একাদশ সংসদে বিজয়ী হয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সরকারের নতুন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর উপপ্রেস সচিব হিসেবে আবারও দায়িত্ব পান আশরাফুল আলম খোকন। আশরাফুল আলম আগের চুক্তির ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল অথবা তার সন্তুষ্টি সাপেক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপপ্রেস সচিব পদে কর্মরত অবস্থায় আবারও নিয়োগ পান। এর আগে ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর উপপ্রেস সচিব পদে আশরাফুল আলম খোকনকে নিয়োগ দেয়া হয়। পরে সে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল।
আশরাফুল আলম খোকন সৃষ্টিশীল চিন্তা, দায়িত্বশীল মনোভাব ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের আধুনিকায়ন ও প্রেস উইংকে গতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। প্রধানমন্ত্রী বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজের সমন্বয় ও সকল পর্যায়ের পেশাদার সাংবাদিকদের সঙ্গে সর্ম্পক উন্নয়নেও কাজ করছেন তিনি।
স্কুল জীবন থেকে শুরু করে ছাত্রজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন খোকন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী খোকন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনি।
২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর উপপ্রেস সচিব পদে যোগদানের আগে আশরাফুল আলম খোকন চ্যানেল আইয়ের নর্থ আমেরিকার প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ পদে তিনি ৬ বছর কাজ করেছেন। ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা বিষয়ে তিনি সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাতকারে কথা বলেন।
প্রশ্ন : একজন সাংবাদিক হিসেবে ২১ আগস্ট অ্যাসাইনমেন্টে বের হয়েছিলেন। কী ঘটেছিল সেদিন?
আশরাফুল আলম খোকন: বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ২১ আগস্ট টার্নিং পয়েন্ট। এই দিন বারবার ফিরে আসে। তাই এই বিষয়ে নতুন করে মানুষের জানা দরকার আছে। দেশের প্রয়োজনেই এই ব্যাপারে সবার জানা দরকার। আমি সাংবাদিক ছিলাম। চ্যানেল আই’তে কাজ করতাম। সেদিন অ্যাসাইনমেন্টে গিয়েছিলাম। আজকের প্রধানমন্ত্রী তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার প্রোগ্রাম ছিল ওই দিন। আমরা নিয়মিতই যেতাম, সেদিনও গিয়েছিলাম। যে কোন শান্তি প্রিয় দেশেই দুর্ঘটনা বা ভাল ঘটনা যে কোন কিছুই ঘটতে পারে। ঘটনা ঘটবে না এমন কোন দেশ নাই। কিন্তু যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকেন তাদের কিছু দায়িত্ব থাকে। ঘটনা ঘটার পরে তার প্রতিকার করা। যারা ভিকটিম তাদেরকে সহায়তা করা। কিন্তু ২১ আগস্টের ঘটনা ছিল ঠিক তার উল্টো। এই ঘটনা অতর্কিত বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২১ আগস্ট হামলা ছিল পরিকল্পিত। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই হামলা করা হয়। কিন্তু আল্লার অশেষ কৃপায় নেতাকর্মীরা মানববর্ম তৈরী করে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।তারপরেও তিনি আহত হন। আপনারা জানেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কানে এখনও সমস্যা আছে। ২৪ জন নেতাকর্মী সেদিন প্রাণ দিয়েছেন এবং প্রায় ৫০০ এর মত মানুষ আহত হয়েছেন। গল্প, কবিতা বা সিনেমায় ওই দৃশ্য ফুঁটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। ওই দৃশ্য যারা না দেখেছেন, তাদের পক্ষে তা কল্পনা করা অসম্ভব।
প্রশ্ন : সেদিন গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর কী হয়েছিল?
আশরাফুল আলম খোকন: আমার শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়েছিল। আমার ষ্পষ্ট মনে আছে- তখন চ্যানেল আইয়ের হেড অব নিউজ ছিলেন শাহ্ আলমগীর ভাই। প্রথম যে গ্রেনেডটা বিস্ফোরিত হয় সেই গ্রেনেডের প্রথম আঘাতেই আমি আহত হই। আমি পাবলিকের ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। কারণ ইমব্যালেন্স অবস্থায় আমি ছিলাম। মাইক্রোফোন উপরে ধরা ছিল। মাইক্রোফোন উপরে আধা ঘণ্টা ধরে রাখা কিন্তু অনেক টাফ ব্যাপার। তাই পড়ে গিয়ে আমি ট্রাকের নীচে চলে গিয়েছিলাম। পাবলিকের পায়ের নীচে পদদলিত হয়ে ট্রাকের নীচে চলে গিয়েছিলাম। আমি তখন প্রথম ফোনটা বের করে হেড অব নিউজ আলমগীর ভাইকে কল দিয়েছি যে, আলমগীর ভাই টিভিতে ষ্ক্রল দেন, শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা বিস্ফোরণ। এটা কিন্তু প্রফেশনালিজম। আলমগীর ভাই চিৎকার করে বলছেন- কী হয়েছে? আমিও চিৎকার করে বলছি। কারণ প্রচণ্ড শব্দ এবং গ্রেনেড বিস্ফোরণের সাউন্ড। কয়েকবার চিৎকার করে বলার পর আলমগীর ভাই বুঝতে পেরে বলছেন- এই টিভিতে ষ্ক্রল দাও, স্ক্রল দাও। আমি আগে নিউজটা দিয়েছি, আলমগীর ভাইও আগে নিউজটা দিয়ে তারপরে আমাকে বলেছেন, তুমি ঠিক আছো তো? তারপরে আমি টের পেয়েছি যে, আমার সারা শরীর রক্তাক্ত। এর আগে কিন্তু টের পাইনি।
প্রশ্ন : এই ঘটনায় বোঝা গেলো- সাংবাদিকতায় প্রফেশনালিজম কিন্তু সহজ নয়?
আশরাফুল আলম খোকন: সহজ নয়। কোন পেশাই কিন্তু সহজ নয়। কাজ করতে চাইলে কোন কাজই কিন্তু সহজ নয়। যে যেই সেক্টরে কাজ করেন তিনি যদি ওই সেক্টরে সিরিয়াসলি কাজ করেন তাহলে কোন কাজই কিন্তু সহজ নয়।
প্রশ্ন: ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পেছনে রাষ্ট্র জড়িত ছিল?
আশরাফুল আলম খোকন: রাষ্ট্র তো সবার। রাষ্ট্র কোন গোষ্ঠী বা অংশের হওয়া উচিত নয়। সরকার যিনি থাকবেন তিনি সবারই হবেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপারে আমি ৫টা উদাহরণ দিতে পারি। যেমন- ঘটনা ঘটার পরে পুলিশের দায়িত্ব ছিল আহতদের্ উদ্ধার করা এবং যারা হামলা করেছে তাদেরকে ধরার ব্যবস্থা করা। কিন্তু উল্টো পুলিশ টিয়ারশেল ছুঁড়েছে লাঠিচার্জ করেছে। যারা উদ্ধার করতে এসেছিল তারা কাজ করতে পারেনি। তাই রক্তক্ষরণ আরও হয়েছে। একটা ঘটনা ঘটার পরে আলামত হলো মুখ্য বিষয় রহস্য উদঘাটনের জন্যে। বিএনপি জামায়ত সরকার এফবিআই নিয়ে এসেছে। কিন্তু এফবিআই নিয়ে আসার আগে আলামত ধুয়ে মুছে সব পরিষ্কার করা হয়েছে। এমনকি অবিস্ফোরিত গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আলামত সব নষ্ট করে দিয়েছে। আবার মামলা করতে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতারা। থানায় মামলাও নেয়নি। অনেক চাপাচাপির পরে মিডিয়া যখন গেছে তখন একটা এজাহার হিসেবে নিয়েছে।
প্রশ্ন : আর জজ মিয়া নাটক?
আশরাফুল আলম খোকন: জজ মিয়া নাটক অনেক পরে। সংসদ ছিল তখন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী। জাতীয় সংসদে তখন কোন আলোচনা করতে দেয়া হয়নি। সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে দিয়ে এক সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি করেছিল। কয়েকদিন পরে তিনি একটি রিপোর্ট দিলেন যে, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের ইন্ধনে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হয়েছে। এই ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে এই রিপোর্ট দেয়া হয় তখন।
এরপরে জজ মিয়া নাটক সবার জানা। গ্রামের একজন সাধারণ মানুষকে ধরে এনে তাকে দিয়ে বলানো হলো যে, এই ঘটনা সে করেছে। সে গ্রেনেড কী জিনিস তা চেনেই না। জজ মিয়া নাটকও এই ঘটনাকে ভিন্নখাতে পরিচালনার উদ্দেশ্যে করা হয়। এরপরে হরকাতুল জিহাদের যে মুফতি হান্নান তার স্পষ্ট স্টেটমেন্ট আছে- তারেক রহমান, আব্দুস সালাম পিন্টু তখনকার শিক্ষা উপমন্ত্রী, হারিছ চৌধুরী বেগম জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ছিলেন এবং জঙ্গিরা কোথায় মিটিং করেছে? কে গ্রেনেড দিয়েছে? মগবাজার বিএনপি’র আরিফুল কমিশনার সে গ্রেনেড সরবরাহ করেছে। মওলানা তাজউদ্দিন যিনি আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই- সেও গ্রেনেড সাপ্লাই দিয়েছে। হাওয়া ভবনে মিটিং হয়েছে। এই সবই মুফতি হান্নানের স্টেটমেন্টে আছে।
এরপরে আছে বিএনপির লুৎফুজ্জামান বাবর তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তিনি বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ছিলেন। বিএনপি তাকে বহিষ্কার করেছে। ২০০৮ এর নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। তিনি বিএনপি থেকে নির্বাচন করতে পারেননি। তিন বছর আগে তিনি বললেন একটা স্টেটমেন্টে যে, ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা ও দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় তিনি রাজসাক্ষী হবেন এবং যা যা জানেন তা বলে দেবেন কোর্টের সামনে। বিএনপি তখন তড়িঘড়ি করে সন্ধ্যার সময়ে তার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে নিলো যাতে তিনি সব কিছু বলে না দেন। এছাড়া রায় হওয়ার পরে তিনি এটিও বলেছেন যে, আমার যদি ফাঁসি হয় তাহলে তারেক রহমানের তিনবার ফাঁসি হওয়া উচিত।প্রশ্ন : সেই সময়ে অনেক নিউজ নাকি প্রচার করতে দেয়া হয়নি?
আশরাফুল আলম খোকন: তখন সন্ধ্যা ৭ টার নিউজের সময়ে হেড অব নিউজ কাঁপতেন। এই বুঝি একটা ফোন এলো- অমুক নিউজ করা যাবে না। তমুক নিউজ বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এখন এই আওয়ামী লীগ সরকার এতেদিন ক্ষমতায়। কোনদিন একটা ফোন করে কেউ নিউজ বন্ধ করতে বলেনি। কোন প্রকার চাপ দেননি। এটিই আওয়ামী লীগ সরকার। বঙ্গবন্ধু মিডিয়াবান্ধব ছিলেন। জননেত্রী শেখ হাসিনাও মিডিয়াবান্ধব। আজ এতোগুলো মিডিয়া তার অনুমতি তো শেখ হাসিনাই দিয়েছেন।
প্রশ্ন : আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
আশরাফুল আলম খোকন: আমি একসময় চ্যানেল আইতে কাজ করেছি। সাড়ে ছয় বছর দেশের বাইরে ছিলাম। এখন মাননীয় প্রধানন্ত্রীর সাথে কাজ করছি। এই সুযোগ আমি পাবো তা জীবনেও ভাবিনি। আমি আমার এখনকার কাজটা ঠিকমতো করি। এই কাজ ভবিষ্যতে আমাকে সামনের দিকে নিয়ে যাবে এটাই বিশ্বাস করি। এখনকার কাজটা ঠিক মতো করলে ভবিষ্যত এগিয়ে যাবে এই ধারণাই আমার এগিয়ে চলা।