সংসদ নির্বাচনে ফৌজদারি মামলায় দুই বছরের বেশি দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের অংশগ্রহণের সুযোগ নাই, আইনত নিষিদ্ধ তারা। নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণের সুযোগও সীমাবদ্ধ থাকার কথা। নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশ নেওয়ার কথা না। এগুলো কেবলই আইনি ব্যাখ্যার বিষয় নয়, নৈতিকতার ব্যাপারও এখানে জড়িত।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক দল বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একাধিক মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে আইনিভাবে নির্বাচনের অযোগ্য বলে মনে করা হচ্ছে। খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন, অন্যদিকে একই মামলাসহ আরও একাধিক মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েও তারেক রহমান পলাতক রয়েছেন। যদিও সকলেই জানে তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন, তবে আইন ও আদালতের দৃষ্টিতে তিনি পলাতক। দেশের আদালত তাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছিল, ইন্টারপোলে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হিসেবে তার নামে বিজ্ঞপ্তিও এসেছিল। তবু তিনি ফেরেননি দেশে, এবং সরকারও পারেনি তাকে ফিরিয়ে আনতে।
এর বাইরে সম্প্রতি হাই কোর্ট বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দিয়েছে। হাই কোর্টের সেই নির্দেশনা ইসি মানলে মূল গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বর্তমানে বিএনপি পুরোপুরিই নেতৃত্বশূন্য। কারণ আগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান পদ হারিয়েছেন। সে হিসেবে বর্তমানে বিএনপির কোনো চেয়ারপারসন নাই, নাই কোনো ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান।
হাই কোর্টের এই নির্দেশনা কাগজেকলমে বর্তমান, বাস্তবতার এর দেখা মিলছে না। খালেদা জিয়ার কারাগারে অবস্থানজনিত কারণে তারেক রহমানই বর্তমান বিএনপির নেতা। যদিও তার বক্তব্য-বিবৃতি বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রচার নিষিদ্ধ। তার এই নিষিদ্ধের বিষয়টি হাই কোর্টের তরফ থেকেই এসেছিল, যখন লন্ডনে বসে তারেক রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তিসহ দেশের ইতিহাস বিকৃতি করছিলেন।
তারেক রহমানের দণ্ড একাধিক। মানি লন্ডারিং মামলায় ৭ বছর, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পর সর্বশেষে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলার রায়ে তার দণ্ড হয় যাবজ্জীবন। এসব মামলায় রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন নি তারেক। দেশের বাইরে লন্ডনে অবস্থান করার কারণে আপিল করেন নি, কারণ আপিলের আগে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হতো। আইন-আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এই কাজটুকু করেন নি তিনি। বলা যায় রায়কেও করেছেন অগ্রাহ্য।
একাধিক মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমান নির্বাচনের অযোগ্য। আবার হাই কোর্টের রায়ের আলোকে তিনি দলীয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পদও হারানো; তার বক্তব্য-বিবৃতি গণমাধ্যম-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারও নিষিদ্ধ; এমন প্রেক্ষাপটে ফের হাজির হয়েছেন তিনি। এবং এবার তিনি একাদশ সংসদ নির্বাচনের দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ করছেন। স্কাইপের মাধ্যমে তিনি মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তার এই সাক্ষাৎকার গ্রহণের ছবিও প্রকাশ করেছে বিএনপি তাদের দলের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে।
নির্বাচন প্রক্রিয়ায় তারেকের এই অংশগ্রহণের পর এনিয়ে আপত্তি জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। তারা ইসিতে নালিশও জানিয়েছে। ইসি জানিয়েছে, এনিয়ে তাদের করার কিছু নেই। তারেকের এই উপস্থিতিতে আইনি বাধা নেই বলেও জানিয়েছেন ইসি সচিব হেলালউদ্দিন আহমেদ। এরবাইরে ইসি সচিব আরও জানিয়েছেন প্রার্থীদের ব্যানার-পোস্টার-ফেস্টুনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি ব্যবহার করা যাবে। ইসির এই সিদ্ধান্তে বিএনপির প্রার্থী, নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা খুশি হবে নিশ্চিত; একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের এখানে খুশি হওয়ার কারণ নাই। তাদের এই খুশি কিংবা অখুশি হওয়া না হওয়াটা পুরোপুরি রাজনৈতিক।
রাজনৈতিক এই দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর এই নিয়ে উদ্বেগের উপাদান রয়েছে। কারণ দেশের আইন-আদালত যাদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করে দণ্ড দেয়, এবং সেই দণ্ডকে উপজীব্য করে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য হয়ে পড়েন তারা কীভাবে সেই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে? এখানে প্রশ্নটা স্রেফ আইনি নয়, এটা নৈতিকতারও। অন্য মামলার রায় নির্বাচন কমিশনের ধর্তব্যের মধ্যে নয় বলারও সুযোগ নাই, কারণ সকল কিছুই নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাছাড়া, কারাগারে থাকা বেগম খালেদা জিয়া যেখানে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে সেখানে দণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামি তারেকের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় হবে কেন?
যিনি নির্বাচনেই অযোগ্য, তিনি কীভাবে নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই করতে পারেন? তাছাড়া তারেক রহমান দেশের আইন-আদালত-বিচারের রায় সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে আসছেন। আইনের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ, আদালতের প্রতি সামান্যতম হলেও আস্থা থাকলে দেশে ফিরে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগ ও রায়ের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালাতেন। কিন্তু এর কিছুই তিনি করেন নি। রাষ্ট্র ইন্টারপোলে তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। অপরাধী হিসেবে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় তার নাম সারাবিশ্ব দেখেছে। এমন একজন ব্যক্তি কীভাবে সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই করতে পারে যেখানে বাছাইকারী নিজেই নির্বাচনের জন্যে অযোগ্য!
নির্বাচন কমিশন এসব জানে না তা না; তবু এর প্রতিবিধান করেনি। ইসি যতই বলুক তাদের পক্ষে তারেকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নাই, কিন্তু বিএনপির এধরনের প্রক্রিয়ায় বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারত। সেটা তারা করেনি, উপরন্তু একে বৈধতা দিয়েছে। ইসির এই বৈধতা দান এক্ষেত্রে আদালতের রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলো না? নির্বাচনে অযোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে- এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে! এছাড়া নির্বাচনী প্রচার উপকরণে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি ব্যবহার নিয়ে ইসির সিদ্ধান্তও একইভাবে প্রশ্নবোধক।
নির্বাচনী আইন, প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা, আচরণবিধি সম্পর্কিত শব্দ-বাক্য হুবহু মেনে চলার জন্যেই কেবল ইসি নয়; আইনি শব্দ-বাক্যের বাইরে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের অপার। আইন সকলকেই মানতে হয়, এবং এই আইনের বাইরে যখন নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িয়ে যায় তখন ইসিকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আর এই সিদ্ধান্তে পরিস্ফুট হয় প্রাজ্ঞতার স্মারক।
আইনের দৃষ্টিতে, আদালতের রায়ে দণ্ডিত এবং পলাতক তারেক রহমান নিজেই নির্বাচনের অযোগ্য। কিন্তু তিনি নির্বাচনের যোগ্য প্রার্থী বাছাই করছেন- এ বিষয়টি আমাদের রাজনৈতিক নৈতিকতার ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। বিএনপির ঢাকার নেতারা তারেক রহমানকে উপস্থিত করে তোষামোদের প্রমাণ দিলেও এর মাধ্যমে আদতে তারা নৈতিকতাকে গলা টিপে হত্যা করেছেন। এই কাজটিকে বৈধতা দিয়ে ইসিও সঠিক কাজ করে নি। তারা অনৈতিক রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, যা আদালতের রায়ের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
শুরু থেকেই বিএনপি নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করে আসছে। তাদের দাবি ‘লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ইসি বিএনপি জোটের অনেক দাবি মেনে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের আপত্তি সত্ত্বেও নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্তের কথাও জানিয়েছে ইসি। তবু ইসিতে সন্তুষ্ট নয় বিএনপি। এটা যে বিএনপির নির্বাচনী অন্যতম কৌশল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নানা অভিযোগ থেকে বাঁচতে ইসি কি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় তারেকের উপস্থিতির অন্যায় ও অনৈতিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বৈধতা দিল? ‘লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড’এই দাবির বিপরীতে দণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি ব্যবহারের অনুমতি দিল নির্বাচন কমিশন?
‘লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি ও নিরপেক্ষতা প্রমাণের জন্যে অনৈতিক কোন প্রক্রিয়াকে বৈধতা দেওয়া উচিত হবে না। দেশের আইন, আদালত যাকে অপরাধী বলছে, যাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করছে তিনি কোনোদলের নীতিনির্ধারক হলেও তাকে প্রাতিষ্ঠানিক সে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, এখন তাদের সিদ্ধান্ত-স্বীকৃতিসমূহ তাই রাষ্ট্রীয়। এই গুরুদায়িত্ব পালনে আইনি বিষয়ের সঙ্গে নৈতিক বিষয়ের সমন্বয়ও জরুরি!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)