বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে রেখে সংবিধানের যে ষোড়শ সংশোধনী হয়েছিল হাইকোর্ট তাকে অবৈধ বলে রায় দেওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তা বহাল রেখে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করার পর বিভিন্নমুখি প্রতিক্রিয়া আসছে মন্ত্রীদের কাছ থেকে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত রায় নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখানোর পর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন,ওই বক্তব্য মুহিতের ব্যক্তিগত; দলের নয়।
অন্যদিকে জানতে চাইলেও পূর্ণাঙ্গ রায় না পড়ে এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তবে, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সাবেক আইন ও বিচারমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু।
মঙ্গলবার পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশের চারদিনের মাথায় সবার আগে এ সংশোধনী নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
শুক্রবার সিলেটে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন: এই আইনটা আমরা অ্যাসেম্বলিতে আবার পাস করব। এই কন্সটিটিউশনাল অ্যামেন্ডমেন্টটা আমরা আবার পাস করব এবং অনবরত করতে থাকব। দেখি জুডিশিয়ারি কতদূর যায়।
“বিকজ, জুডিশিয়ারির পজিশন আমার মতে আনটিনেবল (অন্যায্য)। মানুষের প্রতিনিধিদের উপর তারা খোদকারি করবে? তাদের আমরা চাকরি দেই।”
অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর সরকার ও আদালত অঙ্গনে আলোচনার মধ্যেই রোববার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, এটা মুহিতের ব্যক্তিগত মত।
ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ওবায়দুল কাদের বলেন, তার (অর্থমন্ত্রী) বক্তব্য সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করেন কেন? তাকে জিজ্ঞেস করুন। এটি তার ব্যক্তিগত মত। এটি দলীয় কোনো মতামত নয়।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া দিইনি। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করছি। মাথা গরম করে হুটহাট বলার তো কিছু নেই। মাথা ঠাণ্ডা করেই আমরা যথাসময়ে প্রতিক্রিয়া দেব।
রোববার হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত এক চুক্তি সই অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
তবে হাইকোর্টের রায়ের পর সংসদের দাঁড়িয়ে সে রায়কে অবৈধ বলে বক্তব্য দিলেও সুপ্রিম কোর্টে তা বহাল রেখে পুর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেখাননি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
শনিবার চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ। ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় পড়তে আরো সময় লাগবে। ৭৯৯ পৃষ্ঠার একটি পৃষ্ঠা পড়া বাকি থাকলেও আমি রায় সম্পর্কে কোন মন্তব্য করবো না। পুরো রায় পড়ার পরই আমি রায় প্রসঙ্গে কথা বলবো।’
রায় প্রকাশের পর একটি জাতীয় দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাতকারে আবদুল মতিন খসরু বলেছেন: সুপ্রিম কোর্ট বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু এ রায়ে যেসব বিষয় আনা হয়েছে, তা মামলার মূল বিষয়বস্তু থেকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। এ রায়ে আমরা ক্ষুব্ধ, আহত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ১ অগাস্ট। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৭৯৯ পৃষ্ঠার ওই রায় প্রকাশ করা হয়।।
প্রকাশিত রায় অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরেছে।
চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের যে সংশোধন আনা হয় তা সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক বলে রায়ে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি।
রায়ের পর্যবেক্ষণে, গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাশ করা হয়। ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন।
রিটের শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এরপর হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। গত ৮ মে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের উপর শুনানি শুরু হয়।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত আপিল শুনানিতে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে আপিল বিভাগে মতামত উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের ১০জন সিনিয়র আইনজীবী।
গত ৩ জুলাই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে রায় ঘোষণা করেন। আপিল খারিজের ওই রায়ের ফলে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল থাকে।