএস থাকে। তাদের দায়িত্ব কর্তব্য কী – এগুলোরও পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। থাকা উচিত নয় কি?
সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেও পিএস, এপিএস নিয়োগ হয়ে থাকে। তারা হয়তো সরকারের দিক দেখবে। রাজনৈতিক দলীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্তরা তদ্রূপ দলীয় দিক দেখবে। সরকার ও দলের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলার জন্যই হয়তো দুই স্তর থেকে এপিএস নিয়োগ হয়ে থাকে। এছাড়াও রয়েছে সাংবাদিকদের মধ্য থেকে প্রেস সচিব নিয়োগ। রাজনৈতিক এপিএস নিয়োগ রাজনৈতিক যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন করা বাঞ্ছনীয় নয় কি? অরাজনৈতিক মৌসুমী পাখিদের কেন এ পদে নিয়োগ দেয়া? বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণে এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হলে সময়ের সঠিক রাস্তা আবিষ্কার হতো। অপসৃত হতো অস্পষ্টতার ভুল পথে ছুটে চলার বিভ্রান্ত পদযাত্রা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)