ঘাড়ে চোট পাওয়ার পরও ফিরে এসেছিলেন। করেছিলেন আরও ১২ রান। শেষ পর্যন্ত ৯২ করে আউট হওয়া স্টিভ স্মিথকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। জফরা আর্চারের বলে আঘাত পেয়ে পিচে লুটিয়ে পড়লেও মারাত্মক কিছু হয়নি। রাত পেরোনোর পর সেই স্মিথের ‘বদলি’ নামাতে বাধ্য হয় অস্ট্রেলিয়া। হেডিংলেতে ২২ আগস্ট থেকে শুরু হতে যাওয়া তৃতীয় টেস্টে অনিশ্চিত স্মিথ।
শুধু লর্ডস টেস্টের পঞ্চম দিনই নয়, স্মিথকে সফরের তৃতীয় টেস্টে পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘এই রকম ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তিরিশ শতাংশ ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে চোটের গভীরতা পরে বোঝা যায়। সেই কারণে কোনো ঝুঁকি নেয়া হচ্ছে না। তৃতীয় টেস্টের আগে ও কতটা ফিট, সেটা দেখেই খেলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
সিএর বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘সারা রাত স্মিথকে মেডিকেল স্টাফরা নজরে রেখেছিলেন। সে ভালো ঘুমিয়েছিল। কিন্তু সকালে মাথা ঘুরছিল তার। কিছুটা শারীরিক অস্থিরতাও ছিল তার মধ্যে।’
স্মিথের কনকাশনের পর ফিল হিউজের স্মৃতি ফিরে এসেছিল অনেকের মনে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কোনো ব্যাটসম্যানের ঘাড়ে বা মাথায় চোট পেলেও তা সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না। সময় লাগে। স্মিথের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা কিছুটা হল তেমনই। যে কারণে সব মহলেই একটা আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। রোববার সকালে দলের ডাক্তার রিচার্ড শ পরীক্ষা করেন স্মিথকে। তার পরই তাকে বিশ্রামে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। চব্বিশ ঘণ্টা তাকে ডাক্তারি নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডের জানায়, ‘কনকাশন নিয়ম অনুযায়ী সকালে আরও এক দফা পরীক্ষা করা হয়েছে স্মিথকে। তাতে দেখা যায়, তার চোটের অবস্থার কিছুটা অবনতি হয়েছে। যে কারণে স্মিথের বদলি নেয়া হল।’
মাস খানেক আগেই আইসিসি ক্রিকেটে ‘সাবস্টিটিউট’ নিয়ম চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। ক্রিকেটে চোট আঘাতের পরিমাণ বাড়ছে বলেই এই নিয়মের অন্তর্ভুক্তি হয়েছে। এই অ্যাশেজ সিরিজ থেকেই যা বলবৎ হয়েছে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্টেই অস্ট্রেলিয়াকে বদলির পথে হাঁটতে হল। ক্রিকেটে এটাই প্রথম পরিবর্ত নেয়া হল। মারনাস লেবুশেন তার বদলে লর্ডস টেস্টের শেষ দিন অজি দলের হয়ে খেলেন। নিয়ম অনুযায়ী তিনি বল ও ব্যাট- দুই-ই করতে পারেন। যেটা এখন ইতিহাস।
চোটের জন্য যখন সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন স্মিথ, তখন তাকে বাউন্সার দেয়ার পর ব্যঙ্গের হাসি হাসার জন্য আর্চারকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। ৯৩ মাইল গতিতে করা ইংলিশ পেসারের বল আছড়ে পড়েছিল স্মিথের ঘাড়ে। যার পর পিচেই যন্ত্রণায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। যা দেখে আর্চার হেসেছিলেন।
টুইটারে এ নিয়ে বিস্তর কটাক্ষ সহ্য করতে হয়েছে আর্চারকে। একজন লিখেছেন, ‘আর্চারের বাউন্সারে স্মিথ মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর তাকে দেখতে ছুটে যাওয়ার বদলে দাঁড়িয়ে হাসছিল। একজন খেলোয়াড়ের এই মনোভাব দেখাই যায় না!’
শোয়েব আখতারের মতো সাবেক পেসারও আর্চারকে বিঁধেছেন। ‘বাউন্সার ক্রিকেটের অঙ্গ। কিন্তু কোনো একজন বোলারের বল যদি ব্যাটসম্যানের মাথায় বা ঘাড়ে লাগে আর সে পড়ে যায়, ওই বোলারকে কিছুটা সহবৎ দেখাতে হয়। তার উচিত, ব্যাটসম্যানের কাছে গিয়ে তাকে দেখা, বোঝার চেষ্টা করা, চোট কতটা গুরুতর। এটা আর্চার করেননি। স্মিথ যখন যন্ত্রণায় কাতড়াচ্ছিলেন, তখন সে হেঁটে চলে যায়। আমি কিন্তু সবসময় ব্যাটসম্যানদের কাছে ছুটে যেতাম।’
শোয়েব যাই বলুন না কেন, আর্চার কিন্তু তার বাউন্সারে স্মিথকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ম্যাচের পর বলেছেন, ‘দ্রুত উইকেট তোলার চেষ্টা করছিলাম। তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম। ভালো স্পেল করেছি। কিন্তু তাকে পিচে পড়ে যেতে দেখে সবারই আতঙ্কে হার্টবিট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্মিথ যখন উঠে দাঁড়ায়, তখন আবার নিঃশ্বাস নিতে শুরু করেছিলাম। তাকে স্ট্রেচারে করে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হোক, কেউ চায়নি। সে উঠে দাঁড়ানোর পর স্বস্তি পেয়েছি।’
এজবাস্টনে জোড়া সেঞ্চুরি করা স্মিথের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছিলেন আর্চার। ‘আমি এর আগে কখনো স্মিথকে নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বেরোতে দেখিনি। একটা লেগ স্লিপ রেখে চেষ্টা করছিলাম তার কোমর লক্ষ্য করে বল করতে। একটা বল যদি আরও বেশি তুলতে পারি, লেগ স্লিপে ক্যাচ যাবে, এই আশায়। তার বদলে যেটা ঘটেছে, সেটা মোটেই ভালো ছবি নয়।’
ঘাড়ে চোট পাওয়ার পর মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যান স্মিথ। পরে আবার ফিরে আসেন। যা দেখার পর গ্যালারি থেকে কিছু সমর্থক কটুক্তি করেছিলেন। ওই ঘটনায় বিস্তর চটেছেন মিচেল জনসনের মতো সাবেক পেসার। জনসন বলেছেন, ‘যে সমর্থকরা এটা করলেন, তারা আর যাই হোন না কেন, ক্রিকেট ভক্ত নন। হলে এই আচরণ করতে পারতেন না।’
ঘটনা বহুল টেস্ট শেষ পর্যন্ত ড্র হয়। স্মিথের বদলি হিসেবে খেলা লেবুশেনই লর্ডসে বাঁচিয়ে দেন অস্ট্রেলিয়াকে।
দ্বিতীয় ইনিংসে ২৫৮-৫ তুলে ডিক্লেয়ার করে ইংল্যান্ড। পঞ্চম দিনের শেষ কয়েক ঘণ্টা ২৬৭ রানের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া ১৫৪-৬-এ থামে। আর কিছু ওভার হাতে থাকলে কী হত, বলা মুশকিল। একদিকে লেবুশেন ৫৯ রানের ইনিংস খেলেন। ১০০ বল থেকে ৯টা চার দিয়ে সাজান ইনিংস। ৪২ রান করে নটআউট থেকে তাকে সঙ্গ দেন ট্রভিস হেড।
পঞ্চম দিন শেষ কয়েক ঘণ্টা আর্চারকে সামলাতে হিমশিম খা অজিরা। ডেভিড ওয়ার্নার (৫) ও উসমান খাজাকে (২) ফিরিয়ে দেন প্রথম স্পেলে। তখন ১০ ওভার বল করে ২ মেডেন সহ ২৬ রান দিয়ে তুলেছিলেন ২ উইকেট। পরে আবার বল করতে এসে ফিরিয়ে দেন অধিনায়ক টিম পেইনকে (৪)। সব মিলিয়ে ১৫ ওভারে ৩২ রান দিয়ে নেন ৩ উইকেট।
পঞ্চমদিন অবশ্য লর্ডসে একা আর্চার নন, বেন স্টোকসও আছেন। আগের দিন ৯৬-৪ নিয়ে নামা ইংলিশদের একাই টেনেছেন স্টোকস। দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করেছেন এ অলরাউন্ডার। ১৬৫ বল খেলে ১১টা চার ও ৩টি বিশাল ছয় সহ ১১৫ রান করে নটআউট থাকেন। শেষ দিনে কোনো অজি বোলারই তাকে নড়াতে পারেননি। জস বাটলার (৩১) বেশিক্ষণ টিকতে না পারলেও জনি বেয়ারস্টো ৩০ করে অপরাজিত থাকেন। জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই অস্বস্তিতে ছিল অস্ট্রেলিয়া।
ওয়ার্নার ও খাজা দ্রুত ফিরে গেলেও কিছুটা প্রতিরোধ তৈরি করেছিলেন ওপেনার ক্যামেরন বেনক্রফট। কিন্তু ১৬ রানের মাথায় জ্যাক লিচের বলে ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হন তিনি। আর্চারের মতোই শেষ বেলায় ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল বাঁহাতি স্পিনারকেও। লেবুশেন ও ম্যাথু ওয়েডকে (১) ফিরিয়ে দেন তিনি। ১৬.৩ ওভার বল করে ৩৭ রান দিয়ে নেন ৩ উইকেট।
সংক্ষিপ্ত স্কোর: ইংল্যান্ড (দ্বিতীয় ইনিংস) ২৫৮-৫ (ডি): (স্টোকস ১১৫ অপঃ বেয়ারস্টো ৩০ অপঃ কামিন্স ৩-৩৫)। অস্ট্রেলিয়া (দ্বিতীয় ইনিংস) ১৫৪-৬ (লেবুশেন ৫৯, হেড ৪২ অপঃ, আর্চার ৩-৩২, লিচ ৩-৩৭)।