সংযমের মাস রমজান। তবে এ মাসে বাংলাদেশের অনেক মানুষ রোজার শিষ্টাচার বজায় রাখতে পারে না। সেহেরি আর ইফতার আয়োজন হয় রোজার মুখ্য বিষয়। রোজা শেষে ঈদের জন্য নতুন কাপড় কেনাকাটার প্রতিযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয় প্রতিবছর। এরপর আপনজনদের সাথে ঈদ করার উদ্দেশে গ্রামে যায় মানুষ। এটাই স্বাভাবিক চিত্র ছিল ঈদুল ফিতরকে ঘিরে সব সময়।
তবে এবারের ঈদুল ফিতর অন্যসব বছরের মত নয়। গত মার্চ মাস থেকে কোভিড- ১৯ এর কারণে দেশের জনজীবন থমকে গেছে। আক্রান্তের হার ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ক্রমাগত বাড়ছে মৃত্যুর হার। সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে দেশকে মহামারী কবল থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। তবে এ রোগ থেকে পরিত্রাণ পাবার পথ এখনো খুঁজে পায়নি সারা বিশ্ব। শুধুমাত্র সচেতন থেকে ঘরে থাকায়ই এর একমাত্র নিয়ামক।
পরিতাপের বিষয় হলো, অদেখা এ ভাইরাসকে নিয়ে বসবাস করার জন্য যেন প্রস্তুত এখন মানুষ। নিত্য দিনের আক্রান্ত বা মৃত্যুকে স্বাভাবিক মনে করছে। তাই নিয়মের তোয়াক্কা না করে চলছে নিজের খুশিমত। আবেগ বিবেক সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কেন মানুষ মরছে তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা পর্যন্ত করছে না।
আর সে কারণে বুঝতে চাইছে না ঈদ উৎসব পালনের নামে কোন ভয়ানক পরিস্থিতি ডেকে আনছে জীবনে। ঈদের কারণে বাড়ি যেতেই হবে এটা কী ধরনের প্রয়োজন তা সত্যি বোধগম্য নয়। যেখানে অন্যান্য মুসলিম দেশ ঈদের আয়োজন থেকে বিরত আছে। সেখানে বাংলাদেশে ঈদ আয়োজনের কমতি নেই। মার্কেটে মানুষের ভিড়। সড়ক ও নৌ পথে বাড়ি ফেরা মানুষের চিত্র দেখে বিস্মিত হতে হয়। কোভিড-১৯ কে ঠেকাতে সরকারী সিদ্ধান্ত সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হচ্ছে। এতে করে জনগণ ও স্বচ্ছভাবে বুঝতে পারছে না আসলে এ মহামারী কোন দিকে যাচ্ছে।
ঈদে মানুষের বাড়ি ফেরা নিয়ে সীমিত সময়ে বেশ কিছু নির্দেশনা আসে৷ একবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরভাবে শহরে প্রবেশ বা বাইরে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে। আবার বলা হয় মুভমেন্ট পাস দিয়ে চলাচল করতে পারবে। সর্বশেষে বলা হল, ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে চলাচল করা যাবে।
বাংলাদেশের কতজন মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে তার হিসাব সরকারের কাছে আছে। সাধারণত ঈদ উৎসবে গণপরিবহনের ভিড় এড়াতে সার্মথ্যবান মানুষরা নিজের গাড়ি না থাকলেও গাড়ি ভাড়া করে গ্রামে যায়। তখনও রাস্তায় পুলিশের চেকিং এড়াতে ভাড়া গাড়িকে নিজের গাড়ি বলে পরিচয় দেয়। আর এ করোনাকালের সঠিক তথ্য দিয়ে গাড়ি ব্যবহার করবে তা প্রত্যাশা করা হাস্যকর হবে। বরং এ নির্দেশনায় ভাড়া করা গাড়িতে ৩/৪ জন মিলে ভাড়া শেয়ার করে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ করে দিল সরকার। আর সে সাথে অসচেতন মানুষ নিজেও বুঝবে না করোনা ভাইরাস কিভাবে সে বহন করছে মানুষ থেকে। কারণ উৎসর্গবিহীন রোগী যে আছে তা বারবার গণমাধ্যমে বলছে। এছাড়া রেন্টাল কারে পরিস্কার পরিছন্নতার নিশ্চয়তা নেই। সব কিছু বিবেচনা করে এ মুহুর্তে মধ্যবিত্ত জীবনে বড় আপসোস একটা গাড়ির জন্য।
অন্যদিকে সরকারের এ নির্দেশনাতে প্রমাণ হলো শ্রেণি বৈষম্যতা। অর্থবান ব্যক্তিদের জন্য সব সময় সুবিধা থাকে। ঈদ-পার্বণ তাদের জন্য। গণপরিবহনের চলা নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য যত নিয়মের আদেশ। তাদের পক্ষে গাড়ি নিয়ে বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়৷
সরকার পরিচালনাকারীদের চিন্তা ভাবনাতে জনগণের ভালো থাকাটা বিবেচ্য তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে মানুষের চলাচল কতটা নিরাপদ তার ব্যখ্যা অস্পষ্ট। বরং এভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে গিয়ে নিজে এবং অন্যকে বিপদে ফেলার আশংকা সৃষ্টি হচ্ছে। একই সাথে ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধা পুলিশ বাহিনী এসব গাড়ি ও মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।
সরকারি ছুটি বা লকডাউন কোনটাই এখন সীমিত আকারে নেই। চিকিৎসার অব্যবস্থাপনার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা হাসপাতালে যেতে ভয় পায়। এমনকি অনেকে রোগের তথ্য গোপন করে স্বাভাবিকভাবে লাশ দাফন করছে বা ঘরে থাকছে। জীবন্ত মানুষ রোগের বাহক। অথচ মরা লাশকে নিয়ে সৃষ্টি হয় ভোগান্তির। আবার মৃত ব্যক্তির পরিবার নিজেদের তাগিদে করোনা ভাইরাসের টেস্ট করে না।
সার্বিক অবস্থায় একটা বিষয় পরিস্কার, সচেতন বা অসচেতন সবাই এখন অকাতরে। নিয়তির বিধানে মৃত্যু যদি কোভিড-১৯ এর কারণে হয় তাই মেনে নিতে বাধ্য। কারণ সিদ্ধান্ত আর অব্যবস্থাপনার তথৈবচতে দ্বিধাগ্রস্থ দেশের মানুষ। তাদের কাছে জীবন নিয়ে নিজস্ব গাড়ি না থাকার মতই আফসোস ‘আহারে জীবন’।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)