অমর একুশে বইমেলা-২০২০’এ পাঞ্জেরী থেকে প্রকাশিত হয়েছে মোজাফ্ফর হোসেন-এর ‘দক্ষিণ এশিয়ার ডায়াসপোরা সাহিত্য’ বইটি। নন্দিত হওয়া গ্রন্থটি নিয়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখেছেন কবির মুকুল প্রদীপ।
মোজাফ্ফর হোসেন প্রণীত ‘দক্ষিণ এশিয়ার ডায়াসপোরা সাহিত্য’ শীর্ষক বইটি মাত্রই পাঠ শেষ করলাম। ইতোপূর্বে ডায়াসপোরা সাহিত্য সম্পর্কে আমার বিশেষ কোনো ধারণা ছিল না। বইটি পড়ার পর আমার ডায়াসপোরা সত্তাটিকে নতুনভাবে উপলব্ধি করেছি। এতদিন আমার ভেতরে যে অস্তিত্ব সংকট ছিল, তার একটা ব্যাখ্যাও খুঁজে পেলাম। আমার যখন বারো বছর বয়স, পরিবারের সঙ্গে ভারতে চলে যেতে হয়। এই যাওয়ায় আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। অথচ সেই বয়সে আমার মতামতের গুরুত্ব দেয়ার মতো কেউ ছিল না। অগত্যা মেনে নিতে হয়েছে। বহু কেঁদেছি। এক টুকরো শৈশবের স্মৃতি আঁকড়ে নতুন সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছি। এই মানিয়ে নিয়ে বাঁচা, নতুনভাবে পরিচয় বিনির্মাণ করা যে কতটা কঠিন সেটা বোধকরি ডায়াসপোরা ছাড়া অন্যকারো পক্ষে বোঝা সম্ভব না, কিংবা বোঝানো!
এইসব নানাবিধ সংকট এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত সাহিত্যকেই বলে ডায়াসপোরা সাহিত্য, যেটা এই বইয়ে বিভিন্ন পর্বে ভাগ করে আলোচনা করেছেন মোজাফ্ফর। তিনি ডায়াসপোরা শব্দটির ঐতিহাসিক ভিত্তি এবং বর্তমানে এই শব্দটি ব্যবহারের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বলেছেন, “ডায়াসপোরা’’ শব্দটি গ্রিক। ‘dia’ মানে দূরে, ‘speirein’ অর্থ ছড়িয়ে পড়া।
ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ফসলের বীজ ছড়িয়ে পড়া হলেও শব্দটির অন্য ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ শতাব্দীর দিকে। ইসরাইল থেকে নির্বাসিত ইহুদিদের প্রথম ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ঐ সময় আলেক্সান্দ্রিয়ার পণ্ডিতরা হিব্রু বাইবেল বা ‘তোরাহ’র প্রথম পাঁচটি বই গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করেন। এই অনুবাদে গৃহহীন ইহুদিদের জন্য ক্রিয়াপদ ‘diaspeirein’ এবং বিশেষ্যপদ ‘diaspora’-এর ব্যবহার করা হয়। এই ডায়াসপোরা শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ ‘অভিবাসী’ কিংবা ‘প্রবাসী’ নয় কেনো, তার একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, “আমরা লক্ষ্য করব, ‘ডায়াসপোরা’ এবং ‘অভিবাসী’ শব্দটি অর্থগতভাবে কাছাকাছি হলেও এদের মধ্যে ধারণাগত পার্থক্য আছে।”
এরপরেই লেখক উপনিবেশ-পূর্ব ডায়াসপোরা, ঔপনিবেশিক অথবা মধ্যযুগীয় ডায়াসপোরা এবং উপনিবেশ-উত্তর বা আধুনিক ডায়াসপোরা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই আলোচনায় গোটা বিশ্বের ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠী ও ব্যক্তি, কেনো-কীভাবে তারা ডায়াসপোরা, এসবের খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন। আমরা জানি বর্তমানে বহু মানুষ জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে নিজ ‘জন্মভূমি’ ছেড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থায়ী-অস্থায়ীভাবে বাস করছে, জাতিসংঘের শুমারি অনুযায়ী যার সংখ্যা প্রায় ষাট কোটির উপরে। বিভিন্ন দেশে থেকে এই মাতৃভূমি-চ্যুত জনগোষ্ঠী বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় যে সাহিত্য রচনা করেন তার বিশ্লেষণ করতে আজ ডায়াসপোরা সাহিত্যতত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভারতীয় ডায়াসপোরা তাত্ত্বিক সুদেশ মিশ্র ডায়াসপোরা তত্ত্বকে তাত্ত্বিকভাবে দুটো ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা, সুগার ডায়াসপোরা এবং মসালা ডায়াসপোরা। কিন্তু ব্যাপারটা এতো সরলরৈখিক কিছু নয়। একটু খোলসা করে বলি- আমার স্মৃতিতে কৈশোরপূর্ব বাংলাদেশ আছে, কিন্তু আমার ছোট ভাই-বোন বাংলাদেশে জন্মেছে অথচ খুব ছোট থাকার কারণে বাংলাদেশ নিয়ে ওদের কোনো নস্টালজিক স্মৃতি নেই।
ফলত জন্মভূমি সম্পর্কে আমাদের ভাই-বোনদের ভেতরেই রয়েছে বৈচিত্র্যময় অনুভূতি। যেমন- ভারতীয় বংশোদ্ভূত ত্রিনিদাদবাসী নোবেনজয়ী লেখক ভিএস নাইপল। তার জন্ম ত্রিনিদাদে, কিন্তু পিতার ভারতে। আবার কেউ কেউ আছেন অভিবাসী কিংবা প্রবাসী, উন্নত জীবনের জন্য বিদেশে গিয়ে সেই দেশের নাগরিক হয়েছেন অথবা হননি। কেউ কেউ আছেন নির্বাসিত। যেমন- তসলিমা নাসরিন, সালমান রুশদী প্রমুখ। এইসব বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন কোনো লেখক তার দেখা কিংবা না দেখা ‘মাতৃভূমি’ নিয়ে সাহিত্য রচনা করেন তখন যেমন নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়, তেমনই কিছু সংকটও উঠে আসে। যেটা হয়েছে সালমান রুশদীর ভারতের ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস ‘মিডনাইট চিলড্রেন’ নিয়ে। ভারতীয় পাঠক এক্ষেত্রে লেখকের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন ইতিহাস বিকৃতির। যেমনটা হয়েছে বাংলাদেশি ডায়াসপোরা লেখক তাহমিমা আনামের ‘গার্মেন্টস’ গল্পের ক্ষেত্রেও। ডায়াসপোরা সাহিত্যের এমন অনেক দিক, প্রশ্ন ও সম্ভাবনার খুঁটিনাটি নিয়ে রচিত হয়েছে আলোচ্য বইটি। এমনকি তত্ত্ব পর্বে তিনি এই কথাটাও উল্লেখ করেছেন যে, ডায়াসপোরা লেখকদের সকল লেখাই ডায়াসপোরা সাহিত্য নয়, কেননা ডায়াসপোরা সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেই সাহিত্যকে যেখানে ডায়াসপোরা জীবনের সংকটগুলো তুলনামূলকভাবে স্থান পেয়েছে। আর এমনটাও তো নয় যে, সকল ডায়াসপোরা লেখক কেবল ডায়াসপোরা সংকট নিয়েই সাহিত্য রচনা করবেন!
একটি অংশে লেখক এতদিনের অনালোচিত বাংলাদেশি ডায়াসপোরা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই পর্বে লেখক প্রথমে দেশভাগোত্তর ডায়াসপোরা সাহিত্য, বাংলাদেশি বিহারি ঊর্দুভাষী ডায়াসপোরা এবং রোহিঙ্গা ডায়াসপোরা সম্পর্কে নানা অজানা সংকট ও সম্ভাবনার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। দেশভাগের ফলে ভিটেচ্যুত হয়েছেন কোটি কোটি মানুষ, ভারতে থেকে যেমন তৎকালীন পাকিস্তানে চলে গেছে বহু মুসলিম, তেমনই বহু হিন্দু চলে গেছেন ভারতে। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের ভেতরেই বহু মানুষ ডায়াসপোরা সংকটে ভুগছেন, এমনকি দুই বাংলায় এই নিয়ে সাহিত্য রচনা হয়েছে অনেক। লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী, এই অঞ্চলের এই অভ্যন্তরীণ ডায়াসপোরা নিয়ে বৈশ্বিক পর্যায়ে কোনো উল্লেখযোগ্য আলোচনা হয়নি। তেমনই অনালোচিত রয়েছে বাংলাদেশি বিহারি ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠী দ্বারা লিখিত ঊর্দু-সাহিত্য।
লেখকের ভাষায় বৃহত্তর ভারত ভাগ হয়ে যখন পাকিস্তান নামক আর একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয় তখন ভারতের বিহার প্রদেশ থেকে এই ঊর্দুভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠী অবিভক্ত পাকিস্তানে আসে। পরবর্তী সময়ে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে পাকিস্তান ভাগ হয়ে যখন জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ, তখন এই জনগোষ্ঠী পাকিস্তানে যেতে চাইলেও পাকিস্তান তাদের গ্রহণ করেনি। আবার এই জনগোষ্ঠীও মনেপ্রাণে বাংলাদেশি পরিচয়কে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলত এই বিহারি বাংলাদেশি জনগোষ্ঠী দ্বারা রচিত ঊর্দু-সাহিত্য বাংলাদেশের মূলধারার সাহিত্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু কীভাবে এই ঊর্দু-সাহিত্য বাংলাদেশে একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে জায়গা করে নিতে পারে, সেটা নিয়ে লেখকের মৌলিক আলোচনা প্রশংসনীয়।
শুধু তাই নয়, বর্তমানে আরাকান থেকে নির্বাসিত হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের লিখিত সাহিত্য প্রাধান্য পেয়েছে এই বইয়ে। আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশি ডায়াসপোরা লেখক যারা বিদেশে থেকে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা করছেন তাদের সংকট ও সম্ভাবনার বিষয়টি। উঠে এসেছে পাকিস্তানি ডায়াসপোরা সাহিত্য থেকে শুরু করে ভারতীয় বহু ডায়াসপোরা লেখকদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও তাদের সাহিত্যকর্মের পাঠ। সাক্ষাৎকার পর্বে ডায়াসপোরা লেখকদের সাথে মোজাফ্ফরের আলোচনায় আলোচিত হয়েছে ডায়াসপোরিক অভিজ্ঞতার কথা। এই পর্বটি পাঠকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। সঙ্গে লেখকের অনুবাদে পাঁচ ডায়াসপোরা লেখকের আড্ডা পাঠকদের বিষয়টির আরও গভীরে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে।
কথাসাহিত্যিক-অনুবাদক-প্রাবন্ধিক মোজাফ্ফর হোসেনের সরল এবং সাবলীল গদ্যশৈলী ইতোমধ্যে এপার-ওপারের বাঙালি পাঠকমহলে আলোচিত। একাডেমিক জটিলতা এড়িয়ে তিনি তত্ত্বের মতো ভারি বিষয়কে খুবই সরল এবং মনোগ্রাহী করে উপস্থাপন করেন, যা পাঠক নন্দিত। ‘দক্ষিণ এশিয়ার ডায়াসপোরা সাহিত্য’ও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এই বইটা পড়তে পড়তে আমার একটা অপেক্ষা ছিল, শেষতক সেটা আর পূরণ হয়নি! ডায়াসপোরা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হবে কিন্তু তসলিমা নাসরিনের মতো আলোচিত লেখক আসবেন না, এটা কী হয়! দুঃখের বিষয়, মাঝে মাঝে তিনি উঁকি দিয়েছেন বটে, তবে বিস্তারিতভাবে আসেনি। কেনো লেখক তসলিমাকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেননি সেটা আমার প্রশ্ন নয়। শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই, তসলিমার লেখা ‘ফেরা’ উপন্যাসটি বাংলা ভাষায় লিখিত ডায়াসপোরা সাহিত্যের উৎকৃষ্ট নমুনা।
যাইহোক, এ বছরের অমর একুশে বইমেলায় গ্রন্থটি অনুসন্ধিৎসু পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বলে আমি অবগত হয়েছি। যা লেখকের পরিশ্রমের পিঠে যথার্থ। বইটি প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশনস। প্রচ্ছদ ধ্রুব এষ। মূল্য রাখা হয়েছে ৩২০টাকা।