চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

তুমি আর নেই সে তুমি

চারিদিক খোলামেলা আর সবুজে ঘেরা। ছোট বড় নানা গাছ-গাছালি শোভিত এক শৈল্পিক পরিবেশ। নেই কোন দেয়ালের বাধা। রাস্তা ঘাট ফাঁকা; তবে একেবারে শুনশান নয়। মাঝে মধ্যে দুই একটি প্রাইভেট কার বা রিকশা আসছে। ছেলে মেয়েরা খন্ড খন্ড হয়ে আলাদা বা একসঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। এটা ১৯৮০ সালের দিকে আমাদের টিএসসির পরিবেশ।ঘুড্ডি সিনেমার একটি দৃশ্যে এমন চিত্রই এসেছে।

বিভিন্ন বইপত্রে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার যে বর্ণনা পড়েছি; শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলাম তার সঙ্গে নিজের কল্পনা মিশিয়ে গোটা পরিবেশটাকে আমার কাছে স্বপ্নময় মনে হতো। সেই পরিবেশের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছি সেই স্কুলছাত্র থাকা অবস্থায়।

গত শনিবার ডিবিসি চ্যানেলের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু ভাই এসেছিলেন আমাদের চ্যানেল আই অফিসে; সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে। নিউজ সোর্স নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বলছিলেন মানুষ, কাগজপত্র ছাড়া সিনেমাও হতে পারে শক্তিশালী এক নিউজ সোর্স।কারণ কোন সময়ের বর্ণনা দিতে চাইলে ওই সময়ে তৈরি সিনেমাগুলো বেশ কাজে লাগে। কারণ সিনেমাতে পুরো পরিবেশটা দেখার সুযোগ মেলে।

গত রাতে ঘুড্ডি সিনেমা দেখা শুরু করার প্রথমেই টিএসসির একটি দৃশ্য দেখে মনটা কেমন করে উঠলো! আরে এই তো সেই পরিবেশ, সেই স্বপ্নময় পরিবেশ। ক্লাসের পাশাপাশি বন্ধুরা মিলে এমন জায়গায় প্রাণভরে আড্ডা দেব, গানের আসর জমাবো, দেশের সঙ্কট ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করবো। প্রতিবাদের ভাষায় চায়ের কাপে ঝড় তুলবো। মিছিলে গ্লোগান দেব।

ঘুড্ডি সিনেমার দৃশ্যে টিএসসি

পছন্দের মেয়েটি প্রতিদিন বিকেলে মাঝখানে সিঁথি করে দুটি বেণী করে আসবে। তাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো কার্জন হলে, রমনা পার্কে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।তার ইচ্ছে থাকলে তাকেও আমাদের আড্ডার নিয়মিত অংশ করে নেব। আশির দশকের অগ্রজেরা নিশ্চয়ই এমন সময় পার করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সেই জায়গাতেই আছে। আছে টিএসসি, কার্জন হল বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্কও। শুধু ‘তুমি আর নেই সে তুমি’।

শিক্ষার্থী সংখ্যা কয়েক গুন হয়েছে। ভবনের পর ভবন উঠে ক্যাম্পাস ভরে গেছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে সবুজ জায়গাগুলো ছেয়ে ফেলা হচ্ছে কংক্রিটে। চাকচিক্যের আড়ালে আড্ডা দেওয়ার জায়গাগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু চোখের সামনেই হচ্ছে।কিন্তু কেউ যেন বুঝেও বুঝতে পারছে না।

দীর্ঘদিনের চর্চায় শিক্ষার্থীদের মাঝেও এক ধরনের ধারণা প্রোথিত করে দেওয়া হয়েছে যে ‘আড্ডা দেওয়া মানেই খারাপ’। অধিকাংশই তাই তার ‘বাজে আড্ডায়’ না গিয়ে সুবোধ বালকের মত সন্ধ্যা হলেই পড়তে বসে। তবে সে পড়ার সঙ্গে নিজেকে আবিষ্কার তথা জ্ঞানের যোগ ঠিক কতটা সে বিষয়টি প্রশ্ন সাপেক্ষ।সন্ধ্যায় পড়তে বসা বালক বালিকাদের বেশিরভাগের হাতেই শোভা পায় চাকরির প্রস্তুতির বই। কারণ সে জানে, দিনশেষে একটি ভালো চাকরিই তার সফলতার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে, সমাজ নিজের মাঝে সে চিন্তাই সেট করে নিয়েছে। সুতরাং ‘বাজে আড্ডায়’ গিয়ে সে কেন শুধু শুধু ‘ঘরের খেয়ে বনের মেষ তাড়াতে’ যাবে?

তাইতো আশেপাশে এমন অনেকেরই দেখা মেলে, প্রায় ছয় বছরের শিক্ষাজীবনে যে ছয়বারও টিএসসিতে যায়নি (আড্ডা দিতে), ডাকসু-টিএসসি মানেই তাদের কাছে বিশ টাকায় খাবারের ক্যান্টিন।

একবুক স্বপ্ন নিয়ে এখনও স্বপ্নের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকে পড়তে আসে। কিন্তু সে স্বপ্নের রঙ ফিকে হতে হতে এক সময় কষ্টে-শিষ্টে শিক্ষাজীবন শেষ করার বদৌলতে একটি চাকরি প্রাপ্তিকেই জীবনের পরম পাওয়া ধরে নিয়ে সান্তনা খোঁজে।খুঁজতে বাধ্য হয়! (চলবে)

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)