চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের চাঁদাবাজি বন্ধে করণীয় কী?

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সাহায্যের নামে চাঁদাবাজির বিষয় নতুন নয়। রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন সড়কের বাস স্ট্যান্ডে যাত্রীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা না দিলে তাদের কাছে যাত্রীদের বেকায়দায় পড়তে হয়। এমনকি সদ্য ভূমিষ্ঠ নবজাতককে জিম্মি করেও তারা বড় অঙ্কের টাকা দাবি করে। এই সমস্যার সমাধানে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে তাদেরকে মূল ধারার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজি রোধ করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন? চ্যানেল আই অনলাইনের এমন প্রশ্ন ছিল নিরাপত্তা ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমকর্মী ও মানবাধিকারকর্মীদের কাছে।

অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন: তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীদের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার মধ্যে আনতে হবে। সরকারীভাবে এবং আমাদের বেসরকারী যে উন্নয়ন সংস্থাগুলো রয়েছে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার নিয়ে দু’য়েকটা সংস্থা রয়েছে যারা নিয়মিত কাজ করে। তবে একটা দীর্ঘ মেয়াদী কাঠামোর মধ্যে তাদের আনতে হলে অধিকাংশ উন্নয়ন সংস্থাকেই এগিয়ে আসতে হবে।

‘তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীদের জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচীর মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি করা যায় এবং তাদের যে সামাজিক মানসিক নির্যাতনগুলো রয়েছে সেগুলো যদি সচেতনতার মাধ্যমে মানুষদের জানানো যায় তবে তা কাজে লাগবে। যদিও তাদের চাঁদাবাজি কিংবা ভিক্ষাবৃত্তি একদিনে বন্ধ হবার নয়।’

দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা না নিলে তাদের নিয়ে যে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তা দূর করা যাবে না জানিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. জিয়া রহমান বলেন: ‘আমরা যদি এখনই এসব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বিষয়ে পরিকল্পনা না নেই তাহলে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে। তাদের কর্মসংস্থান করাটা খুব বড় বিষয় না। তাদের ব্যাপারে কারো কোন আগ্রহ নেই। কারণ সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। আবার অনেক সময় দেখা যাবে তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেই কর্মসংস্থানে আসতে চাইবে না।’

ডা. মোহিত কামাল

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়টি নজরদারিতে আনার তাগিদ দিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রধান ডা. মোহিত কামাল। তিনি বলেন: ‘পারিবারিক শিক্ষা সবার জন্যই প্রয়োজন, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীরা সেটা থেকে বঞ্চিত। পরিবার যখন দেখতে পারে ভূমিষ্ট শিশুটি সবার মতো না কিংবা একটা বয়সের পর যখন মনমানসিকতায় তৃতীয় লিঙ্গের মতো তখন তারা বিষয়টি চেপে যায়। পরিবার থেকে বের করেও দেওয়া হয়। অধিকাংশ সময় তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীরাই পরে ওই মানুষটিতে তাদের ডেরায় স্থান দেয়।’

‘শিক্ষাজীবন ও পারিবারিক শিক্ষা না থাকায় তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীদের প্রধান গুরুমা এর শাসনে গড়ে ওঠে তারা।  সেই গুরুমাই তাদের দিয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করায়।  আবার কখনো নিদিষ্ট টাকা গুরুমাকে দিনশেষে দিতে না পারলে তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি নেমে আসে অত্যাচার ও নিপীড়ন। তাই তারা অনেক সময় টাকার জন্য জনসাধারণের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে।’

ডা. মোহিত কামাল বলেন: সরকারের উচিত তৃতীয় লিঙ্গের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা। প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন, ঠিক তেমনভাবে তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি পদক্ষেপগুলো নিলে আর কোন সমস্যা থাকবে না। কারণ তৃতীয় লিঙ্গও প্রতিবন্ধী; তারা লিঙ্গ প্রতিবন্ধী।

গণমাধ্যমকর্মী মীর মাসরুর জামানও ড. জিয়া রহমান এবং ডা. মোহিত কামালের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছেন। চ্যানেল আইয়ের জেষ্ঠ্য বার্তা সম্পাদক মীর মাসরুর জামান বলেন: শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীদের মূল ধারার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। যেকোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের দূরে রাখতে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর ইচ্ছাও থাকতে হবে।

মীর মাসরুর জামান

‘তাদের নিয়ে সমাজে যে খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের মধ্যে রয়েছে সেটা দূর করতে পরিবার, অভিভাবক, আমাদের এবং নীতি নির্ধারকদের এগিয়ে আসতে হবে।’

তিনি বলেন: একজন হাত ভাঙা কিংবা পা না থাকা মানুষের যদি সমাজে গ্রহণযোগ্যতা থাকে তাহলে কেন লিঙ্গ প্রতিবন্ধীদের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না? কিন্তু জন্মের পর যদি একটি শিশু হাত কিংবা পা ছাড়া জন্মায় তাদের পরিবার মানুষ হিসেবে গড়ে তুললেও একটি তৃতীয় লিঙ্গের শিশুকে গড়ে তুলে না।

তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজি রোধে গণমাধ্যম কী ভূমিকা রাখতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন: তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেই কোন প্রকার অপকর্মে না জড়িয়ে অন্য দশজনের মতো সমাজে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করছে। কেউ হস্তশিল্পের কাজ করছে, কেউ পার্লারের কাজ করছে। তাদেরকে খুঁজে প্রতিবেদন প্রচার করে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এছাড়াও টেলিভিশন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেও অন্য তৃতীয় লিঙ্গদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

মানবাধিকার ও সাংস্কৃতিক কর্মী এইচ এ ববি সারাদেশ থেকে তৃতীয় লিঙ্গের একটি কমিটি করার আহ্বান জানিয়েছেন।

এইচ এ ববি

তিনি বলেন: সারাদেশে যদি তৃতীয় লিঙ্গের একটি কমিটি থাকে এবং তারা যদি সেটা পরিচালনা করে তবে চাঁদাবজিসহ তাদের নানা অপরাধ দূর হয়ে যাবে।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমস্যা বা কষ্ট তারাই ভালো বোঝে জানিয়ে এইচ এ ববি বলেন: তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী থেকে যদি কাউকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অর্ন্তভূক্ত করা হয়, তাহলে সত্যিকার অর্থে তাদের সমস্যা সমাধান হবে।

এইচ এ ববির সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরাও। তারা বলছেন, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার সঙ্গে এমনটা হলে তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজিসহ সব ধরনের অপকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে। সমাজের অন্য মানুষদের মতো তারাও সঠিক উপার্জন করে সমাজে টিকে থাকবে।