সর্বশেষ বড়পর্দায় দেখা গিয়েছিলো নাসির উদ্দিন ইউসুফ-এর ‘আলফা’ সিনেমায়। ক্রসফায়ারে নিহত সোলায়মানের অন্ধ মায়ের চরিত্রে। একটু সময়ের জন্য উপস্থিতি, কিন্তু এই অল্প সময়েই দর্শকের মন জয় করে নিয়েছিলেন তিনি!
বলছি সদ্য প্রয়াত অভিনেত্রী ও থিয়েটার কর্মী ইশরাত নিশাত-এর কথা। তাঁর মৃত্যুতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া। বিশেষ করে থিয়েটারের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন, তারা প্রত্যেকেই আপন মানুষ হারানোর শোকে নিমজ্জিত।
ইশরাত নিশাতের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন থিয়েটারসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সহকর্মীরা। কেউ তাঁর অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। সোশাল মিডিয়াতেও তাঁর সঙ্গে নানা সময়ের স্মৃতিকথা উল্লেখ করে শোক প্রকাশ করছেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষেরা।
ইশরাত নিশাতের মৃত্যুতে নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু শোক প্রকাশ করে লিখেন, ‘বাংলাদেশের নাটকের বিদ্রোহী কন্ঠস্বর ইশরাত নিশাত কন্যা আমার এ ভাবে কী চলে যেতে হয়!’
মঞ্চ কুসুম খ্যাত থিয়েটার কর্মী শিমুল ইউসুফের ভাষ্য: ‘আজ প্রথমবারের মত শুধু তোর (ইশরাত নিশাত) জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। তোর জন্য আলাদা করে কোনো আয়োজন করার সুযোগ তুই আমাদের দিস নাই। এমন আয়োজন চাইনি নিশু।’
শোক প্রকাশ করে সাংবাদিক অঞ্জন রায় লিখেন, ‘ইশরাত নিশাত আপা, এই তো সেদিন দেখা হলো। বললে ভালো থাকতেই হবে। আজ এই প্রস্থান। এখনই তো লাশবাহী গাড়ীর যাত্রী হওয়ার কথা না তোমার? কতদিন পর আজ সকালে কাঁদছি। আপা, এই চলে যাওয়া বড্ড বেমানান তোমার।’
ইশরাত নিশাতের সঙ্গে স্মৃতি আওড়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদ কন্যা শাওন মাহমুদ লিখেছেন: ‘ইশরাত নিশাত, সবার নিশাত আপা, আমার নিশি। জীবনের সবচেয়ে ভঙ্গুর সময়ে, নিশি কাছে ডেকে বলেছিল, সেলফ্ রেসপেক্ট বলে একটা কথা আছে জানিস তো? উত্তরে বলেছিলাম, হুম। পাল্টা জবাবে নিশি বলেছিল, যার সেলফ্ রেসপেক্ট নাই, তার জীবন উপেক্ষায় আর তাচ্ছিল্যে ভরপুর হয়। নিশির একটি বাক্যে জীবনের মানে পাল্টিয়ে ফেলেছিলাম একদম সেদিন থেকেই। সবসময় বলেছি নিশিকে তা। আবারও বলতে ইচ্ছে হলো। নিজের মতন জীবন যাপন করেছে নিশি। কাউকে কখনও বিরক্ত করে নাই। এমন কি যাবার সময়ও না। ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুদিন থাকতে নেই। সে বেঁচে থাকে তার ভালোবাসার মানুষের চোখের পাতায়। এখন থেকে তোমার জন্য নীলমনি ফুল ফুটবে আমার ছাদবাগানে। গুডবাই নিশি। ভালোবাসা।’
সাম্প্রতিক সময়ে ইশরাত নিশাতের সঙ্গে একটি স্মৃতি কথা তুলে ধরে কবি ও ব্যান্ড দল ‘মেঘদল’-এর সদস্য শিবু কুমার শীল লিখেছেন, ‘নিশাত আপার সাথে আমার তেমন কোনো স্মৃতি নাই। তবে তিনি আমার ‘সাংস্কৃতিক বন্ধু’, আমি বা আমরা তার সময়ে থিয়েটার করতাম একদা। নিশাত আপা দূর থেকে দেখতে খুব টাফ গাই ছিলেন। কিন্তু কাছে গেলেই বোঝা যেতো তার অপর দিক। মমতা। এসব একটা দূরত্বের জায়গায় দাঁড়িয়েই বলছি। তার চরিত্রের সবচেয়ে বড় দিক মনে হয় তার বোল্ডনেস, দৃঢ়চেতা মনোভাব। তার যাপন দেখলেই বোঝা যেতো টিপিকাল নারীর ঘেরাটোপ ডিঙ্গিয়ে ছিলেন তিনি। তার মানে এ তার রাজনৈতিক অবস্থান। তার কাছে নারী মানে এমনই। দৃঢ়। ভাঙবে তবু মচকাবে না। একটা এন্টি স্টাবব্লিশমেন্ট। পুরুষতন্ত্রকে কাচকলা। থিয়েটার পাড়ায় তার দিবারাত্রীর পদচারণা খেয়াল করেছি। কবে কে কী করলো তা দেখা, মন্তব্য করা। এবং অবশ্যই সৎ মন্তব্য। তার মন্তব্যে হয়ত সকলেই খুশি হত না। এইতো সেদিনের কথা আমি সামিউন জাহান দোলার নির্মিত ‘নভেরা’ নাটকটি দেখতে গিয়েছিলাম। কোনো একটা কারণে দেরি হয়ে যাওয়ায় টিকেট কাউন্টার ক্লোজ হয়ে গিয়েছিল। অগত্যা নাটক না দেখেই ফিরতে হবে ভেবে মন খারাপ লাগছিল হঠাৎ দেখলাম নাটক দেখতে ঢুকছেন নিশাত আপা। তিনি আমাকে চেনেন না। তবে তিনি এটুকু বুঝলেন আমি টিকিট খুঁজছি। একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, নাটক দেখবেন? আমি হেসে বললা, জি। বলতেই তার টিকেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি বললাম আপনি দেখবেন না? তিনি বললেন আমি দেখেছি। আবার দেখতে আসছি। তাছাড়া আমাকে আটকাবে না (হাসি)। আমরা একসাথেই অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে ঢুকলাম। তারপর নাটকে ডুবে গেলাম। নাটক শেষে ফেরার পথে খুব সংকোচ নিয়েই তাকে একটা ফৃদা কাহলো অথবা ভ্যানগঘ এর ছবি সম্বলিত একটা নোটবুক তার দিকে এগিয়ে দিয়েছিলাম শুভেচ্ছা স্বরূপ। তিনি হেসে তা গ্রহণ করলেন। এই হচ্ছে নিশাত আপা। একটা ছোট্ট স্মৃতি আজ কত বড় মনে হচ্ছে, ভারি মনে হচ্ছে। আহ জীবন। একটা প্রবাদ পড়েছিলাম শহীদুল জহীরের বইতে, কোনো কোনো মৃত্যু আছে পাহাড়ের মত ভারি, কোনো কোনো মৃত্যু পালকের মত হালকা।’
নাট্য নির্দেশক সুভাশিষ সিনহা লিখেছেন, ‘এই চাহনিতে আমরা অনেকেই চমকে গিয়েছি, কখনো বিব্রত হয়েছি, সংকোচে পড়েছি, আমাদের সকল গতি একেকবার থমকে গেছেই এই চাউনির সামনে- কী যে বলে উঠবেন! কী যেন মানে করবেন! তারপর নাটকীয় ভাবে হঠাৎ পিঠ চাপড়িয়ে দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠা! শিল্পকলার গেটের কোণে এই মূর্তিমান মহানাট্য আর দেখব না! এই তীক্ষ্ম প্রশ্নমধুর ভালোবাসা আর পাওয়া হবে না এ জীবনে! জীবন ছোট, তবু, বেশি ছোট হয়ে গেল না, নিশাত আপা?’
অভিনেত্রী সোহানা সাবার ভাষ্য, ‘তোমার মতো মানুষদের অনেক বছর বেঁচে থাকা উচিত! অথচ তোমরা স্বল্পআয়ু নিয়ে আসো এই অভাগা পৃথিবীতে…! ভালোবাসা নিও ইশরাত নিশাত আপু!’
মঞ্চ ও পর্দার দাপুটে অভিনেতা শতাব্দী ওয়াদুদ লিখেছেন, ‘ইশরাত নিশাত’- একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো! তখন বেইলী রোডে জম্পেশ থিয়েটার হয়! সব দলের কর্মীরাই কমবেশী আড্ডায় অংশগ্রহণ করে! মহিলা সমিতির মূল গেট বন্ধ করার সময় সবার শেষে যে মানুষটি বের হতেন তিনি নিশাত আপা! অনেকদিন সঙ্গী হয়েছি তার আমি, সঞ্জীবন, জগলুল, জাহাংগীর ভাই, রেজভী ভাই, সুজন ভাই- তখন তিনি শান্তিবাগে থাকতেন! বিদায়ের আগে মালিবাগ মোড়ে ডিম-পরোটা খাওয়াতেন! আমাদের থিয়েটার করার দুঃসময়ে অনেকেই যখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, তখন তাকে প্রাচ্যনাটের পাশে পেয়েছি বন্ধু হিসাবে, অভিবাবক হিসাবে! আদরও পেয়েছি, কড়া শাসনও পেয়েছি! ৯০ এর দশকে থিয়েটার নিয়ে তার প্যাশন ছিলো আইকনিক পর্যায়ের! থিয়েটার এর সব সেক্টরেই তার দখল ছিলো! এরকম একজন মানুষ, বন্ধু চলে গেলেন হুট করেই! ভালোই হয়েছে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা দুস্থ শিল্পীর তালিকায় আপনার নাম দেখতে হয়নি নিশাত আপা! আসলে বেচে থাকাটাই আকস্মিক! আপনাকে নিশ্চয়ই অনেক মিস করবো! ভালো থাকবেন!
থিয়েটার কর্মী বাকার বকুল লিখেছেন, ‘হাসেন নিশাত আপা হাসেন। অট্ট হাসিতে ফেটে পড়েন। চলেন দুজনে একসাথে হাসি। কিন্তু আমি এখন যা করি তাকে হাসির মতো দেখালেও তা হাসি নয়। কেননা হাসিতে চোখের কোনে নোনা জল জমে না। কিন্তু আমার তাই হয়। হাসিতে বুকের গহিনে চিন চিন ব্যথা করে না। আমার যে ব্যথা করে। হাসি আর কান্নার ভেদাভেদ আমি ভুলে গেছি নিশাত আপা। ভুলে যাই, ভুলে যাই সব, ভুলতে চেষ্টা করি। একখণ্ড বিভ্রান্ত থিয়েটার পল্লীর কথা, মধ্যরাত-অব্দি গলার রগ ফুলিয়ে থিয়েটার নিয়ে বাক-বিতণ্ডা। ভুলে যাই, ভুলে যাই সব, ভুলতে চেষ্টা করি। কেননা ভুলতে পারাই একমাত্র নিরাপদ ধর্ম।’
নাট্য নির্মাতা আবু হায়াত মাহমুদ: ‘ইশরাত নিশাত। আপা আপনি সত্যিই থিয়েটারপ্রান একজন যোদ্ধা ছিলেন। আপনার স্পষ্টবাদিতা আর অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা, নাট্যকর্মীদের জন্য অনুকরনীয়। ভালো থাকবেন ওপারে।’
রবিবার (১৯ জানুয়ারি) রাত ১১টার দিকে গুলশানে বোনের বাসায় হার্ট অ্যাটাকে বাথরুমে পড়ে যান ইশরাত নিশাত। দরজা ভেঙ্গে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ইশরাত নিশাত প্রয়াত অভিনেত্রী নাজমা আনোয়ারের কন্যা। তিনি ‘দেশ নাটক’ নাট্যদলের সাথে যুক্ত ছিলেন। মঞ্চে একাধারে অভিনেত্রী, নির্দেশক ও আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। তাঁর নির্দেশনায় ‘দেশ নাটক’ প্রযোজনা ‘অরক্ষিতা’ প্রশংসিত হয়।
অসংখ্য নাটক ও আবৃত্তি প্রযোজনার মঞ্চ ও আলোক নির্দেশকের কাজ করে সংস্কৃতি অঙ্গনে তিনি নিজেকে করে তুলেছেন অনন্য। পাশাপাশি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁর কণ্ঠ ছিল সব সময় সোচ্চার। নাসির উদ্দিন ইউসুফের ‘আলফা’ চলচ্চিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি।