চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো।
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো।।
পাগল হাওয়া বুঝতে নারে ডাক পড়েছে কোথায় তারে–
ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো।।
নীল গগনের ললাটখানি চন্দনে আজ মাখা,
বাণীবনের হংসমিথুন মেলেছে আজ পাখা।
পারিজাতের কেশর নিয়ে ধরায়, শশী, ছড়াও কী এ।
ইন্দ্রপুরীর কোন্ রমণী বাসরপ্রদীপ জ্বালো।।
হায়! এ শহরে এখন চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস আর উছলে পড়া আলো দেখার সুযোগ দিনে দিনে সীমিত হয়ে পড়ছে। প্রতি মুহূর্তে ইট-বালু-সিমেন্ট-লোহার আস্তরণ দিয়ে যেভাবে কংক্রিটের সৌধ গড়ে ওঠছে, তাতে হারিয়ে যাচ্ছে নিসর্গ, হারিয়ে যাচ্ছে নীল আকাশ, হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের সারল্য। সেই সঙ্গে কৃত্রিম আলোর বন্যায় ম্লান হয়ে যাচ্ছে জোছনার রুপালি আলো। কখন জোছনা আসে, কখন জোছনা চলে যায়, অধিকাংশ নাগরিকই সেটা অনুধাবন করতে পারেন না। পারেন না বলেই জীবন ক্রমশ নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ ও জটিল হয়ে যাচ্ছে। তার প্রভাব পড়েছে সামাজিক জীবনেও। এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে একদমই যায় না। তবুও কেউ কেউ এখনও জোছনা ভালোবাসেন। স্নান করেন জোছনায়। ভেসে যান জোছনায়। সুবীর সেনের মতো উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন, ‘নয় থাকলে আরও কিছুক্ষণ/নয় রাখলে হাতে দুটি হাত/নয় ডাকলে আরো কিছু কাছে/দেখো জোছনা ভেজা এই রাত’।
বেইলি রোডে চ্যানেল আইয়ের অফিসের পরিসর হয়তো ছোট ছিল। কিন্তু চারপাশে ছিল আলোর ঝলকানি। গ্ল্যামার ছিল। সৌন্দর্য ছিল। (ছিল বলা ঠিক হচ্ছে না। এখনও আছে।) আছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের সুরেলা কিচিরমিচির। কাছাকাছি আছে রমনা পার্কের সবুজাভ। আছে নাট্যমঞ্চ, মন্ত্রিপাড়া, অফিসার্স ক্লাব। আছে অাভিজাত্যের ছোঁয়া। মুখরোচক খাবার আর জমজমাট আড্ডায় সারাক্ষণ সরগরম তো হয়ে আছেই। আছে কত রকম রসনার হাতছানি। রোজার দিনে রকমারি ইফতারের পসরা সাজানো হয়, তার আকর্ষণে দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই ছুটে আসেন। রাস্তার পাশের ভ্যানে স্বল্প দামের ফাস্ট ফুড যেমন আছে, তেমনি আছে দামি চেইন শপ। আছে ঝকমকে, স্মার্ট, ড্যাশিং সব ক্রেতা। বাহারি পোশাক। আছে প্রেমিক-প্রেমিকাদের কলগুঞ্জন। পুরো বেইলি রোড যেন হেসে ওঠে রঙধনুর মতো। আর সন্ধ্যা হলে তো আরো বেশি রঙিন হয়ে ওঠে। অফিস থেকে বের হলেই মনটা কেমন উড়ু উড়ু হয়ে যেত।
এমন একটি আনন্দময় পরিমণ্ডল থেকে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় চ্যানেল আইয়ের অফিস স্থানান্তর হওয়ায় মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়। যদিও বর্তমান অফিসের সঙ্গে আগের ছোট্ট গণ্ডির অফিসের কোনো তুলনাই হয় না। একটি কর্পোরেট অফিস যেমনটি হওয়া উচিত, তার কোনো কমতি নেই নতুন অফিসে। সাজ-সজ্জায়, সৌকর্যে-সৌন্দর্যে, বহিরঙ্গে। আছে সবুজের কিঞ্চিৎ ছোঁয়াও। তবুও মনটা পড়ে থাকতো বেইলি রোডে। কিন্তু প্রয়োজন ও চাহিদাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। সে ক্ষেত্রে আবেগও গুরুত্বহীন হয়ে যায়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একসময় সব কিছু বদলে যায়। এখন আর বেইলি রোডের কথা খুব একটা মনে পড়ে না। দেখতে দেখতে তাও তো প্রায় সাত বছর হতে চললো। কম সময় তো আর নয়। চ্যানেল আই অফিসের পরিসর এখন অনেক বড়। পরিবারের পরিধিও বেড়েছে। ‘সাপ্তাহিক’, ‘আনন্দ আলো’ পত্রিকার সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘রেডিও ভূমি’ ও ‘চ্যানেল আই অনলাইন’ (এ অনলাইনের আজ প্রথম জন্মবার্ষিকী)। সব মিলিয়ে অনেক বেশি জমজমাট। তাছাড়া অফিস চত্বরে সারা বছরই কোনো না কোনো অনুষ্ঠান লেগেই আছে। এক একটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বদলে যায় চ্যানেল আই। সেজে ওঠে নতুন রূপে। হয়ে ওঠে এক খণ্ড বেইলি রোড। কখনো গ্রামীণ পরিবেশের আমেজ পাওয়া যায়। কখনো নাগরিক জীবনের প্রতিফলন দেখা যায়। কখনো লাল-সবুজের ছোঁয়ায় বর্ণিল হয়ে ওঠে। কখনো ব্যান্ড সংগীতে নেচে ওঠে হৃদয়। আবার মাতিয়ে দেয় রবীন্দ্রমেলা, নজরুলমেলা, হুমায়ূনমেলা। এ সব অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সমাজের সব স্তরের মানুষের সমাগম লেগেই থাকে। পাশ দিয়ে হেঁটে যান স্বপ্নের তারকারা। কেউ কেউ মুচকি হাসি দিয়ে আলাদাভাবে নজর কেড়ে নেন। তাঁদের ডিওডেরেন্টের সুগন্ধ বুকটা ভরিয়ে দেয়। মনটাও ফুরফুরে হয়ে ওঠে। চাইলে তাঁদের সঙ্গে সেলফিও তোলা যায়। দূরের মানুষদের এতটা কাছাকাছি থাকতে পারাটা তো কম আনন্দদায়ক নয়।
তবে আমার কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হয় চ্যানেল আইয়ের খোলামেলা রুফটপ। এখানেও আয়োজিত হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান। কখনো গানে গানে স্বাগত জানানো হয় ভোরবেলাকে। কখনো প্রাণবন্ত আড্ডা জমে ওঠে লেখক-সাহিত্যিকদের। কখনো সম্ভাবনাময় মডেলদের পদচারণায় অন্য রকম আবেশ ছড়িয়ে পড়ে। চ্যানেল আই ‘নিউজ নাইট’ও কম সৌরভ ছড়ায় না। ক্যান্টিনকে কেন্দ্র করে হরওক্ত ছোট-খাট আড্ডা লেগেই থাকে। ডালপুুরি, লুচি, পরটা-ডিম, মোগলাই পরটা, চায়ের জন্য ছুটে আসেন কম-বেশি সবাই। আপ্যায়িত করা যায় অতিথিদেরও। সিগারেটের নিষিদ্ধ প্রলোভন যাঁরা এড়াতে পারেন না, তাঁদের তো বাধ্য হয়ে আসতেই হয়। আর কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠলে একবুক তাজা বাতাস নেওয়ার জন্য ছাদটাই উত্তম স্থান। খুলে যায় মাথার অনেক জট। ফাঁকে ফাঁকে পুরো অফিসের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত সবার সঙ্গে সবার দেখা-সাক্ষাতও হয়ে যায়। ঘুচে যায় দূরত্ব। মোবাইলে সেরে ফেলা যায় গোপন আলাপনও। ছাদটা কখনো হয়ে ওঠে প্রকৃত অর্থেই খেলার মাঠ। শীতকালে ব্যাডমিন্টন খেলা তো হয়ই, সেইসঙ্গে অনুশীলন চলে ক্রিকেটেরও। একটি ছাদকে কেন্দ্র করে এত আয়োজন, সাধারণত খুব একটা দেখা যায় না।
এই ঢাকা শহরে হাইরাইজ বিল্ডিং যেভাবে উঠছে, তাতে খোলা চাতাল দিনে দিনে দুর্লভ হয়ে ওঠছে। এমনকি আকাশও ঢেকে যাচ্ছে। আড়ালে চলে যাচ্ছে চাঁদমামাও। এ ক্ষেত্রে বিশেষ আকর্ষণ চ্যানেল আইয়ের ছাদ। চারপাশ থেকে অনেকটাই আলাদা হয়ে আছে এই খোলা চত্বর। আধো আলো, আধো অন্ধকারে পাওয়া যায় বসন্তের মাতাল সমীরণ। রিমঝিম বৃষ্টির স্পর্শ। কখনো-সখনো ভালোবাসার মানুষের কাল্পনিক ফিসফিসানি। সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার, অবলোকন করা যায় মায়াভরা চাঁদ আর মায়াবিনী রাত। সেই সূত্রে ‘আসমান ভাইঙ্গা জোছনা পড়ে’। সেই ধবল জোছনায় ইচ্ছেমতো অবগাহন করা যায়। লুটোপুটি খেলা যায়। চাইলে মন উজাড় করে বিলিয়েও দেওয়া যায় অঢেল জোছনা। এমন জোছনায় বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই অনুভব, ‘তোমায় আমি জোছনা দেব/তারার চাদরে জড়িয়ে নেব’।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)