বিশিষ্ট বিনোদন সাংবাদিক আওলাদ হোসেনের মৃত্যুতে অশ্রুসজল আর্শীবাদ দিয়ে ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন তার ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়েছেন।
লুৎফর রহমান রিটন লিখেছেন ‘মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন। আমাদের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র সাংবাদিক। মানবজমিন পত্রিকার সিনিয়র কালচারাল রিপোর্টার। আমার বিশেষ প্রীতিভাজন। চ্যানেল আই-এর যে কোনো উৎসবে আনন্দ সমাবেশে যাঁর উপস্থিতি ছিলো নিয়মিত।
গতরাতে চলে গেছে না ফেরার দেশে। চ্যানেল আই-এর গানে গানে সকাল শুরু অনুষ্ঠানের শুরুতেই আওলাদের মৃত্যু সংবাদ। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আহারে! কতো স্মৃতি এই ছোট ভাইটির সঙ্গে! কাজ করতাম দৈনিক খবর হাউসে। সাপ্তাহিক মনোরমার দায়িত্বে ছিলাম আমি। ছায়াছন্দের দায়িত্বে ছিলেন হারূনুর রশীদ খান। চিত্রবাংলার দায়িত্বে গোলাম কিবরিয়া। ছায়াছন্দ আর চিত্রবাংলায় লিখতে শুরু করলো আওলাদ। বিনে পয়সার কন্ট্রিবিউটর। টাকা পয়সার দরকার নেই। নিয়মিত ওর নামে রিপোর্ট ছাপা হলেই সে খুশি।
নিয়মিত আমাদের অফিসে আসে। আমাকে দেখলেই উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। পুরোন ঢাকার ছেলে। কথাবার্তা আর চালচলনে ঢাকাইয়া ছাপ। আমিও ঢাকাইয়া। আমার সঙ্গে খুবই খাতির জমিয়ে ফেললো ছেলেটা। কোনো এক নায়ক কিংবা নায়িকার সাক্ষাৎকারের এসাইনমেন্ট দিলেন হারূণ ভাই। কী যে খুশি আওলাদ! নতুন প্যান্ট আর শার্ট কিনে ফেললো। সেই নতুন প্যান্ট-শার্ট পরে আমাকে দেখালো। ওর যুক্তি–এতো বিখ্যাত একজন শিল্পীর কাছে যাচ্ছে, পোশাকটা গর্জিয়াস হওয়া চাই। আমিও পিঠ চাপড়াই–গুড। তোমারে দিয়া হইবো। লাইগা থাকো মিয়া! আওলাদ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বসে–দোয়া কইরেন গুরু!
আওলাদ লেগে থাকে। বিনে পয়সার কন্ট্রিবিউটর আওলাদের চাকরি হয় ছায়াছন্দে। হারূণ ভাইয়ের কর্মী বাহিনির তিন তরুণ তুর্কি–আওলাদ হোসেন-রেজাউর রহমান ইজাজ আর …দাপিয়ে বেড়ায় এফডিসি এবং রামপুরা টিভি স্টেশন। খুব দ্রুতই আওলাদ ফিল্মের মানুষজনদের প্রিয়ভাজন তরুণ সাংবাদিক হিশেবে নিজের একটা চমৎকার অবস্থান তৈরি করে ফেললো। দিন যায়। আমার কাছে খবর আসে–নায়িকা মৌসুমী কিংবা নায়ক মান্নার খুব ঘনিষ্ঠজন হয়ে উঠেছে আমাদের আওলাদ। চলচ্চিত্র জগতের প্রবীনদেরও আস্থাভাজন সাংবাদিক হয়ে উঠলো আমাদের আওলাদ।
চলচ্চিত্রের শিল্পী-কলাকুশলী-পরিচালক-প্রযোজক-পরিবেশক সকলেই আওলাদকে ভালোবাসেন। এভাবে ক্রমশঃ ঢাকাই ফিল্মি দুনিয়ায় একটি অপরিহার্য নাম হিশেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেললো মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন নামের সদা হাস্যোজ্জ্বল তরুণটি। ঢাকাই ছবি বিষয়ে আওলাদ ছিলো রীতিমতো তথ্য ভাণ্ডার। ঢাকার সিনেমা কিংবা নায়ক-নায়িকা বিষয়ে আমার কোনো কনফিউশন থাকলে আমি একজনকেই জিজ্ঞেস করতাম, আওলাদ এইটা কবে রিলিজ হয়েছিলো? ওঁর প্রথম সিনেমা কোনটি? হয় টেলিফোনে কিংবা ফেসবুকে ওর ইনবক্সে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিতাম। অসম্ভব ক্ষিপ্র গতিতে জবাব চলে আসতো। এই কারণে আমি ওকে বলতাম ঢাকাই ছবির এনসাইক্লোপিডিয়া। শুনে আওলাদ খুশিও হতো আবার লজ্জাও পেতো। বলতো-গুরু দোয়া কইরেন! আমার সম্পাদনায় ‘ইমপ্রেস টেলিফিল্ম চলচ্চিত্র য়্যালবাম’ প্রকাশিত হয়েছিলো ২০১১ সালে। ঢাউস সাইজের ওই য়্যালবামে আওলাদের তথ্য সহায়তা আমাদের অনেক সমৃদ্ধ করেছিলো। আওলাদ ওর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যগুণে সাগর ভাই অর্থাৎ ফরিদুর রেজা সাগরেরও মনোযোগ আর ভালোবাসা কেড়েছিলো বিপুল পরিমাণে।
‘ছোটকাকু’ ছাড়াও ছোটদের জন্যে রচিত সাগর ভাইয়ের একটা সিরিজ বই আছে। ওই সিরিজের বইগুলোর চরিত্ররা কাল্পনিক থাকে না। ওরা বাস্তবের পরিচিত মুখ। অভিনব সেই ছোটদের বইয়ের চরিত্র হিশেবে কখনো শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, কখনো জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, কিংবা কখনো নায়করাজ রাজ্জাককে খুদে পাঠকদের সামনে হাজির করেন সাগর ভাই। এই সিরিজের আরেকটা বৈশিষ্ট্য–বইগুলোয় কোনো ইলাস্ট্রেশন থাকে না। থাকে আলোকচিত্র। গল্প অনুযায়ী সিকোয়েন্স মিলিয়ে আলোকচিত্র। মনে আছে, সাগর ভাই একটা বইতে সাংবাদিকের চরিত্রে মোহাম্মদ আওলাদ হোসেনকে চিত্রিত করেছিলেন। বইটিতে আওলাদের অনেকগুলো চাররঙা আলোকচিত্র ছিলো!বইটি হাতে পেয়ে মহাউচ্ছ্বসিত আমি বলেছিলাম–তুমি তো মিয়া অমরত্ম পাইয়া গেলা! জবাবে হাস্যোজ্জ্বল আওলাদ বলেছিলো–আপনার আশীর্বাদ গুরু!
২০০১ এর মধ্য জুন থেকে আমি দেশান্তরী হয়ে টানা সাত বছর কানাডায় কাটিয়ে দেশে ফিরে ২০০৮ এর বইমেলায় আওলাদের সঙ্গে দেখা। আওলাদ আমার একটা ইন্টারভিউ করতে চাইলো মানবজমিন পত্রিকার জন্যে। বাংলা একাডেমিতে এক সন্ধ্যায় কোনো একটা স্টলে বসে আওলাদ আমাকে নানা প্রশ্ন করলো। আমি জবাব দিলাম। এক পর্যায়ে ইন্টারভিউ নেয়া শেষ হলো। আওলাদের সঙ্গে কোনো রেকর্ডার ছিলো না। ছিলো না কোনো নোটবুক। আওলাদ আমাকে প্রশ্ন করছিলো, আমার জবাবগুলো শুনছিলো, এবং আবারো প্রশ্ন করছিলো। কিন্তু কোনো নোট নিচ্ছিলো না।
এক পর্যায়ে আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে আওলাদ চলে যাচ্ছিলো। আমি বললাম–কী দেখাইলা এইটা? রেকর্ড করলা না, নোটও নিলা না, কাহিনি কী? আওলাদ বলেছিলো–এতোদিন আপনাগো কাছ থিকা কী শিখলাম গুরু? নোট লাগবো না। আমার উপ্রে আস্থা রাখেন। কোনো উলটাপালটা হইবো না। মানবজমিন পত্রিকায় কয়েকদিন পরে আমার সাক্ষাৎকারটি ছাপা হলো। আমি বিস্মিত হলাম! কোনো ভুল নেই। সবকিছু একদম ঠিকঠাক! আমি যা যা বলেছি একদম হবহু সেই কথাগুলোই লিখেছে আওলাদ!
ফেসবুকে আওলাদ স্ট্যাটাস দিতো নিয়মিত। ওর স্ট্যাটাসের শতকরা ৯৯ভাগই ছিলো কোনো না কোনো গানের পঙ্ক্তি। ফেসবুকে আমার লেখাগুলোয় ছোট ছোট মন্তব্যে আওলাদ তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতো। আমার পোস্ট করা লেখায় আর কোনোদিন কমেন্ট করবে না আওলাদ!
কানাডা থেকে মাঝে মধ্যেই কোনো উপলক্ষ্য ছাড়াই আওলাদকে আমি ফোন করতাম। মধ্যরাতে ফোন করতাম। ফোন করতাম খুব সকাল বেলাতেও। এরমধ্যে একদিন ওর বউ আর ছেলেমেয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই আওলাদ বলেছিলো–বউ আর ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে খুব ভালো আছি গুরু। আপনার কথামতো ‘সংসার’ বানানটা ঠিক রেখেছি। আওলাদের কথায় সেদিন আমার মনে পড়েছিলো অনেক বছর আগের এক সন্ধ্যার স্মৃতি। আওলাদের বিয়ের রিসেপশন ছিলো সেই সন্ধ্যায়, বেইলি রোডের একটি চিনে রেস্তোরাঁয়।
সেই সন্ধ্যায় সাগর পাবলিশার্স থেকে বাংলা বানান বিষয়ক একটা অভিধান কিনে ওকে আমি উপহার দিয়েছিলাম। ইনার পেজে লিখে দিয়েছিলাম–‘প্রিয় আওলাদ, সংসার বানানটা ঠিক রেখো।’ গতকাল রাতে অনুজ প্রতীম সাংবাদিক বন্ধুটি ওর সাজানো সংসারটিকে তছনছ করে দিয়ে পাড়ি জমিয়েছে অন্য ভুবনে। প্রিয় আওলাদ, তোমার জন্যে আমার অশ্রুসজল আশীর্বাদ এখনো বহাল রয়েছে! বহাল রয়েছে শর্তহীন ভালোবাসাও। মিউজিক আর রিদমসমৃদ্ধ উজ্জ্বল উচ্ছ্বল রঙঝলমলে চলচ্চিত্রাঙ্গনের মতোই রঙিন আর বর্ণাঢ্য আলোর প্লাবনে সদা ঝলমলে থাকুক তোমার অন্য ভুবনটিও। ভালো থেকো বন্ধু।’