চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘তুমি তো বাংলার রাজা’, আর ‘তকীয়ূল্লাহ হইল জেলের রাজা’

গবেষণামূলক ও সাক্ষাতকারভিত্তিক গ্রন্থ ‘ভাষা সংগ্রামীর বাংলাদেশ’ থেকে সংক্ষেপিত

ভাষা সংগ্রামী আবুল জামাল মুহাম্মদ তকীয়ূল্লাহ’র এই সাক্ষাতকার নিয়েছি ২০০৮ সালের ১৩ আগস্ট। উদ্দেশ্য ছিল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং এর বিচার প্রক্রিয়া বিষয়ে তার বক্তব্য জানা।

তারিকুল ইসলাম মাসুম: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আপনার সম্পর্ক, আপনার দেখা বঙ্গবন্ধু এবং তার হত্যা ও বিচার প্রক্রিয়া এই বিষয়গুলো আপনার কাছে জানতে চাই।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: আচ্ছা। শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমার যে প্রথম দেখা হয় ১৯৪৮ সালের প্রথমদিকে। পাকিস্তান হওয়ার পরে এখানকার ছাত্ররা বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমান, তোসাদ্দেক আহমেদ, তারপরে শহীদুল্লাহ কায়সার এরা একটা কর্মী সম্মেলনের আহ্বান করল। এটা মেইনলি মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের যারা ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান সোরাওয়ার্দী গ্রুপের কিন্ত আবুল হাশিম সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের, আমরাও সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের। আমিও মুসলিম লীগ করতাম সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের সাথেই। গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির সাথেও যোগাযোগ ছিল।

এটা ছিল পাকিস্তান পলিটিক্যাল ওয়ার্কারদের কর্মী সম্মেলন। এখানে খালি মুসলিম লীগের না, সেখানে অন্যান্য দলেরও ছাত্ররা ছিল। মেইনলি ছাত্ররা এবং যুবকরা ছিল। তো এই সম্মেলনে আমি তো বগুড়া থেকে আসছি। এইখানে শেখ মুজিবুরের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। বুঝলেন? তারপরে পরিচয়ের সূত্রে ইউনিভার্সিটিতে আমরা আন্দোলন করি। এরপরে তো আমরা একসাথে ভাষা আন্দোলন করলাম। ভাষা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে পরিচয়টা আরো গভীরতর হইল।

আমি তো ছাত্র ফেডারেশনে ছিলাম। কমিউনিস্ট পার্টির অর্গানাইজেশন ছাত্র ফেডারেশন। শেখ সাহেবরা ছিলেন মুসলিম ছাত্রলীগ। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে মুসলিম ছাত্রলীগ হইল। তো মুসলিম ছাত্রলীগ আর আমরা হইলাম ছাত্র ফেডারেশন, কিন্তু কাজ করতাম একভাবেই মিলে।
আবার মুসলিম লীগের আরেকটা ছাত্র অর্গানাইজেশন ছিল, ওটা নিখিল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, ওটা শাহ আজিজের।

ফোর্টি এইটের ভাষা আন্দোলন এক সাথে। ভাষা আন্দোলনের পরে তার সাথে যে ঘনিষ্ঠতা হইল, সেটা ফোর্টি নাইনে, ঢাকা ইউনিভার্সিটির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে। এটার নাম ছিল ‘বিয়ারার্স মুভমেন্ট’। ওদেরকে বিয়ারার বলে, বিয়ারার্স মুভমেন্ট। এই কর্মচারীদের আন্দোলনের সময় আমরা এই যে যারা বামপন্থী বিশেষ করে আমরা ছাত্ররা কর্মচারীদের সমর্থনে আন্দোলন শুরু করলাম। সে আন্দোলন বিরাট আন্দোলন। যে আন্দোলনের ফলে ইউনিভার্সিটিতে আমরা, আমরা মানে ছাত্ররা ধর্মঘট করে তালা মেরে দিলাম। আমরা বললাম যে, কর্মচারীদের দাবি না মানলে, আমরা ইউনিভার্সিটিতে যাব না।

ওয়ার্ল্ডে কিন্তু এরকম ঘটনা নাই যে কর্মচারীদের দাবিতে ছাত্ররা মুভমেন্ট করতেছে। ঐ সময়, কমিউনিস্ট পার্টির তো সদস্য কম। তো শেখ সাহেবের ছাত্রলীগ আর আমরা একসাথে কাজ করতেছি আর কি। এবং ঐ সময় ঘনিষ্ঠ হই। এই কাজের, এই মুভমেন্টর মধ্যে দিয়েই শেখ সাহেবের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। বুঝলেন?
তা ই মাসুম: জ্বি।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: আচ্ছা, এই মুভমেন্টর কারণেই ইউনিভার্সিটি থেকে আমরা ১৫ জন এক্সপেল হয়ে গেলাম। এই বিয়ারার্স মুভমেন্ট, এই ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। এই ১৫ জন অ্যারেস্ট হয়ে গেলাম! শেখ সাহেব জেলে চলে গেলেন। বুঝলেন? শেখ সাহবে আর আরো ছাত্র নেতারা গেল। কমিউনিস্ট পার্টি আমাকে বলল, আত্মগোপন কর। আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলাম।

এরপরে ফিফটি ওয়ানের শেষের দিকে আমি জেলে গেলাম। আমার নামে তো ওয়ারেন্ট বের হইছিল। ওয়ারেন্ট বের হওয়ার পরে ’৫০ সালে পাকিস্তান গভর্নমেন্ট আমাকে অ্যারেস্ট করার জন্য ৫ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। তখন ঐ ’৫০ সালে, ময়মনসিংহে কমিউনিস্টরা হাজং এলাকায় টঙ্ক প্রথা এবং জমিদার প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। সশস্ত্র সংগ্রাম। আর্মস স্ট্রাগল হচ্ছে ওখানে ময়মনসিংহে। যে জন্য আমার নামে পুরস্কার ঘোষণা। মনি সিং এর নামে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে।

আমার নামে হওয়ার কারণটা হচ্ছে এই, ঐ যে আমি তো পাকিস্তান হওয়ার আগে ব্রিটিশ মিলিটারি স্কুলে ছিলাম। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধের সময় মিলিটারি স্কুলে আমি ট্রেনিং নিছি ৪ মাস। তারপরে আমি ব্রিটিশ আর্মিতে যাই নাই। পাকিস্তান হওয়ার পরে ফোর্টি এইটে আমি আবার পাকিস্তান আর্মির একটা অঙ্গ সংগঠনে ছিলাম। তখন ফর্ম করছিল, পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডস। এই পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডের আর্মি ব্যাটালিয়ন সার্জন ছিলাম। ২১ নাম্বার ব্যাটালিয়ন ঢাকা। ব্যাটালিয়ন সার্জেন্ট মেজর। বুঝলেন, এখান থেকে আমি ট্রেনিং নিতাম। এবং এই সূত্রে আমি আবার ক্যান্টনমেন্টে আবার ৩ মাস ট্রেনিং নিছি।

ঐ সময় তো ভাষা আন্দোলন আরম্ভ হয় ফোর্টি এইটে। ফোর্টি নাইনে আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলাম। আর আর্মিতে তো আমি আর যাই নাই। আর্মি থেকেও তো আমি পলাতক হয়ে গেলাম। এই জন্য কিন্তু গভর্নমেন্টের ধারণা ছিল যে, আমি যেহেতু ওখানে গেরিলা ওয়ার্কার হচ্ছি।ওরা মনে করছে যে, আর্মির এই ট্রেনিং নিয়ে এখানে মিলিটারি অপারেশনে আমি যুক্ত।
এবং কিছুটা যে যুক্ত ছিলাম, এটা ঠিকই, হা হা হা।

আমি তখন ছিলাম ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫০ সালে। সেক্রেটারি হিসেবে এইখান থেকে আবার ঐ হাজং এলাকায় আর্মস অ্যান্ড অ্যামুনেশন পাঠাতাম। আমি তো জেলে গেলাম ফিফটি ওয়ানের শেষে। ’৫২ সালে শেখ সাহেব জেলে। ’৫১’র পরেই জেলে। ’৫১, ’৫২ ঐ জেলখানাতেই দেখা হতো। এক সেলে ছিলাম না। যখন নামাজ পড়তে যাইতাম তখন আমাদের সাথে নামাজের সূত্রে যোগাযোগ হইত। জেল খানায়ও গোপন যোগাযোগ হয়। জেলখানাতে নাইন্টিন ফিফটি ওয়ান ফিফটি টুতে গোপন যোগাযোগ। বুঝলেন?
তা ই মাসুম: জ্বি।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: ফিফটি ওয়ান ফিফটি টুতে জেলে কিন্তু শেখ সাহেব। জেল থেকে কবে বের হইছেন মনে নাই। তবে আমি বের হইছি ফিফটি ফাইভে। তো বঙ্গবন্ধুর সাথে ঐ জেলখানাতে ঐ যে দেখা, তারপরে আর হয় নাই। ফিফটি সিক্সে আওয়ামী লীগ গভর্নমেন্ট হইছে। বঙ্গবন্ধু ঐ সরকারে আছে। এই সময় তার সাথে আবার যোগাযোগ হয় এবং ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ঐ যে আপনাকে বলছিলাম যে, এর আগে, জেল পুলিশের একটা অ্যাসোসিয়েশন ফর্ম করে দিছিলাম। ইস্ট পাকিস্তান জেল পুলিশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। এই ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনে একবার শেখ সাহেব আসলেন একটা ব্যাপারে।

এর মধ্যে ফিফটি ফাইভ এর পরে সোহরাওয়ার্দী সাহেব ঢাকা আসলেন। উনি তখন ল’ মিনিস্টার। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ঢাকা আসলেন, এটা একটা ইম্পর্টেন্ট ঘটনা, আপনাকে বলছি। আওয়ামী লীগ ইলেকশন করছে। ফিফটি সিক্সে জেলখানা থেকেই সরদার ফজলুল করিম কমিউনিস্ট গণ-পরিষদের মেম্বার হইল। এটা একটা বিরাট ব্যাপার!
তা ই মাসুম: জ্বি।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: একজন রাজবন্দী গণ-পরিষদের মেম্বার হইল ফিফটি সিক্সে। গণ-পরিষদের মেম্বার হইয়া গেছে, তো এইটা একটা বিরাট ব্যাপার। তখন কিন্তু আওয়ামী মুসলিম লীগ।
তা ই মাসুম: জ্বি।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: আওয়ামী লীগ হয় নাই। আওয়ামী মুসলিম লীগ বুঝলেন?
তা ই মাসুম: জ্বি।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: তখন কমিউনিস্ট পার্টি ব্যান্ড। কমিউনিস্ট পার্টি চেষ্টা করছে যে, একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার তাদের। এর মধ্যে ফিফটি ওয়ানে তো কমিউনিস্ট পার্টি যুবলীগ ফর্ম করেছে। ফিফটি ফোরের ইলেকশনে যুবলীগের বিরাট ভূমিকা আছে। তো কমিউনিস্টদের এই ভূমিকাটা এটা আওয়ামী লীগের পক্ষে। তো কমিউনিস্টদের এই রোলটা তারা জানে। তো এই রোলের পরে, তখন শেখ সাহবের সাথে আমাদের যোগাযোগ। তো কমিউনিস্ট পার্টি হচ্ছে একটা গোপন পার্টি, তারা একটা প্ল্যাটফর্ম খুঁজতেছে। এই জন্য শেখ সাহেবের সাথে আমাদের আলাপ হইতেছে আরকি।

আলাপটা হইল এইভাবে যে, আমরা কমিউনিস্টরা আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে যদি আওয়ামী লীগ হয় তাইলে আমরা যোগ দিতে পারি। কমিউনিস্টদের পক্ষে একটা কমিউনাল অর্গানাইজেশনে জয়েন করা অসুবিধা। তো এই জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ওনাদের যোগাযোগ হইল। যোগাযোগের পরে পার্টির তরফ থেকে আমি গেলাম সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে আলাপ করার জন্য। শেখ সাহেব জানে এই ঘটনাটা। এবং শেখ সাহেব কিন্তু মুসলিম লীগ করলেও তার চিন্তাধারা সবসময় নন-কমিউনাল। নন-কমিউনাল চিন্তাধারা মুসলিম লীগ করছে। তো তখন সোহরাওয়ার্দী সাহেব আছেন সার্কিট হউজে। তো, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলাম আমি। বললেন যে কী ব্যাপার? তো শেখ সাহেব বসে আছেন। আবার অলি আহাদ আছে। অলি আহাদ কিন্তু আওয়ামী লীগ করত না।
তা ই মাসুম: যুবলীগ।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: যুবলীগ। যুবলীগের হিসেবে অলি আহাদ ওখানে আছে। যুবলীগের সাথে আবর শেখ সাহেবের ভাল অন্তরঙ্গতা। সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে বললাম, আমরা শুনলাম যে, আপনারা আওয়ামী লীগকে নন-কমিউনাল করতে চাচ্ছেন। সেই ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই। তিনি বললেন, আলাপটা কি? আমি বললাম, আলাপটা হল যদি আওয়ামী লীগ নন-কমিউনাল হয় তাইলে, আমরা কিছু কর্মী আছি, কিছু পলিটিক্যাল ওয়ার্কার, আমরা আওয়ামী লীগে জয়েন করব। তখন সোহরাওয়ার্দী সাহেব বললেন, তিনি উর্দু ভাষায় কথা বলতেন, উনি তো…।
তা ই মাসুম: বাংলা ভাল বলতে পারতেন না।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: উনি তো মেদিনিপুরের লোক, মেদিনিপুরের টানে বাংলা বলতেন। মেদিনিপুরের লোকদের মাদার টাং উর্দু। তো আমাকে বলছেন, আপনারা, কত লোক আছে আপনার দলে? আপনেরা জয়েন করলে আমাদের কি শক্তি বৃদ্ধি হবে? হা হা হা।
আমি বললাম যে, শেখ মুজিবুরকে জিজ্ঞেস করেন, ও জানে যে, আমরা জয়েন করলে কী রকম শক্তি হবে। তো শেখ সাহেব তার সাথে আলাপ করছে কি-না জানি না। নিশ্চয়ই আলাপ করছে না হলে কী আমাদের সাথে সোহরাওয়ার্দী সাহেরের ইন্টারভিউটা অ্যারেজমেন্ট করে দিছেন?
সোহরাওয়ার্দী সাহেব বললেন, ও… আপনি কমিউনিস্ট আছেন? হা হা হা। আমি বললাম, যে না, কমিউনিস্ট না। আমি তো এই ছাত্রদের ভিতর আছি।

তখনই সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে পরিচিত হইলাম। তো তার পরেই, শেখ সাহেবের উদ্যোগে আর কমিউনিস্ট পার্টির আলোচনার পরে আওয়ামী লীগ আগস্ট মাসে না সেপ্টেম্বর মাসের দিকে নন-কমিউনাল হয়ে গেল ফিফটি সিক্সে। ফিফটি এইটে তো আবার মার্শাল ল’ হয়ে গেল। তো, মার্শাল ল’র সময় এইটাও একটা ইম্পর্টেন্ট ব্যাপার। মার্শাল ল’ হওয়ার পরে ফিফটি এইটে তখন কোন রকম আন্দোলন করা সম্ভভ ছিল না। মার্শাল ল’ জিনিসটা কঠিন ব্যাপার! তখন, কমিউনিস্ট পার্টির মনি সিং, খোকা রায়, তারপরে শেখ মুজিবুর রহমান আরো ছিল কেউ কেউ, এদের সঙ্গে আমাদের গোপনে আলাপ হইত। যে, আমরা কীভাবে একটা মুভমেন্ট গড়ে তুলতে পারি? এগেইনেস্ট মার্শাল ল’ গভর্নমেন্ট। তো সেই সময় এই হিসেবে একটা সুযোগ হয়ে গেল। ৩০শে জানুয়ারি নাইন্টিন সিক্সটি টু।
তা ই মাসুম: জ্বি।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: সিক্সটিন জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী সাহেব এ্যরেস্ট হয়ে গেলেন। এই সূত্রেই আমরা একটা স্কোপ পেলাম। সিক্সটি টুতে সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি চাই। সোহরাওয়ার্দী তো একটা বিরাট ফিগার! সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির দাবিতে একটা আন্দোলন গড়ে তুললাম এবং তখন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের গোপন বৈঠক হতো। এবং শেখ সাহেবের সাথে এই পরিপ্রেক্ষিতেই আন্দোলন এবং এই আন্দোলনে কী হল?

যে এই ৬ ফেব্রুয়ারি নাইন্টিন সিক্সটি টু, যেটাকে এখন আমরা সিক্সটি টু’র আন্দোলন বলি। ছাত্র আন্দোলন, স্টুডেন্ট মুভমেন্ট, বাষট্টির মুভমেন্ট। ’৫৪’র পরে কিন্তু আর কোনো মুভমেন্ট গড়ে ওঠে নাই। ’৫৪’র পরে এই সিক্সটি টু’র মুভমেন্ট। তো, সিক্সটি টু’র মুভমেন্ট এই গোপন কমিউনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগের যোগাযোগ প্রচেষ্টায়। এই মুভমেন্টের পরে রাতের বেলায় ৫ তারিখ রাত্রে অ্যারেস্ট হইলাম। আমি তখন শ্বশুরের সঙ্গে থাকি বুঝলেন? কারণ আগের অভিজ্ঞতা আছে, আন্ডার গ্রাউন্ডে থাকার অভিজ্ঞতা আছে। তখন আন্ডার গ্রাউন্ডে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না, কারণ আমি বিয়ে করছি নাইন্টিন সিক্সটিতে।

তো যাইহোক, সকাল বেলা যখন গেলাম! আমি তো রেডি-টেডি হয়ে গেছি। যেয়ে দেখি, শেখ মুজিবুর রাহমান, মানিক মিয়া, কবির উদ্দিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সব লিডার। তাজউদ্দিন, শামসুজ্জোহা বুঝলেন এই রকম সব। সব আসতেছে একে একে। তো শেখ সাহেব তখন বলছে, আরে আমি তো সাভার দিয়া পালাইয়া চইলা যাইতেছিলাম! ধানমন্ডি দিয়া আমি যাইতে চাইছিলাম। আমি যাইতে পারলাম না। এর আগেই তো অ্যারেস্ট হইয়া গেলাম। বুঝলেন? এই হইল কথাবার্তা। অ্যারেস্ট হওয়ার পরে তো সিক্সটি টু’তে তার সাথে ইন্টিমেসিটা, ঐ জেলখানায় আছি ২৬ সেলে। জেলখানায় একটা সেল আছে, ২৬ সেল। ঐ ২৬ সেলে। ১৩টা সেল ছিল আরকি। ১৩টা আর ১৩টা দুই দিকে ২৬ সেল। ঐ ১৩টা সেলের মধ্যে আমরা ঐ বন্দীরা ছিলাম আরকি, বুঝলেন?
তা ই মাসুম: জ্বি।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: তো এটা ৬ ফেব্রুয়ারি। তারপরে রোজা আরম্ভ হল আপনার ১৬ তারিখের দিকে। এর মধ্যে একটা ঘটনা আপনাকে বলি, এটা খুব ইম্পর্টেন্ট ঘটনা। আমরা যারা বন্দীরা ছিলাম এদের মধ্যে বিভিন্ন দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হল। একেক জন, একেক কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। তো, জেল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে হলে কে কথা বলবে? তাজউদ্দিনের ওপর ভারটা দেয়া হল, যে তাজউদ্দিন কথা বলবে। তারপরে অন্যান্য যে, কিচেন। আমরা কিন্তু ঐ জেলের রান্না খেতাম না, আলাদা রান্না খেতাম। তো কিচেনের দায়িত্ব আবার একজনের।

আবার যোগাযোগের একটা ব্যাপার আছে জেলখানায়। জেলখানা থেকে দেখা যায় প্রতি সপ্তাহে আমরা চিঠি-টিঠি পাঠাতাম। ঐ চিঠি, একটা কাগজ দিয়ে দিত। ঐ কাগজগুলিতে চিঠি-টিঠি লিখলে পৌঁছে দেয়া হতো জেল অফিসে। তো এই গুলি কালেক্ট করার দায়িত্ব একজনের থাকত। জেল কর্তৃপক্ষের সাথে কমিউনিকেশন।এই সময় এই যখন আমরা কাজের ভাগ করতেছি,
তখন আবুল মনসুরের নাম শুনছেন তো? আওয়ামী লীগের ঐ যে সাহিত্যিক। আবুল মনসুর খুব রসিক লোক, তো, এই কথাটা খুব ইম্পর্টেন্ট। আমি আজকে এ কথাটা আপনাকে বলি।
তখন আবুল মনসুর বলছে, এটা ১৯৬২ সালের ৭, ৮ বা ১০ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। আবুল মনসুর বলছে, ‘মুজিব, তুমি তো বাংলার রাজা’ একটা খুব ইম্পর্টেন্ট উক্তি। ১৯৬২ সালে শেখ সাহেবের পজিশন কী রকম ছিল? যে, ‘তুমি তো বাংলার রাজা’, আর ‘তকীয়ূল্লাহ হইল জেলের রাজা’।

ভাষা সংগ্রামী তকীয়ূল্লাহ’র ক্যামেরায় তোলা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, সাথে আরো অনেকে

তো এক কাজ কর, তকিউল্লাহ’রে যোগাযোগের দায়িত্বটা দাও। যোগাযোগের দায়িত্বটা তকিউল্লাহ’র। ওপেন যোগাযোগ! আর গোপন যোগাযোগও তো আছেই।
আমি যে বলছিলাম, আমি ঐ যে, জেল পুলিশের অ্যাসোসিয়েশনটা ফর্ম করে দিয়েছিলাম। এই জন্য জেল পুলিশরা কিন্তু আমাকে খুবই সমীহ করতো। তো এইখানে শেখের সাথে আমার ইন্টিমেসিটা আরো বাড়ল আর কি। কেননা আমরা তো অন্য পার্টির লোক বাইরে। কিন্তু জেলখানাতে এক জায়গায় থাকাতেই এটা কমিউনিকেট করা, আমাদের চিন্তাধারা, দেশের মুক্তির কথা বলা, যে কীভাবে? তো শেখ সাহেবের সাথে আমার ইন্টিমেসিটা এখানে বাড়ে।
শেখ সাহেব আমাকে তকীয়ূল্লাহ’ই বলতেন। আমাকে তুমি করে বলতেন না, আপনি করেই বলতেন। তকীয়ূল্লাহ সা’ব তকীয়ূল্লাহ সাহেবও অনেক সময় বলতেন।

তিনি একদিন বললেন, শোনেন, আপনি এক কাজ করেন, আমারে, এই গেরিলা ওয়ার যে করতেন আপনার কমিউনিস্টরা? গেরিলা যুদ্ধটা তো আমি মনে করি যে, এই বন্যার দিনে বর্ষকালে, আমরা তো গেরিলা যুদ্ধ করতে পারি? গেরিলা ওয়ার সম্বন্ধে আমার একটু পড়াশুনা করা দরকার। তো আমারে একটা আপনি, কমিউনিস্টরা তো গেরিলা ওয়ার করে গেরিলা ওয়ার সম্পর্কে একটা বই আমাকে যোগাড় করে দেন। বুঝলেন?

তো আমিও চেষ্টায় ছিলাম কিন্তু এর আগে তো আমি ট্রান্সফার হয়ে গেছি। জেলখানা থেকে আমাকে অন্য জয়গায় ট্রান্সফার করে দিছে। সেই জন্য আমার আর ঐ বই দেওয়া হয় নাই। তার সাথে অন্যান্য পলিটিক্যাল ব্যাপারে আলোচনা হইতো। আমি তখন তার পলিটিক্যাল থট সম্পর্কে জানতে পারি। তো আপনাকে একটা ঘটনার কথা বলি, মজার ঘটনা। আওয়ামী লীগের সাপোর্টার কিন্তু তখন বিরাট! কালু শেঠ বলে একটা লোক ছিল, পাসপোর্ট রিক্রুটিং করতো। বংশাল, আপনার মালিটোলার কালু শেঠ। ওর নাম হল শামসুদ্দিন। এই কালু শেঠের গাঁজা খাওয়ার অভ্যাস ছিল। সে কিন্তু আওয়ামী লীগের বড় সাপোর্টার। সিক্সটি টু’র মুভমেন্টে অ্যারেস্ট হয়, তাকেও ঐ সেলে নিয়া আসছিল ২৬ সেলে। বুঝলেন?
তা ই মাসুম: জ্বি।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: তো, শেখ সাহেব আমাকে বললেন, তকীয়ূল্লাহ সাব, কালু শেঠ তো গাঁজা খায়! হা হা হা। তো, ওরে একটু গাঁজার ব্যবস্থা কইরা দ্যান, হা হা হা। বুঝলেন?
তা ই মাসুম: জ্বি।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: শেখ সাহেব কিন্তু খুব আন্তরিক লোক। শেখ সাহেবের একটা বড় গুণ হল, এই লোক এমন আন্তরিক, আপনার কর্মীদের সম্পর্কে তার এই একটা বড় গুণ, যে রকম সাহসী সেই রকম হইল আন্তরিক। যেকোন কর্মীকে দেখেন উনি মনে রাখতেন। কারো চেহারা দেখলেই নাম মনে পড়ত। কর্মীরা তার কাছে গেলে বলত, মুজিব ভাই ৫টা টাকা দেন না?
তখন পকেট থেকে বের করে ঠিক এই রকম দিয়া দিতেন। কর্মীদের সম্পর্কে খুব আন্তরিক। আবার সহসীও।
তা ই মাসুম: জ্বি।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: একটা ভুখ মিছিল হইছিল ফিফটি সিক্সে আওয়ামী লীগ পাওয়ারে আসার আগে। ভুখ মিছিল আপনার এই চকবাজার থেকে পাটুয়াটুলী দিয়ে ঐ কোর্টে যাবে। বাংলাবাজারে আমাদের রেনেঁসা প্রিন্টার্স আছে। ১০ নাম্বার নর্থব্রুক হল রোডে। ঐ রেনেঁসা প্রিন্টার্সে আমি তখন ম্যানেজারি করি। প্রেসে আমি ফুল টাইম থাকি আর আমার এইটা কাভারিং আর কি! ঐ দেখানোর জন্য যে আমি কাজ করি। বুঝছেন?
তা ই মাসুম: জ্বি।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: শেখ সাহেব তখন কী করেন? ইনি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করেন। হারুন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। তো আমার সঙ্গে যোগাযোগ হইতো। এই ঘটনাটা খুব ইম্পর্টেন্ট ওনার সম্পর্কে। আওয়ামী লীগের যে মিছিল যে বের হয় ভুখ মিছিল। এই ভুখ মিছিলের ওপরে পাটুয়াটুলীর দিকে আসার আগেই গুলি হইল। তো একটা ডেড বডি। এই ডেড বডি নিয়া তখন মিছিল বের হইছে। ডেড বডি নিয়া মিছিল আসতেছে। এই মছিলের খবরটা যখন আমি পেলাম, আমি তখন প্রেসে। মিছিল ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে কোর্টে যাওয়ার যে রাস্তাটা ওখান দিয়ে আসবে। আমি প্রেস থেকে বের হয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কের ওখানে এসে দাঁড়ালাম।
শেখ মুবিজুর রহমানের এই একটা ফিলার আমি দেখছি। গুলি খাওয়া ঐ লোকের ডেড বডি নিয়া শেখ মুজিবুর রহমান আসতেছে তার পরনে কালো শেরওয়ানি, আলীগড়ি কালো শর্ট শেরওয়ানি। মিছিলে ডেড বডি নিয়া একজন আসতেছে। খুব সাহসী, খুব সাহসী লোক। তার কোনো ভয় নাই। এই জন্যই আমি বলি খুব সাহসী লোক। তো যাই হোক, এই ঘটনাটা বললাম কথা উঠল বলে।
তা ই মাসুম: কালু শেঠের ঐ ব্যবস্থা করে দিছিলেন?
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: হ্যাঁ, করে দিছিলাম! ওদের সাথে আমি মাসখানেক ছিলাম। এরপর করল কি জেল পুলিশ, জেলার আমাকে নিয়া গেল একটা সেগ্রিগেটেড সেলে। সেখানে আমি পেলাম প্যাট্রন ৪ জনকে। সত্যেন সেন, নাম শুনছেন বোধ হয়। এই যে, সাহিত্যিক সত্যেন সেন। শহীদুল্লাহ কায়সার। শহীদুল্লাহ কায়সার আমার পাশেই থাকত। আর নগেন সরকার বলে এক কৃষক নেতা ময়মনসিংহের। এই তিনজন আর আমাকে নিয়া ৪ জন। তখন এই শহীদুল্লাহ কায়সার সংসপ্তক লিখতেছে। আমার পাশেই থাকতো। আমাকে তকী, তকী বলত।
তকী শোনো, স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনাতো।

ঐদিকে সত্যেন সেনও তখন অবরুদ্ধ কাহিনী নামে একটা বই লিখতেছেন। ঐ একটা আন্দোলনের ওপর। আমি খুবই অসুস্থ হয়ে গেলাম। আমার অবস্থা এমন হয়ে গেল যে, আমার চোখগুলি একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আমার রক্ত শূন্যতা হয়ে গেল। কিছু খেতে পারি না, খালি বমি হয় টেনশনে। তো পরে আমাকে জেল হাসপাতালে ভর্তি করা হইল। তো এখানে আবার শেখ সাহেবের সাথে আমার যোগাযোগ হয়। ফেব্রুয়ারিতে জেলে এসেছি, তো এটা মার্চ-এপ্রিলের ঘটনা। মার্চ-এপ্রিল বা মে মাস। আমি তো হসপিটালে অবস্থা একেবারে কাহিল।

তো আমার বাবা আমার জন্য চেষ্টা করতেছেন, আমার রিলিজের ব্যাপারে। কিন্তু গভর্নমেন্ট বলে যে, হি ইজ ডেঞ্জারাস ম্যান! আজিজ আহমেদ, হি ইজ দ্য সেক্রেটারি, বাবাকে বলতেছে হি ইজ দ্য লিডার, হি ইজ দ্য প্রেসিডেন্ট অব জেল পুলিশ। বিকজ, ওকে ছাড়া যাবে না। হা হা হা। ও ডেইঞ্জারাস কমিউনিস্ট নেতা, ওকে ছাড়া যাবে না। বাবা তখন অপারগ, কী করবেন?
তো, এর মধ্যে ঘটনা বলি, এই সময় শেখ সাহেবের সাথে আমার দেখা হইতো। ঐ যে, উনি মাঝে মাঝে হসপিটালে আসতেন। অনেক সময় হসপিটালে আসলে যোগাযোগের সুবিধা হয়। তো, হসপিটালে আসতেন, তখন কথা-বার্তা হইতো। বিভিন্ন আন্দোলন সম্পর্কে ওনার সাথে আলোচনা হইতো। এবং ওই বাইরের যে কমিউনিকেশনটা আমি ঐ হসপিটাল থেকেই কমিউনিকেট করতাম।

তো শেখ সাহেব তখন আমাকে দেখলেন, আমি তো হসপিটালে হতাশ হয়ে গেছি।
এসময় আমি বলি, ওনার যে ব্রেইন, বললেন যে, তকীয়ূল্লাহ, আপনি তো একটা কমিউনিস্ট? কমিউনিস্ট হয়ে আপনি এরকম ইয়ে (হতাশ) হয়ে গেলেন কেন? হতাশ কেন? হা হা হা।
কয়দিন মার্শাল ল’ থাকবে? কয়েকদিন পর দেখবেন মার্শাল ল’ আর থাকবে না। কয়দিন আমাদের আটকাইয়া রাখবে? এরা আমাদের ছাড়তে বাধ্য হবে। এবং রিয়ালি জুন মাস জুলাই মাসের মধ্যে সবাইরে জেল থেকে ছেড়ে দিল। জুলাই মাসের মধ্যেই সব রিলিজ হয়ে গেল। বুঝলেন?
তা ই মাসুম: জ্বি।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: তো যে ঘটনাটি বললাম, শেখ সাহেবের মধ্যে আমি এই জিনিসটা দেখেছি। এই সময় তার সাথে আমার অন্তরঙ্গতা হইছিল এবং তখনই তারে দেখলাম যে, পলিটিক্যাল কো অপারেশন যেটা, পলিটিক্যাল ফিলোসফি, তখন তার ফিলোসফিটা দেখলাম। এর আগে কিন্তু ফিলোসফি না, কর্মী ছিল। কিন্তু এই জেলের ইসের পরে তার ফিলোসফিটা দেখলাম।

তো, আর কি শুনতে চান? সোহরাওয়ার্দী সাহের রিলিজ হলেন সিক্সটি টু’তে।
সোহরাওয়ার্দী সাহেব রিলিজ হইয়াই কিন্তু ট্যুরে বের হইছিলেন। অল বেঙ্গল ট্যুর। বাংলাদেশে ট্যুরে বেরিয়েছিলেন। তো জামালপুরে ডিসেম্বর মাসে আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের একটা ছবি তুলছিলাম। সিক্সটি টু’র ডিসেম্বর। এটা খুব ইম্পর্টেন্ট ছবি আমাদের জীবনে। যে, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ঐ ছবি জামালপুর রেলওয়ে স্টেশনে উনি, দেখার জন্য সব লোকজন রইছে আর আমি স্ন্যাপটা নিলাম। এইটাই সোহরাওয়ার্দী সাহেবের জীবনের শেষ ছবি বলা যেতে পারে।

সিক্সটি টু’র পরে আমার কিন্তু আর দেখা হয় নাই শেখ সাহেবের সাথে। এরপরে হইল কি তাজউদ্দিন বের হইল। আমি তো জেল থেকে বের হইলাম জুন মাসের দিকে। তাজউদ্দিন আর শেখ সাহেবরা বের হইল ঐ জুলাই মাসের দিকে। আমি তো জেল থেকে বের হয়ে রেডক্রসে জয়েন করলাম। আমাকে তো আর কোথাও জয়েন করতে দেয় না। কোনো উপায় নাই, আমি কমিউনিস্ট, আমাকে চাকরি দিবে কে?

তো, একটা জুট মিল ছিল, ইউনাইটেড জুট মিল নরসিংদী। এই ইউনাইটেড জুট মিলের যে মালিক ছিল, সে পাঞ্জাবী। ওই পাঞ্জাবী মিলে উনি ইন্ডেন্টিং করতেন। উনি আমার সাথে যোগাযোগ করলেন। উনি বললেন, ওইখানে মাহবুবুল হক সাহেব আছেন, ওই আপনার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেই, তো মাহবুবুল হক সাহবের একটা দক্ষ অফিসার দরকার। মিলটা তখনো হয় নাই, কাজ হচ্ছে আরকি। তো, ওইখানে একজন অফিসার হিসেবে আমি জয়েন করলাম ঐ নরসিংদীতে।

তো পার্টির সাথে যোগাযোগ হইল, তাজউদ্দিন জেল থেকে বের হইল। তাজউদ্দিনের কোন কাজ নাই। তো তাজউদ্দিনকেও আমি একটা অ্যারেজমেন্ট করে দিলাম ঐ মাহবুবুল হক সাহেবের ওখানে। ওনার একটা সেক্রেটারি দরকার। তাজউদ্দিনরে বললাম, তুমি সেক্রেটারি হিসেবে আস। তাজউদ্দিনের সাথে কিন্তু আমার খুব ইন্টমেসি ছিল। তো তাজউদ্দিন আসল।
আমি জয়েন করার পরে মাহবুবুল হক সাহেব যখন আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিলেন জানুয়ারি মাসে, তখন তাউদ্দিনেরও যাওয়ার কথা।

ডাকলেন, তো তাজউদ্দিনরে বললাম, চলো। তাজউদ্দিন বলল যে, না আমি চাকরি করব না। আপনি যান। আপনার কাজ হবে পশ্চিমারা কীভাবে এখানে জুট ইন্ডাস্ট্রি করছে, জুট বিসনেস করছে এই সেক্রেটটা আপনাকে জানতে হবে। এই সেক্রেটটা আমাদের বাঙালিদের জানা প্রয়োজন। এইটাই আপনার পলিটিক্যাল ওয়ার্ক। বুঝলেন? এইটা হইল, বঙ্গবন্ধুরও এইটা চাওয়া। তাজউদ্দিন আর বঙ্গবন্ধুতো একই।

বলল, এইটা হইল আপনার পলিটিক্যাল কাজ। এইভাবে কাজ করেন। তো এইভাবে সিক্সটি থ্রি থেকে আমার আর বঙ্গবন্ধুৃর সাথে আর দেখা হয় নাই। বুঝছেন? তো সিক্সটি থ্রি’র ডিসেম্বরে তো সোহরাওয়ার্দী সাহেব মারা গেলেন। ফিফথ ডিসেম্বর নাইন্টিন সিক্সটি থ্রি। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কবর কোথায় হবে যখন ঠিক হইল। এই জায়গায় হইল শেখ সাহেবের সাথে আমার আরেকবার দেখা। তখন ঠিক হইল কবরটা হবে, তখন শেরে বাংলার কবর হইছে আপনার ঐ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আর কারো কবর নাই ওখানে। শেরে বাংলার কবর হইছে আগে, বুঝলেন, ফিফটি নাইনে।

তো শেখ সাহেবের সাথে এই নিয়ে আলোচনা হইল। যে, কবরটা এখানেই হওয়া দরকার। তো এই হইল, শেখ সাহেবের একটা দূরদৃষ্টি যেই কারণে আমি জানি না। তো আমরা ওখানে আলোচনা করলাম, ওনার কবরটা শেরে বাংলার পাশেই দিব। বুঝলেন?
তা ই মাসুম: জ্বি।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: তো শেখ সাহেব ওইটাতে রাজি ছিলেন না। বলছেন যে, না সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কবর ওনার পাশে হবে কেন? ঐখানে ফাঁকা রাইখা দূরে করেন।
উনি চাচ্ছিল যে, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ওপর একটা স্মৃতি সৌধ হবে। এই রকম ধরনের মনে একটা চিন্তা ছিল। যে কারণেই হোক। যে, সোহরাওয়ার্দীর ওখানে একটা স্মৃতি সৌধ হবে। সুতরাং কবরটা’র মাঝে ফাঁক থাকবে। যাতে শেরে বাংলার একটা স্মৃতি সৌধ, সোহরাওয়ার্দীরও একটা স্মৃতি সৌধ আলাদা হইতে পারে।

শেখ কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর খুব ভক্ত ছিল। সোহরাওয়ার্দীর এত ভক্ত ছিলেন! সে সবসময় বলত ‘মাই লিডার’। সব কথায় বলত শেখ সাহেব, ‘মাই লিডার’। এবং ঐ যে যে কথাটা আমি আগে বলেছি আপনাকে। যে, সোহরাওয়ার্দীর যে সে ডেজিগনেট! ঐ যে আবুল মনসুরের যে কথাটা সিক্সটি টু’তেই উনি শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর স্থলাভিসিক্ত হয়ে গেছিলেন। ঐ যে আমাদের মধ্যে যে কথাটা (জেলখানায়)। ‘তুমি হইলা বাংলার রাজা’, এই কথাটা আমি পরে ফিল করছি। আমি, তখন তো আমার মধ্যে আসে নাই। কিন্তু আমি পরে, সোহরাওয়ার্দী মারা যাওয়ার পরে ফিল করছি এইটা। যে, শেখের পজিশন নাইন্টিন সিক্সটি টু’তেই উনি ইয়ে আইসা গেছেন বাংলার। বাংলার একচ্ছত্র নেতা উনি এসে গেছেন।

সিক্সটি টু, থ্রি, সিক্সটি সিক্সেও আমাদের মোটামুটি যোগাযোগ ছিল। তখন ৬ দফা। ৬ দফার পরে তো উনি আবার অ্যারেস্ট হইয়া গেলেন। তারপরে আগরতলা, অ্যারেস্ট। তো এই সময় গোপনে খবর রাখতাম আরকি। আমি ডাইরেক্ট পলিটিক্স করতাম না। গোপন যোগাযোগ মানে তাজউদ্দিনের মারফত এর মারফত ওর মারফত খবর পেতাম। শেখ সাহেব কেমন আছেন।
আচ্ছা, এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সাথে যেটা, একটা আরেকটা জিনিস বলে রাখি, এ হলো সিক্সটি নাইন, তারপরে সিক্সটি নাইনের মুভমেন্ট, তারপরে সেভেন্টি, সেভেন্টি ওয়ান।

তো সেভেন্টি ওয়ানের এই মুভমেন্টের পরে এটা হইল বিরাট ব্যাপার! এইটাতে তাকে যাইয়া দেখছি আর কি। সেভেন্টি ওয়ানের পরে তো আপনার সেভেন্টি থ্রি। এর মধ্যে আমার সাথে আর দেখা হয় নাই। আচ্ছা, তো আমি তো ঢাকা জুট মিলে আছি। তো আমি উনি আসার পরে, বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি ছিল বাহাউদ্দিন চৌধুরী। বুঝলেন? ঐ বরিশালের বাহাউদ্দিন চৌধুরী। তো বাহাউদ্দিন বলল যে, মুজিব ভাই তো আপনারে খবর দিছে। বলল যে ত্বকী ভাই আপনি দেখা করেন। উনি আসছেন, সবাইতো তার সাথে দেখা করল, আপনি যান না কেন? বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনি দেখা করেন।

আমি বললাম, ভাই, আমি তো দেশের কাজই করতেছি। জুট মিলে কাজ করছি, জুট মিলের উন্নতির চেষ্টা করছি। এই মিলকে উন্নত করাই হইল আমার দেশের কাজ। আমার তো শেখ সাহেবের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নাই। হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুকে আমার সালাম দিবেন। তো, ঐ সময় শেখ সাহেব, আমি বলি যেটা, বঙ্গবন্ধুর যে আউট লুক! যে হিসেবে উনি বাংলাদেশের যে, সেভেন্টি ওয়ানে স্লোগান অব দ্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এটা কিন্তু আপনি লক্ষ্য করবেন, আওয়ামী লীগের যে তখনকার স্লোগান, সেই স্লোগানে ছিল সমাজতন্ত্রের কথা। সমাজতন্ত্রের কথা বলছে যে, দেশে সমাজতন্ত্র এবং শোষণের অবসান।

এই যে স্লোগান, এই প্ররিপ্রেক্ষিতেই যে, এই লাইনেই উনি দেখা গেল যে, এসেই যে প্রোগামটা নিলেন, সে প্রোগ্রামটা কী? জুট মিল ন্যাশনালাইজ। বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি ন্যাশনালাইজ।
কো অপারেটিভস, হ্যাঁ, কো অপারেটিভস। জমির শিলিং বেঁধে দিলেন। জমির শিলিং বেঁধে দিলেন যে, ২৫ বিঘার ওপরে কোনো জমি থাকবে না। তারপরে, এই যে কৃষকদের, চাষীদের মধ্যে কো অপারেটিভ এর মাধ্যমে জমি বিতরণ।

এই যে, তার প্রোগ্রাম, যে প্রোগ্রামটা ছিল আসলে ঐ যুক্তফ্রন্টের আমলে যে একুশ দফা প্রোগ্রাম সেই প্রোগ্রাম। শেরে বাংলা ফজলুল হক, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী’র যে প্রোগ্রাম। এই একুশ দফার একুশ দফা, এই একুশ দফারই রূপায়ণ হচ্ছিল, সেই রূপায়ণ তো আর হয় নাই? কারণ যুক্তফ্রন্ট গভর্নমেন্ট ’৫৪ সালে কয়দিনের জন্য, দেড় মাস পরই তো ভেঙে দিছে। তার মানে তো ওটা হয় নাই?

এর মধ্যে ষড়যন্ত্রের ফলে পশ্চিমাদের, আওয়ামী লীগ গভর্নমেন্টও তখন ঐ যে যুক্তফ্রন্টের প্রোগ্রাম করতে পারেন নাই? তো, এই যুক্তফ্রন্টের যে প্রোগ্রাম, এই প্রোগ্রামটা স্বাধীনতার পরে শেখ মুজিবুর রহমান এসেই আবার সেইটাকে ইমপ্লিমেন্ট হতে যাচ্ছিল। বুঝলেন?
তা ই মাসুম: জ্বি।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: যেটা আমি বলছি, এই যে স্বাধীনতার পরে যেটা ইমপ্লিমেন্ট হতে যাচ্ছিল। শেখ সাহেবের এই প্রোগ্রাম নিয়াই উনি আগাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলদের এইটা পছন্দ হয় নাই। যেই জন্য আমি মনে করি যে, বঙ্গবন্ধুকে তারা হত্যা করে দিয়ে, আমাদের এই প্রগ্রেসটাকে তারা বন্ধ করে দিছে। এরপর আর কিছু? তো, আপনি আরো কিছু জানতে চান না কি?
তা ই মাসুম: ওনার সাথে আপনার কি আর যোগাযোগই হয় নি?
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: ওনার সাথে আর যোগাযোগে আমি যাই নাই। সেভেন্টি টু’তে উনি তো আসলেন জানুয়ারি মাসে। ১০ জানুয়ারি উনি আসলেন। পয়লা একুশে ফেব্রুয়ারি, পয়লা একুশে ফেব্রুয়ারি হবে। তো আমরা তখন এটা নিয়া প্রশ্ন তুললাম। এটা নিয়া আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পক্ষের, আমরা তো সবাই স্বাধীনতার পক্ষের লোক। এর মধ্যে আসল যে, আমরা ৮ই ফাল্গুন পালন করব।

আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি করব কেন? আমরা বাংলা তারিখ অনুয়ায়ী এ দিবসটা পালন করব। তো বঙ্গবন্ধু, তারপরে আতাউর রহমান খান, উনি তো প্রধান, সবাই আসতেছে বলতেছে, এটা তো ঠিক কথা। কিন্তু, দুইটা ভাগ হয়ে গেল। একদল আসল যে একুশে ফেব্রুয়ারি, এই যে, একুশের গান, একুশের কবিতা, সুতরাং আমরা একুশে বাদ দিব কিভাবে? এটা তো আমরা বাদ দিতে পারি না।

আবার, আমাদের বাংলা তারিখও রাখা দরকার। তো তখন এই সময়, আমাকে বলল যে, এটার সলিউশনটা কি? তখন আমি চিন্তা করে দেখলাম, ঐ সময় থেকেই কিন্তু আমি এই কাজটা করি। এইটাও একটা ইম্পর্টেন্ট কাজ। এই কাজটা হল আপনার যে, ৮ই ফাল্গুন আর ২১শে ফেব্রুয়ারি একই দিনে ফেলা যায় কি না? এই সেভেন্টি টু থেকেই এই কাজটা আমি আরম্ভ করি। এবং এইটা পরে নাইন্টি ওয়ানে আইসা মিলালাম আর কি।

যাইহোক এখন শেখ সাহেবের সাথে যে ঘটনাটা বলতেছি। ঐ যে মিলের যে কাজগুলি, মিলের যে কাজ করতেছি, উনি ইচ্ছা এবং এইটাতে আমরা পক্ষে আছি। এখন ওনার যে প্রোগ্রাম, ওনার প্রোগ্রামটাকে আমরা ফুল সাপোর্ট করছি। ওনারা আওয়ামী লীগের, ওনার কিন্তু অ্যাডভাইজার ছিল সারোয়ার, ঐ যে নারায়ণগঞ্জের। সারোয়ার কিন্তু এই সব ব্যাপারে জড়িত ছিল, সাংস্কৃতিক এই সব। তো এই সবে আমার সাথে সারোয়ারের মারফত যোগাযোগ হইত। আমার সাথে কিন্তু ডাইরেক্ট কোন যোগাযোগ ছিল না। তো শেখ সাহেবের সাথে ডাইরেক্ট যোগাযোগ ছিল না, কিন্তু সাপোর্ট করি, কমিউনিস্ট পার্টি ওনার পক্ষে।

ঐ যে বাকশাল, বাকশালকেও আমরা সাপোর্ট দিছি। কমিউনিস্ট পার্টি বাকশালকে সাপোর্ট দিছি। যে এখন দেশে, আমরা দেশ স্বাধীন করছি এখন আবার দল কী? এখন দলের দরকার কী? এখন আমরা দেশ গড়ব এখন সবাই এক দল হও। এইটাকে কিন্তু আমরা সাপোর্ট করছি। এটা কোনো শেখ সাহেবের স্বৈরাচারী ব্যাপার না।

অনেকে বলছে, অনেকে বলছে যে, উনি স্বৈরাচারী হয়ে সবই করে দিলেন। সব দলগুলোকে বন্ধ করে বাকশাল করলেন। কিন্তু আমি মনে করি যে, বাকশাল ওয়াজ রাইট ফর্ম। উনি এই যে দেশকে ভালবাসতেন, দেশকে নিয়ে চিন্তা করতেন, তারই বড় প্রমাণ যে দেশের সেবা করতে হবে। তো এখন দলাদলি কেন? এখন কোন দলাদলি নাই? এখন দেশের সেবা করব সবাই মিল্যা, এখন সবাই আমাদের একই নীতি।

১৭ মার্চ ১৯৭৩, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুকে লেখা তকীয়ূল্লার চিঠি

আমরা ঐ যে একুশ দফার মূল বাস্তবায়ন, যেগুলি আমাদের পথ এগুলি আমরা বাস্তবায়ন করব। আর আওয়ামী লীগের যে প্রোগ্রাম, যেটা ইলেকশনের প্রোগ্রাম সেটা আমরা বাস্তবায়ন করব, একসাথে। সুতরাং দলাদলি করার কোন দরকার নাই। এই জন্য যাই হোক, ওনার এই প্রোগ্রামকে সাপোর্ট করার পরে, আমি ওনার প্রথম জন্ম দিবসে ১৭ মার্চ, সেভেন্টিনথ মার্চ নাইন্টিন সেভেন্টি থ্রি, ওনাকে একটা চিঠি লিখলাম। এটা আপনি দেখবেন, আপনাকে দেখাবো।
ঐ চিঠিতে আমি লিখলাম যে, মুজিব ভাই, আমি তো মুজিব ভাইই বলতাম। ছোট্ট একটা চিঠি,
মুজিব ভাই, আপনি ই হইছেন, দেশের কর্মে আপনাকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন। আল্লাহ আপনাকে হায়াৎ দারাজ করুক। আপনার শুভ কামনা করি। এই ভাবে একটা লিখলাম। বুঝলেন?

শদ্ধাষ্পদেষু ,
মুজিব ভাই, দেশ গড়ার সংগ্রামে জনতার আশীর্বাদ ও ভালবাসার অর্ঘ্যডালা আপনার জীবনের এই নতুন দিনের যাত্রাপথকে সুন্দর ও উজ্জ্বল করে তুলুক আজ আপনার শুভ জন্মদিনে এই কামনা করি। সোনার বাংলা গড়ার কাজে আপনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ তা’লা আপনাকে সুস্থ দীর্ঘায়ু দান করুন।

১৭ই মার্চ ১৯৭৩ ইং ভবদীয়
তকীয়ূল্লাহ।

উনি আবার, উত্তর দিলেন। যে, আমাদের সহযোগিতা চেয়ে। আপনারা আমাকে দেশ গড়ার কাজে সহযোগিতা করবেন। এইটাই আপনাদের কাছে আমার চাওয়া। বুঝলেন? এইভাবে উনি আমাকে একটা চিঠি দিলেন। তো আপনি এই চিঠিটা আপনি নিয়ে যেয়েন। দেখাবো আপনাকে।

 

প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়,
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ঢাকা।
নং পি এম এসÑ৩৯/ ৭২ ১৫৭৫/৯৬৬ তারিখ ২৪/৪/ ৭৩

জনাব তকীউল্লাহ্,
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আদেশক্রমে আপনাকে জানচ্ছি যে, জন্মদিন উপলক্ষে আপনার লেখা শুভেচ্ছাবানী তিনি পেয়েছেন। আপনিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা ও প্রীতি গ্রহন করুন।
তিনি কামনা করেন যেন আপনাদের প্রাণভরা ভালবাসা তাঁর চলার পথে পাথেয় হয়ে থাকে এবং আপনাদের ঐকান্তিক সহযোগিতায় তিনি যেন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপের উপর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারেন।

তকীয়ূল্লাহকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে লেখা চিঠি

তা ই মাসুম: আর ওনার মৃত্যুর পর কী হলো? ওনার মৃত্যুর দিনে ঘটনার বর্ণনা দিতে পারবেন? ঐদিন আপনি কোথায় ছিলেন?
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: মৃত্যুর সময় যেটা। এটা আপনাকে আমি কী বলব, শোনেন। এটা, ওনার সাথে তার সেভেন্টি থ্রিতে গেল যোগাযোগ। তো এখন হচ্ছে কী? যেটা আমি বলি, সেভেন্টি ফাইভের এই যে ঘটনাটা! এটাতে আমি কী বলব? এটা আমি যখন রাতের বেলা শুনলাম! মানে আমি তো আনন্দবাজারে। রাতের বেলা বলে যে, এই রকম ঘটনা। যে এই রকম টেলিভিশনে দেখেছে। এটার পরে আমার খুব….মনটা মানে, কী বলে যে আমি বোঝাবো আপনাকে?

আমি এরপরে বহুদিন, শেখকে স্বপ্ন দেখতাম। বহুদিন, এখনো মাঝে মাঝে দেখি। কিন্তু তখন দেখতাম। বঙ্গবন্ধুর সাথে যাই, ওমুক জায়গায় যাই, তমুক জায়গায় যাই। কিন্তু প্র্যাক্টিক্যালি তার সাথে কিন্তু আমার এই রকম ছিল না। রাজনীতির ব্যাপারে তার কাছে যাওয়া আসা এরকম ছিল না। কিন্তু স্বপ্নে বহুদিন আমি তাকে দেখেছি। এটা মনের ব্যাপার, মনের ফিলিংস থেকে।

তো এখন যেটা আমি মনে করি আর কি, যেটা বলতে চাই আপনাকে যে, বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করছে। এরা আসলে বাংলাদেশের হিতৈষী না। তারা বাংলাদেশের জনগণের হিতৈষী ছিল না।
তারা বাংলাদেশের জনগণের হিতৈষী ছিল না এই জন্যে, শেখ সাহেবের এই যে প্রোগ্রাম, এই যে বঙ্গবন্ধু যে প্রোগ্রাম নিছিলেন বাংলাদেশ গড়ার, এই প্রোগ্রাম করাতে আঁতে ঘা লেগেছে যাদের, তারাই তাকে খুন করছে।

এই জন্যে আমি ঐ বক্তব্য লিখেছি, এই জন্যে এই পেপারে একটা স্টেটমেন্ট দিছি। এটা গভর্নমেন্টকে দিছি, এটার একটা কপি আমি দিব আপনাকে। সেখানে আমি এই কথাই বলেছি, যে, ১৫ আগস্ট তো পালন করতে হবেই, তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার করতে হবে। বিচারটা এই জন্য দরকার যে, ঐ যে, ফাঁসি দিলে হবে না। ঐ যে ধরছে, এদের ফাঁসি দিলে এর বিচার কি হইল?

কিন্তু আসল খবরটা যে, বঙ্গবন্ধু কেন হত্যা হইল। কিসের ষড়যন্ত্র? সেই ষড়যন্ত্রকে উদঘাটন করতে হবে। এটা কি একটা ষড়যন্ত্র? কোন ষড়যন্ত্রের কারণে উনি মারা পড়লেন? যে জন্য বাংলাদেশ এতো পিছাইয়া গেল? সেই ষড়যন্ত্রকে উদঘাটন করতে হলে এই বঙ্গবন্ধুর হত্যার ঐ ফৌজদারি মামলা না করে, একটা ট্রাইব্যুনাল, একটা স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে এটা করতে হবে।
এবং তার সাথে সাথে, এটাও আমি বলছি যে, বঙ্গবন্ধুকে সহ তাজউদ্দিনদের যে হত্যাও ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে। তাইলে বাংলাদেশের সামনে আপনের, যে আমরা সুনীতির পথ খুঁজে পাব, বুঝতে পারব, আমাদের শত্রু মিত্র আমরা চিনতে পারব। এটা করতে হবে। তার হত্যাকাণ্ডের বিচার আমি তো অন্তর থেকে, আন্তরিকভাবেই চাই। এবং আল্লাহ’র কাছে আমি দোয়া করি যে, এটা নিশ্চই হবে।

চলবে…