চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

তারাই পেছনে যারা ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চায়

বিনামূল্যে গ্রামের মানুষদের চিকিৎসাসেবা দিতে যাওয়ার পথে গত শুক্রবার সকালে কুষ্টিয়ার শিশিরমাঠ এলাকায় দুর্বৃত্তদের চাপাতির আঘাতে নিহত হন চিকিৎসক মীর সানাউর রহমান। এ সময় তার সাথে ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফুজ্জামান।

দীর্ঘদিনের বন্ধুর প্রাণ রক্ষা করতে হামলাকারীদের বাধা দিতে গেলে তাদের চাপাতির আঘাতে তিনিও আহত হন। গুরুতর আহত সাইফুজ্জামান বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এপ্রিল মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিমনা, ধীমান শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে যে পদ্ধতিতে হত্যা করা হয়েছে চলতি বছর ঠিক একইভাবে ডাক্তার মীর সানাউর, ভিক্ষু ধাম্মা ওয়াসা, সাধু পরমানন্দ, মাহবুব তনয়, জুলহাজ মান্নানসহ আরো নয় জনকে হত্যা করা হয়েছে।

ব্লগার, প্রকাশকদের পর চাপাতির লক্ষ্য এখন শিক্ষক ও সংস্কৃতিমনা সাধারণ মানুষের দিকে নিবদ্ধ হয়েছে। মানবহিতৈষী ডাক্তার সানাউর হত্যার পর আমেনা খাতুন নামের স্থানীয় এক বৃদ্ধা প্রশ্ন রাখেন ‘যে মানুষ গরমকালে সবাইকে গুড় আর বেল দিয়ে শরবত করে নিজ হাতে খাওয়াতেন, বিনা পয়সায় ওষুধ দিতেন, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতেন, এমন মানুষকে কারা খুন করল? কেন করল?’ (প্রথম আলো, ২১মে ২০১৬)

স্থানীয়দের ঠিক একই ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে দেখা যায় অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যার পর। তিনি দরগামড়িয়ার ইসলামী তাফসির কোরআন মাহফিলের সহ-সভাপতি ছিলেন। মসজিদ-মাদ্রাসায় দান-খয়রাত করার পাশাপাশি সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। ধর্ম নিয়ে কোনো কটূক্তি করারও কোনো নজির পাওয়া যায়নি তার বিরুদ্ধে। তাহলে তাকে কেন হত্যা করা হলো?

ডাক্তার সানাউর কোন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কোনো ধরনের শত্রুতাও ছিল না কারও সাথে। তাহলে তাকে কেন হত্যা করা হলো? তিনি বাউল চর্চা করতেন এবং বিনা পয়সায় গ্রামের দরিদ্র মানুষের সেবা করতেন- এই কারণে? অসহায় মানুষের সেবায় স্বার্থহীনভাবে কাজ করা একজন মানুষকে কেন হত্যা করা হবে!

এমন অনেক প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে ভীত-সন্ত্রস্ত ও ধোঁয়াসার মধ্যে থাকা সাধারণ মানুষের মনে। এতদিন দেখা গেছে কেবল ধর্ম নিয়ে ‘কটূক্তি’র অভিযোগ থাকলেই কোনো ব্যক্তিকে চাপাতির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে হয়। কিন্তু, সাম্প্রতিক কয়েকটি হত্যাকাণ্ড এই বার্তা দিচ্ছে যে সংস্কৃতিমনা হলেও চাপাতির নিশানা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। অধ্যাপক রেজাউল করিম, ডাক্তার সানাউর, সাইফুজ্জামান, মাহবুব তনয়, সাধু পরমানন্দ রায়, সবাই সংস্কৃতিমনা ও মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন। চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১৩টি হামলায় ১৪ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের পাঁচ জনই সংস্কৃতিমনা ও নির্ভেজাল জীবনযাপন করতেন (প্রথম আলো, ২১মে ২০১৬)।

গত ২২ এপ্রিল সাধু পরমান্দ রায় হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিদের টার্গেট করে হত্যা করার মিশন। এই হত্যাকাণ্ডগুলো প্রায় একই পদ্ধতিতে সংঘটিত হচ্ছে। চাপাতি দিয়ে ঘাড়ে ও মাথার পেছনে আঘাত করে আক্রমণের শিকার ব্যক্তির মৃত্যু নিশ্চিত করার পর হত্যাকারীরা মটরসাইকেলে চড়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। পালিয়ে যাওয়ার সময় জনগণের ধাওয়ার মুখে পড়লে গুলি করে অথবা বোমা ফাটিয়ে সমবেত মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে হন্তারকরা পালিয়ে যাচ্ছে।

চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ে অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে হত্যা করার পর ককটেল ফাটিয়ে উপস্থিত জনতাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে পালিয়ে যায় খুনিরা। একই ভাবে ২৫ এপ্রিল মাহবুুব তনয় ও জুলহাজ মান্নানকে হত্যার পর পুলিশ ও স্থানীয়দের ধাওয়া খেয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে খুনিরা পালিয়ে যায়। ৩০ এপ্রিল নিখিল চন্দ্র জোয়ারদারকে হত্যার পর ককটেল ফাটিয়ে একইভাবে তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

কুষ্টিয়ায় সানাউর হত্যাকাণ্ডের প্রায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঘটনাস্থলের প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে বোমা বহন করার সময় বোমার বিস্ফোরণে এক যুবকের প্রাণহানি ও তার সঙ্গী অপর যুবকের গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই দুই যুবক শিবির কর্মী বলে পুলিশ দাবি করছে (ডেইলি স্টার, ২০ মে ২০১৬)। বোমা বিস্ফোরণের শিকার দুই যুবক সানাউর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত কি-না তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া না গেলেও পূর্বের হত্যাকাণ্ডগুলোর ধরণ ও হত্যাকারীদের পালিয়ে যাওয়ার কৌশল থেকে সাধারণ মানুষের সন্দেহের তীর দুই শিবির কর্মীর দিকেই নিবদ্ধ হয়।

চলতি বছরে এ ধরনের প্রায় প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরই আইএস এসব হত্যার দায় স্বীকার করেছে। অন্যদিকে সরকার বলছে দেশে আইএস- এর কোন অস্তিত্ব নেই। মুক্তচিন্তার মানুষদের নাস্তিক আখ্যায়িত করে নির্বিচারে পৈশাচিকভাবে হত্যার ‘ঈমানি’ দায়িত্বের দর্শন সৃষ্টি হয়েছে আইএস জন্মের অনেক আগে থেকেই। চাপাতির আঘাতে হত্যার কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমাযুন আজাদসহ অনেকের ওপর। সর্বশেষ ঘটনার পর বলা যায়, সন্ত্রাসীরা তাদের মুখোশ বদল করেছে মাত্র। যাকেই হত্যা করুক না কেন, যেভাবেই হত্যা করুক না কেন, হত্যার দায় যারাই স্বীকার করুক না কেন, এসব সন্ত্রাসী কার্যকলাপের পেছনে একটি অভিন্ন অপশক্তির ইন্ধন ও প্রত্যক্ষ সহায়তা রয়েছে। তারাই পেছনে আছে যারা দেশের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চায়। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যাদের কিঞ্চিত শ্রদ্ধা নেই, সহজ-সরল-সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ও ধর্মভীরু মানুষের মগজ ধোলাই করে যারা ক্ষমতার মসনদে আসীন হওয়ার স্বপ্ন দেখে, দেশকে যারা একটি যুক্তিহীন অন্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় তারাই এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে।

নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাতের অপপ্রয়াসে নিরীহ মানুষকে রাস্তায় পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। পেট্রোল বোমা মারা হয়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। অগ্নিদগ্ধের শিকার নিরীহ মানুষ ও তাদের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়েছে হাসপাতালের পরিবেশ। একমাত্র উপার্জনকারী সদস্যের অকাল মৃত্যুতে পথে নামতে হয়েছে অনেক পরিবারকে। নিরীহ মানুষদের হত্যা করে ভীতির সংস্কৃতি তৈরি করতে পূর্বের মতো এখনও যুবক ও শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর কাজে।

পরিকল্পিত ও প্রায় একই পদ্ধতিতে এ হত্যাকাণ্ডগুলো আইএস, আল-কায়েদা বা এদের কোনো অঙ্গ-সংগঠন ঘটাচ্ছে এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। আহত অভিযুক্ত শিবির কর্মীর সাথে ডাক্তার সানাউর হত্যার কোন সংশ্লিষ্টতা আছে কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত।

চলতি বছর এক এক করে ১৪টি খুনের ঘটনা ঘটলেও প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে বিচারের সম্মুখীন করতে এবং এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এই ব্যর্থতাই দিন দিন হত্যাকাণ্ডে সংখ্যা বৃদ্ধি করছে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধূলিসাৎ করার এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটানো হচ্ছে। তাই একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার পরিণাম হবে ভয়াবহ। এই উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সরকারের কিঞ্চিত উদাসীনতা একদিকে যেমন হত্যাকারীদের আরো দুঃসাহসী হতে উৎসাহ দেবে, অন্যদিকে সরকারের যোগ্যতা ও সক্ষমতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে। তাই এই হত্যাকাণ্ডগুলোর সঠিক ও দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা জনসাধারণের মধ্যে জানান দেওয়া জরুরি। কারণ, হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত এসব হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকবে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতির মাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমতে থাকবে।

মৌলবাদীদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত অভিজিৎ রায়ের বাবা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অজয় রায়ের একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, পুলিশের মহাপরিদর্শক তাকে বলেছিলেন, যাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে তারা টার্গেটেড এবং এই টার্গেটেড মানুষের সংখ্যা প্রায় আঠারো শ। এত সংখ্যক মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া তাদের পক্ষে কঠিন। অবশ্যই এটি একটি কঠিন কাজ, কিন্তু এখন সময় এসেছে এসব মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার। গভীর নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে ধর্মান্ধ-মৌলবাদী-জঙ্গিদের সব আস্তানা এবং সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হিসেবে পরিচিত তাদের এলাকাগুলোর ওপর। কেননা, যে অঞ্চলে সংগঠনটি শক্তিশালী সেই অঞ্চলেই এই ধরনের হত্যাকাণ্ড বেশি হচ্ছে। এখন তাদের নির্বিচার হামলার শিকার হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিরীহ মানুষ যাদের সাম্প্রদায়িকতা, রাজনীতি, মৌলবাদ প্রভৃতির সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের উত্তর-পশ্চিমের জেলাগুলোতে মৌলবাদীদের উপস্থিতি বেশি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। চলতি বছরের ১৪টি হত্যাকাণ্ডে ৫টি ঘটেছে গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম ও রাজশাহীতে। এছাড়া ঝিনাইদহে দুইটি এবং গোপালগঞ্জ ও কুষ্টিয়ায় একটি করে।

রাষ্ট্রের আইন-কানুনের কোনো তোয়াক্কা না করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ধর্মান্ধরা এভাবে একের পর এক হত্যা করে পার পেয়ে গেলে তারা ক্রমাগত আরো শক্তিশালী হবে। তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির সাথে সাথে অপরাধের মাত্রাও তারা বৃদ্ধি করতে থাকবে।

যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অগ্নি সন্ত্রাস, পেট্রোল বোমাবাজির মতো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দক্ষতার সাথে কঠোর হাতে দমন করার নজির রাখতে পেরেছে, তারা এই ধর্মাশ্রয়ী ইসলামের লেবাসধারী মানবতাবিরোধীদের দমনেও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবে বলেই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)