সময়ের আলোচিত ছবি ‘ফাগুন হাওয়ায়’। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবিটি নির্মাণ করেছেন তৌকীর আহমেদ। ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পর ছবিটি এখন চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন শহরে। তৃতীয় সপ্তাহে দেশের বেশ কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে চলছে ছবিটি। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ নিয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন নাট্য নির্দেশক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ আলী হায়দার। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ দেখে সোশ্যাল মিডিয়া দেয়া তার প্রতিক্রিয়াটি অনুমতি সাপেক্ষে চ্যানেল আই অনলাইন পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
সিনেমার পরিচালক তৌকীর আহমেদ নিজেকে নিজে অতিক্রম করে চলেছেন দিনকে দিন। ছবি নির্মাণের এই ধারাবাহিকতা এবং ভালো ছবি নির্মাণের এই যাত্রা বাংলাদেশে খুব কম দেখা যায়। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ সিনেমায় পরিচালক দেখিয়েছেন ১৯৫২ সালের বাংলাদেশ, দেশের ভাষা সংস্কৃতি, উদযাপন আয়োজন সব। পিরিয়ড ফিল্ম আমাদের দেশে নির্মাণ এখন দুস্কর, বাজেটের কারণে, কুশিলব-টেকনিকেল- পারিপার্শ্বিক প্রস্তুতির অভাবের কারণে। কিন্তু ‘ফাগুন হাওয়ায়’ তার ব্যতিক্রম। আমাদের চোখের সামনে মূর্ত হয় ৫২ সালের বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশ আমাদের স্বপ্নের, ভালবাসার, উদ্দিপনার, উন্মাদনার। বর্তমান বাংলাদেশকে কীভাবে সেই সময়ে নিয়ে গেলেন পরিচালক, সেটা আমার কাছে এক বিস্ময়। তৌকীর আহমেদ আরও চোখ খুলে দিয়েছেন আমাদের, যে একটি ছোট গল্প কীভাবে ফিল্মের বর্তমান প্লট সঙ্কটের কালে সহায়ক হবে নতুন চিত্রনাট্য নির্মাণে। আমাদের এই ছোট গল্পের সম্ভার মনে হয় আমরা ব্যবহার শুরু করতে পারি ফিল্মে অনেক বেশি। যদিও গল্পটি ৫২ সালের কিন্তু সিনেমাটি দেখার সময় বার বার মনে হয়েছে, কী মিল, কী মিল বর্তমান বাস্তবতায় রাজনীতি-সমাজনীতির সাথে। চমৎকার এক হিস্টোরিক্যাল রিপ্রেজেন্টেশন বা রিএনেক্টমেন্ট। এই সিনেমার নির্দেশক থিয়েটারের একজন সজ্জন অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক- ডিজাইনার বলেই মনে হয় এই রকম হিস্টোরিক্যাল রিপ্রেজেন্টেশন বা রিএনেক্টমেন্ট করা সম্ভব হয়েছে। কারণ থিয়েটারই সবসময় সময়ের কথা বলে, দূরবর্তী জীবনের কথা বলে, প্রতিবাদের ভাষা চালু থাকে সেখানে সবস্তরে। এই সিনেমাটির সব কিছু দারতিরচিত্রনাট্য, সংলাপ, অভিনয়, চরিত্র নির্মাণ, শিল্প নির্দেশন, সেট, পোশাক, ফটোগ্রাফি, লেন্সিং, মিউজিক, লাইট, সব।
আমাদের একজন সিয়াম এর মত অভিনেতা আছে ফিল্মে, এটা ভাবতেই আমার খুব ভাল লাগছে। সিয়াম এই সময়ের তরুণদের মাঝে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ। কী দারুণ চরিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি। বাহ। স্যালুট। অনেক চেনাজানা অভিনেতারা কী সুন্দর চরিত্র নির্মাণ করেছেন, তাতে আমরা মুগ্ধ। যদিও কয়েকটি প্রধান চরিত্রের আরও হোম ওয়ার্ক দাবী রাখে। তিশা আগের ছবি ‘হালদাা’য় যতটা উজ্জ্বল ছিলেন, এই সিনেমায় ততটাই ম্রিয়মাণ। ভাষা, অভিব্যক্তি প্রকাশে কেমন যেন বর্তমান সময়কে অতিক্রম করতে পারেন নি। ফিরে যেতে পারেননি, ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল এ পড়া তৃতীয় বর্ষের একজন ছাত্রীতে। ফজলুর রহমান বাবু সব সময়ের মত আমাদের হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, ভাবিয়েছেন, ভাসিয়েছেন। তাঁর মেয়ের চরিত্রের নবাগত কথা না বলে কত কিছু বললেন। এই অভিনেত্রীকে আরও সিনেমায় দেখতে চাই। অভিনেতা রওনকও ম্লান ছিলেন সময়টাকে ধরতে, এই সুভিনেতার কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশী। সাজু খাদেমকে আমরা ভিন্নরুপে দেখলাম এই ছবিতে। সেতু, পঙ্কজ, নয়ন সহ পুলিশদল ও বন্ধুদল অনেক ভাল মনোযোগ দিয়েছে তাঁদের চরিত্রে এবং সবাই সময়টাকে ধরেছে বেশ তাঁদের চলন-বলনে-অভিব্যক্তিতে। আবুল হায়াত, শহিদুল আলম সাচ্চু ও নিয়াজ তারিখ তাঁদের চরিত্র নির্মাণে শতভাগ সফল। এঁদের ছাড়া এই চরিত্রগুলো কোনভাবেই মানাত না, এটা আমার ব্যক্তিগত মত। তবে যশরাজ পাল এর অভিনয় আমাদের অনেকদিন মনে থাকবে।
‘ফাগুন হাওয়ায়’ সিনেমাটিকে এক কথায় বলতে পারি আমাদের গর্বের ছবি। আমদের ভাষা আন্দোলন নিয়ে এত ঝরঝরে ছবি কোনদিন হবে আমি কল্পনাও করিনি। আমাদের বাংলাদেশ কী অপরূপ ছিল সেই কালে। আমাদের নদী, গ্রাম, মানুষজন, আমাদের দৈনন্দিন যাপন- কী এক মায়ায় আমাদের ডুবিয়ে দিল ‘ফাগুন হাওয়ায়’।
সবার অবশ্য দেখা কর্তব্য ‘ফাগুন হাওয়ায়’। বৃহস্পতিবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ইলেকশনের দিনে বিকাল ৫ টার প্রায় হাউজফুল শো দেখে আমি যারপরনাই আনন্দিত। সবাই হলে গিয়ে ছবিটি দেখুন। অনেক অনেক ভাল লাগবে, আমি শতভাগ নিশ্চিত। তৌকির আহমেদসহ এই ছবির সবাইকে টুপি খোলা অভিনন্দন।