জাদুকরী কথাসাহিত্যিক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ুন আহমেদের সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ যারা দেখেছেন, সেখানে এক বালকের করুণ আর্তনাদ তাদের হৃদয়কে আর্দ্র করেছে। যৌন নির্যাতিত সেই ছোট্ট বালকটির উপর বর্বরতা মানবিকবোধকে তীব্র কটাক্ষের পাশাপাশি উন্মোচিত করে অজানা এক অন্ধকার অধ্যায়ের।
ব্রিটিশ আমলে জমিদারী প্রথায় এই ভূখন্ডে অমানবিকতার এমন চিত্র নৈমিত্তিক হলেও কালের পরিক্রমায় এখন তা চিন্তার অতীত। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ‘বাচা বাজি’ নামে এখনও বহুলভাবে প্রচলিত তা।
সেখানকার প্রচলিত প্রবাদ, ‘শিশুপালনের জন্য নারী আর মনোরঞ্জনের জন্য বালক’ এর বহুল বিস্তারের প্রমাণ। আর ইসলাম বিরোধী এই প্রথা ইন্ধন যুগিয়ে চলেছে তালেবান প্রভাব বিস্তারে।
সম্প্রতি কয়েকটি আফগান পরিবারের সাথে কথা বলে সংবাদ সংস্থা এএফপি, যাদের শিশুদের, মূলত বালকদের যৌন নির্যাতনমূলক ‘বাচা বাজি’র জন্য অপহরণ করা হয়। মানবাধিকারের জঘন্যতম লঙ্ঘণ এই শত বছরের পুরাতন প্রথাকে তালেবান জঙ্গিরা ব্যবহার করে অস্থিতিশীলতা বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে। চরম অস্থিতিশীল উত্তরাঞ্চলকে অশান্ত রাখতে জঙ্গিদের এই সহায়ক বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে আনে এএফপি।
![](https://i0.wp.com/www.channelionline.com/wp-content/uploads/2024/02/Channeliadds-Reneta-16-04-2024.gif?fit=300%2C250&ssl=1)
হিন্দুস্তান টাইমসে সম্প্রতি ‘বাচা বাজি’র বিস্তার, বালক মনে এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতায় এর নেতিবাচক প্রভাব বিষয়ক এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
বাচা বাজি কি?
ক্ষমতাশালী জমিদার, কমান্ডার, রাজনীতিবিদ এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকেরা কর্তৃত্ব ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে প্রায়ই ‘বাচাদের’ (বালক) নিজেদের কাছে রাখে। তাদের মেয়েদের পোশাক পড়িয়ে রাখা হয়, পার্টিতে নর্তকী হিসেবেও দেখা যায় তাদের। প্রায় সময়ই তারা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। তবে ইসলামবিরোধী এই নির্মমতাকে সমকামীতা হিসেবে গণ্য না করে, বরং সংস্কৃতি চর্চা হিসেবেই দেখা হয়।
কতটা প্রচলিত?
আফগানিস্তানের অনেক অংশে প্রচলিত প্রবাদই -‘শিশুপালনের জন্য নারী আর মনোরঞ্জনের জন্য বালক’ এর বিস্তৃতির প্রমাণ। প্রাচীন এই প্রথা ১৯৯৬-২০০১ সালের তালেবান শাসনের সময় নিষিদ্ধ করা হলেও বর্তমান সময়ে তা আবারও বেড়েছে। আফগানিস্তানের দক্ষিণ এবং পূর্বাঞ্চলের শহুরে পশতুনদের মাঝে এবং উত্তরাংশে তাজিক জাতিসত্তার মাঝে এই প্রথা বহুলভাবে প্রচলিত।
কেন তা এতটা বিস্তৃত?
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, আফগান সমাজে নারী-পুরুষদের মাঝে কঠোর বিভাজন এবং নারী সঙ্গ না পাওয়া বাচা বাজির প্রসার ঘটিয়েছে। এছাড়াও আইনের শাসন না থাকা, দুর্নীতি, বিচারহীনতা, অশিক্ষা, দারিদ্র, নিরাপত্তাহীনতা এবং সশস্ত্র দলের উপস্থিতি এই প্রথার বিস্তারে সহায়ক বলে আফগানিস্তানের স্বাধীন মানবাধিকার সংস্থা (এআইএইচআরসি) ২০১৪ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে।
এআইএইচআরসি’র মতে, আফগানিস্তানের ফৌজদারি আইন ধর্ষণ এবং সমকামীতাকে নিষিদ্ধ করলেও বাচা বাজি নিয়ে কোন স্পষ্ট বিধান নেই। “বাচা বাজি বিষয়ে আফগানিস্তানের আইনে শূণ্যতা ও দ্ব্যর্থকতা রয়েছে এবং বিদ্যমান আইনে তা যথাযথভাবে উল্লেখ করা হয়নি।” তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়।
এছাড়াও “নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে অনেক অপরাধীর যোগাযোগ রয়েছে এবং ক্ষমতার ব্যবহার ও ঘুষ দিয়ে তারা শাস্তি থেকে বেঁচে যায়।” একটি কারণ।
এই বালকরা কোথা থেকে আসে?
বাচারা সাধারণত ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে হয়। তাদের অধিকাংশেই অপহৃত হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে পরিবার চরম দারিদ্রের কারণে তাদের বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়।
এআইএইচআরসি’র প্রতিবেদনে বলে, প্রায় সময় ধর্ষণের শিকার হতে হয় বলে এই বালকেরা গুরুতর মানসিক পীড়ায় ভোগে। আক্রান্তরা মানসিক চাপ, অবিশ্বাস, হতাশাবোধে ভোগে। এই শিশুদের মন সবসময় আতঙ্কগ্রস্থ থাকে এবং তাদের মনে প্রতিশোধের স্পৃহা থাকে, তারা সবাইকে শত্রু ভাবে।
এর ফলে অনেক আক্রান্ত কিশোরও ‘বাচা’ রাখার মনোভাব নিয়েই বড় হয় এবং এই নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি অক্ষুণ্ন রাখে। লন্ডনভিত্তিক থিংক ট্যাংক চাথাম হাউজের বিশেষজ্ঞ চারু লতা হগ বলেন, এই ধরনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাওয়া বালকদের পুনরুদ্ধার এবং পুনর্বাসনের জন্য কোন ব্যবস্থা না থাকায় তাদের পরবর্তী জীবন কেমন হয় তা জানা সম্ভব হয় না। নিজেদের জন্য বাচা রাখার অভিপ্রায় নিয়েই অনেকে বড় হয়, এমন ভয়ঙ্কর রিপোর্টও আমরা পেয়েছি। যা বর্বরতার চাকা সচল রাখে।
আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে এর প্রভাব?
আফগানিস্তানের চলমান সংঘাতকে অনেকটাই জিইয়ে রাখছে বাচা বাজির মতো বর্বর প্রথা। উরুজগানের মতো প্রদেশগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তালেবান বাহিনীর অনুপ্রবেশে সহায়তা করছে এই প্রথা। এর ফলে ন্যাটো প্রশিক্ষিত আফগান বাহিনীর প্রতি জনসমর্থন কমে আসছে।
ইউএস কংগ্রেস গত বছর জানায়, “আফগান জাতীয় প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে (এএনডিএসএফ) যুক্তরাষ্ট্র ৬০ বিলিয়ন ইউএস ডলারেরও বেশি অর্থসহায়তা দিয়েছে। এরমধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার দেয়া হয়েছে স্থানীয় পুলিশকে। আফগান সেনা ও পুলিশের বর্বর যৌনাচার এএনডিএসএফ-এর প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান জনগণের সমর্থন কমিয়ে দিবে। এতে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে আমাদের বিপুল বিনিয়োগ।”
এই বর্বর প্রথা তালেবানের শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে আরও বাড়াবে বলেও অভিমত কাবুলে নিয়োজিত একজন পশ্চিমা কর্মকর্তার।
তিনি বলেন, “১৯৯০এর দশকের শুরুতে মুজাহিদিন বাহিনীর এমন বর্বরতা তালেবানকে জনপ্রিয় করে তোলে, যার ফলে দেশের অধিকাংশ স্থানে তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০১-এর পর সরকারি বাহিনীর একই ধরনের আচরণ, তাদের (তালেবান) উত্থানে উৎসাহিত করছে।”