চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

দলীয় গঠনতন্ত্র চর্চার জোরালো তৎপরতা চাই

জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে এক সংগঠনের দুই কমিটি, দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে একাধিক দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ওঠা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় রাজনৈতিক দলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আলবদর রাজাকার ও তাদের সন্তানদের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে যাওয়া প্রভৃতি গঠনতান্ত্রিক দুর্বলতা কিংবা দলীয় নেতাকর্মীদের গঠনতন্ত্র উপেক্ষারই ফল।

চলমান ইউপি নির্বাচনে খোদ আওয়ামী লীগেই রাজাকারের সন্তানদের দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তির ঘটনা ঘটছে। এগুলো গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হলেও তা নিরসনে দলীয় কোন তৎপরতা পরিলক্ষিত ক্ষীত হচ্ছে না।

যে কোন রাজনৈতিক দল পরিচালনার মেইন সুইচ হচ্ছে তার গঠনতন্ত্র। গঠনতন্ত্রই পারে বিপথগামী হওয়া দল ও দলীয় নেতাদের সুপথগামী করতে। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ রাজনৈতিক দলে স্বাধীনতা বিরোধী ব্যক্তি ও তার অনুগত প্রজন্মের দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তির ঘটনায় এটাই প্রমাণ হয় যে দলের ভিতরে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি মজবুত নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েই ক্রিয়াশীল রয়েছে। নইলে রাজাকার, আলবদর ও তাদের সন্তানরা আওয়ামী লীগ দলে দলীয় মনোনয়ন পেলো কী করে। একজন মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে সেটা কি বেমানান নয়?

এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশে সকল ধরনের বেমানানই বুঝি এখন মানান হয়ে উঠছে। মুক্তিযোদ্ধা জিয়া রাজাকার,আলবদরদের ধরে ধরে এনে মন্ত্রী বানালেন। তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এতদিন পরে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তুললেন।কেন তুললেন এতে তার কী রাজনৈতিক ফায়দা হল তাও জনতার খোলাচোখে বোধগম্য নয়।

স্ববিরোধিতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও গঠনতন্ত্র মান্যতা রেখে না চলা যেন দলগুলোর রেওয়াজ হয়ে গেছে। সাপ নেউলের বিরোধিতায় নেমেছে বিবদমান দল, উপদলের বিরোধ। আওয়ামী লীগের উপদলবাজ নেতারা জামাত বিএনপিকে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভাবেনা প্রতিপক্ষ ভাবে নিজ দলীয় তার বিরোধী উপদলকে।

বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় না। নিজ নিজ উপদলীয় প্রভাব বাড়াতেই ব্যস্ত থাকে নেতারা। গঠনতন্ত্রের পাতা উল্টিয়েও দেখেনা তারা। দেশের রাজনীতি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, নেত্রীর প্রাণ নাশের হুমকি এসব নিয়ে তাদের সিরিয়াস কোন ভাবনা নেই। দলীয় পরিচয়ে প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানো ও নিজের আখের গুছাতে উপদলীয় চর দখলেই লিপ্ত থাকছে তারা। জামাত বিএনপির নেতাদের সাথে মিশে চলতে পারে তারা, নিজের দলের সাথে নয়। তারা উপদলীয় সভা করতে আগ্রহী দলীয় সভা করতে নয়।

এসব উপদল গুলোর মধ্যে প্রভাবের দিক থেকে সংসদ সদস্য সমর্থিত অংশেরই প্রভাব বেশি। থানা ও প্রশাসনে এই উপদলের ব্যাপক প্রভাব। ফুলের তোড়া দিয়ে উপদলীয় যোগদানের ঘটনা ঘটার পরেও দলীয় নীতি নির্ধারক মহলের কোন ভূমিকা নিতে না পারা কি চরম ব্যর্থতা নয়? দলকে গঠন তন্ত্র শাসিত না করতে পারলে গঠন তন্ত্র রেখে লাভ কি? জোর যার মুল্লুক তার এই নীতিতে তারা যে যার মতো চলতে থাকুক। দলকে ব্যবহার করে সংসদ সদস্য হয়ে দলীয় গঠনতন্ত্রকেই তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। দলকে ব্যবহার করে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়ে দলীয় গঠনতন্ত্রে আনুগত্য রাখার কোন প্রয়োজনবোধ করেনা। উপদলীয় অপচর্চায় হিংসা,দ্বেষ,সংঘাত,সহিংসতা ক্রমশ বেড়েই চলছে।

দলের ভেতরে উপদলীয় অস্তিত্ব থাকার পরিণতি ভয়াবহ হয়। অতীতেও হয়েছে,বর্তমানেও হচ্ছে ভবিষ্যতেও হবে এটাই সত্য বাস্তবতা। বঙ্গবন্ধুর লাশ সিঁড়িতে পড়ে রইল আর উপদলীয় মোশতাক গং মন্ত্রীসভায় গর্বিত অবয়বে বসে গেল। মোশতাক মন্ত্রীসভার সদস্যদের দলে না ভেড়ালে উপদলীয় সংঘাত হ্রাস পেত। তখন কেউ মন্ত্রী হতে না চাইলে মোশতাক একা কিছুই করতে পারতোনা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে তাদের সঙ্গে কোন বোঝাপড়া ছিল না এটা সত্য হতে পারে না। মীর জাফর বেঈমানি না করলে সিরাজ উদ্দৌল্লাহর পতন হত না এটা যেমন সত্য মোশতাক মন্ত্রীসভায় কারও শপথ নেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে বঙ্গবন্ধুর এই পরিণতি হতনা এটাও তেমনই সত্য।

যুগে যুগে এটা প্রমাণিত সত্য যে অন্তর্দ্বন্দ্বই ভয়াবহ দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বেই অনেক প্রবল প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পতন হয়েছে। কোন রাজনৈতিক দলের গঠন তন্ত্রই উপদলীয় চক্রান্ত সমর্থন করতে পারে না।আর সমর্থন করাটা আত্মহননের সমতুল্য। আওয়ামী লীগসহ কিছু দল সেই কাজটিই করে চলেছে। এর পরিণতি অশুভ হতে বাধ্য।

আজকের বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের এক নম্বর কাজ প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল দমন নয়, নিজ উপদলীয় সংঘাত দমন ও সংগঠনগত ঐক্যের শক্তিভিতকে মজবুত করন। সেটি তারা যত দ্রুত সারতে পারবে ততই মঙ্গল। আওয়ামী লীগের সর্বরোগ নাশি দাওয়াই হলো দলকে দ্রুত গঠনতন্ত্র শাসিত করা। আলবদর, রাজাকারদের ব্যাপারে প্রতিটা দলীয় গঠনতন্ত্রেই স্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা দরকার। তাদের দলীয় সদস্য পদ ও নেতৃত্ব গ্রহনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট গঠনতান্ত্রিক ব্যাখ্যা চাই।

এই ব্যাখ্যার মধ্য দিয়েই কোন রাজনৈতিক দলটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও কোনটি বিপক্ষে তা জনসাধারণের মাঝে প্রকাশ্য হবে। রাজাকার ও তাদের পুত্রকন্যাদের গঠনতান্ত্রিক ধারা বলেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এনিয়ে রাজপথ গরম করা, আন্দোলন, মিছিল মিটিংয়ের কোন প্রয়োজন নেই।

প্রতিটা রাজনৈতিক দলের মেইন সুইচ হচ্ছে তার গঠনতন্ত্র। দেশব্যাপী সর্বস্তরের নেতাকর্মিদের মাঝে এই গঠন তন্ত্রটি অধ্যয়ন ও চর্চার আগ্রহ জাগাতে হবে। প্রতি জেলা, উপজেলায় গঠনতন্ত্র প্রচার সেল গঠন ও তার কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। উপদল চর্চা বাদ দিয়ে গঠনতন্ত্র চর্চায় মন দিলেই অনেক সমস্যা দূরীভূত হবে।কথা উঠছে চক্রান্তকারীরা অত্যন্ত কৌশলে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নিকট হতে তার কাছের লোকদের দূরে সরিয়ে যুগেযুগে চক্রান্তবাজ ও চাটুকারদের যে এরকম অপতৎপরতা চলমান থাকে এটা প্রমাণিত সত্য।

কথা উঠছে এই অপতৎপরতার ফলাফল যে কোন সময় ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতে পারে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের বক্তব্য উড়িয়ে দিলে তা চরম বোকামি হবে। দল রক্ষা ও দলের ভিত মজবুতকরণে দলকে গঠনতন্ত্র শাসিত করার বিকল্প নেই।

বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষনে প্রয়োজনে গঠনতন্ত্র সংশোধন, পরিমার্জন, সংযোজন বিয়োজনও দরকার। গঠন তন্ত্রের কঠোর অনুশীলনই পারে রাজনৈতিক দলগুলোকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে নিতে।

সুতরাং গঠনতন্ত্রকে মূল ধরে আমাদের রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে হবে। এমনটি হলেই সুস্থধারার রাজনীতি এগুবে আর অসুস্থ ধারাটি পিছাবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)