ব্রাহ্মণ বাবা-মায়ের ঘর ছেড়ে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে হরিজন বর্ণের ছেলে তুষারকে বিয়ে করে সুম্মিতা। ধর্মীয় বর্ণের বিচারে প্রচলিত সামাজিক নাটকীয়তার একপর্যায়ে স্ত্রীকে অপহরণের দায়েই ১৪ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে তুষারকে যেতে হয় কারাগারে। সেই তুষারের আজ জামিন মিলেছে হাইকোর্টে।
সেফ হোম আর আদালতের বারান্দা ঘুরে অবশেষে ছোট্ট সন্তানকে কোলে নেয়া সুম্মিতার মুখে হাসি ফুটেছে স্বামীর জামিনের পরে।
সিনেমার গল্পের মত তুষার-সুস্মিতার বিয়ে আর ভালোবাসা সম্পর্কে আদালত সূত্রে জানা যায়, প্রায় দুই বছর আগে ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর হিন্দু ধর্মাবলম্বী হরিজন বর্ণের ছেলে তুষার দাস ভালবেসে বিয়ে করেন ব্রাহ্মণ বর্ণের মেয়ে সুম্মিতা দেবনাথ অদিতিকে। এই দম্পতির কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। কিন্তু ওই বিয়ে মেনে নিতে পারেনি সুস্মিতার পরিবার।
সুস্মিতার মা ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবরে তুষারের বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন। এই মামলার সূত্র ধরে থানা পুলিশ পেরিয়ে সুস্মিতাকে থাকতে হয় সেফহোমে, আর তুষারকে নেওয়া হয় কারাগারে।
বয়সের বিচারে পরবর্তীকালে সুম্মিতা মেডিকেল রিপোর্ট পাওয়ার পরে শরিয়তপুরের কিশোর আদালত তুষারকে জামিন এবং সুম্মিতা সেফ হোম থেকে নিজ জিম্মায় দেন। আর মামলাটি শরিয়তপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। কিশোর আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করে সুম্মিতার মা। অন্যদিকে মামলার কার্যক্রম চলতে থাকে শরিয়তপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। একপর্যায়ে নারী ও শিশু আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন।
আরেকদিকে সুস্মিতার মায়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কিশোর আদালতের আদেশ স্থগিত করেন হাইকোর্ট। এর ফলে তুষারকে জামিন এবং সুম্মিতাকে সেফ হোম থেকে নিজ জিম্মায় যাওয়ার আদেশ স্থগিত হয়ে যায়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে তুষারের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে আবেদন করে বলা হয়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত তো মামলা খারিজ করে দিয়েছেন। তখন হাইকোর্ট আবার তুষারকে জামিন এবং সুস্মিতাকে নিজ জিম্মায় থাকার আদেশ দেন। সেইসঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতকে সুম্মিতার বয়স নির্ধারণ করে হাইকোর্টকে জানাতে আদেশ দেন।
কিন্তু এরপর এ মামলায় আসামীর জবানবন্দি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে শরীয়তপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জেলা জজ আ. ছালাম খান রায় ঘোষণা করেন। মামলার রায়ে তুষারকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। এরপর তুষারকে নেওয়া হয় কারাগারে।
পরবর্তীকালে সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ও জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন তুষার। তখন থেকেই স্বামীকে কারাগার থেকে বের করতে তিন মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে হাইকোর্টে ঘুরতে থাকে সুম্মিতা।
অবশেষে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ তুষারকে জামিনের আদেশ দেন।
আজ জামিন আদেশ দেওয়ার সময় হাইকোর্ট বলেন: ‘বিষয়টি এমন যে, এক দিকে আইন আর এক দিকে আমাদের সামাজিক বাস্তবতা। যদিও আইনে উঁচু -নিচু বর্ণে বিয়েতে কোন বাধা নেই। কিন্তু মেয়ের পরিবারের সামাজিক বাস্তবতাটাও ভাবতে হয়। কারণ, আমাদের সমাজে অনেক সময় এরকম ক্ষেত্রে মেয়ের পরিবারকে একঘরে করা হয়।’
এদিকে জামিন আদেশের পর উচ্ছ্বসিত হাসি দিয়ে হাইকোর্ট থেকে বের হন তিন মাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে থাকা সুম্মিতা। এসময় সে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ‘আমি খুব খুশি। ছোট্ট মেয়েটা ওর বাবাকে কাছে পাবে। আমি ভালোবেসে সেচ্ছায় তুষারকে বিয়ে করেছি। আমি মনে করি ভালোবাসায় কোন উঁচু নিচু বর্ণ বিষয় নেই।’
এসময় সুম্মিতার পাশে ছিলেন তার শশুর রঞ্জিত দাস। তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সুম্মিতাকে আমি আমার সন্তানের মত ভালবাসি। ও আমার মেয়ের মত থাকবে। আর আমার ছেলেটা এইচএসসি পরীক্ষার্থী আর সুস্মিতা এসএসসি পরীক্ষার্থী।
আদালতে তুষারের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শিশির মনির ও মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসাইন।