বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে ২০০৮ সালে। সেই সময়ে দলটি যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল তা মুগ্ধ করেছিল দেশের সকল মানুষকে। বিশেষ করে সেই নির্বাচনী ইশতেহার আকৃষ্ট করেছিল দেশের তরুণ সমাজকে। এই নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে তরুণ সমাজ নতুন করে স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছিল। তরুণ সমাজের স্বপ্ন আজকে অনেকটা পূরণও হয়েছে। বাংলাদেশ আজ সত্যি সত্যি ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হচ্ছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করা নিয়ে সরকার যখন দেশি-বিদেশি নানা চাপের মুখে তখন এই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করার জন্য তরুণরাই রাজপথে নেমেছিল। যেটি সরকারকে আরো সাহস ও শক্তি যুগিয়েছিল দেশের এই অসমাপ্ত কাজটি সমাপ্ত করতে।
বর্তমানে দেশে তরুণ ভোটার সব থেকে বেশি। তাই তরুণরা যেই রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দিবে তাদের জন্যই সুফল বয়ে আসবে। এ কারণেই, দেশের যেকোনো কর্মকাণ্ডে এই তরুণদের পূর্ণ সমর্থন প্রয়োজন। পূর্ববতী দুটি জাতীয় নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের উপর তরুণ সমাজের পূর্ণ সমর্থন থাকলেও কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলনসহ নানা ইস্যুতে বর্তমানে দলটির প্রতি অনেকাংশেই মন:ক্ষুন্ন তরুণ প্রজন্ম। এবং এটা স্বয়ং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই তৈরি করেছে। এই দুটি আন্দোলনই চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে সরকারের দুই মন্ত্রীর বক্তব্যের মাধ্যমে। বর্তমানে নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম ও সরকারকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, বিষয়টি হতে পারতো উল্টো। কেননা, এই সরকার তরুণদের ভোটে নির্বাচিত সরকার। তরুণদের সরকার এবং এত কিছুর পরও বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মনে করে- তাদের স্বপ্ন এই দলটি ছাড়া হয়ত অন্য কোন রাজনৈতিক দল পূরণ করতে পারবে না।
তরুণরা এখন পর্যন্ত নানা বিষয়ে দেশে বড় বড় আন্দোলন করছে যা সরকারকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে। কিন্তু, এই তরুণরা প্রতিটি আন্দোলন করেছে বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করে। যেই স্বপ্ন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও ধারণ করে। তাই, আওয়ামী লীগ ও তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন এক ও অভিন্ন। তারা আন্দোলন করছে সেটির জন্যই- যেই স্বপ্ন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নিজেই দেখেছিলেন। শোষণ ও বৈষম্যহীন সোনার বাংলা। তারা আন্দোলনের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়েছে মাথায় লাল-সবুজের পতাকা আরা বুকে জাতির জনকের ছবি নিয়ে। তারা ভালোবাসে এই দেশকে। তাই ঝেড়ে ফেলতে চাই সকল অনিয়ম আর বৈষম্য। সৃষ্টি করতে চায় সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ।
অস্বীকার কারার কোনো সুযোগ নেই এই দেশ নানা অনিয়ম ও বৈষম্যে ভরপুর। আর এসব অনিয়ম দূর করতেই তরুণদের আন্দোলন। আন্দোলনকে মোকাবেলা করার জন্য সরকারের নানা পর্যায় থেকে নানা উদ্যেগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু, নিপীড়নমূলক কোন ব্যবস্থা যৌক্তিক সমাধান বয়ে আনতে পারে না। কেননা, সেটাই যদি সম্ভব হতো তাহলে ২০০৬ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় না থেকে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় থাকতো।
তাই প্রতিটি আন্দোলনের যৌক্তিক সমাধান প্রয়োজন। কোটা সংস্কার আন্দোলন বন্ধ করার জন্য ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর যে বর্বর হামলা চালিয়েছে সেটা এই সভ্য সমাজে মোটেই প্রত্যাশা করা যায় না। এই বর্বর হামলার মাধ্যমে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বাড়েনি বরং কমেছে। কোটা সংস্কারের মতো- নিরাপদ সড়কের আন্দোলন বন্ধ করার জন্যও যদি একই পথ বেছে নেওয়া হয় তাহলে হয়ত সেটাই নতুন আন্দোলনের জন্ম দেবে। সত্যিকার অর্থে আমরা আজ কেউই নিরাপদ নয়। নিরাপদ সড়কের দাবি সবার।
প্রায় সব জায়গায় বলতে শুনি- প্রধানমন্ত্রীকে সবসময় সঠিক বিষয়টি জানানো হয় না। কথাটি আগে আমি বিশ্বাস না করলেও এখন করি। হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রীকে সত্যি সত্যি নেতা-কর্মীরা নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে সবসময় সঠিক তথ্য দেন না। সেটার প্রমাণ আমি নিজেই পেয়েছি। সম্প্রতি কোন একটি বিষয় পর্যবেক্ষণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দলটির একজন সিনিয়র নেতা আসলেন এবং কিছুক্ষণ পর প্রধানমন্ত্রীকে পরিস্থিতি জানানোর জন্য ফোন করলেন। কথোপকথনে, ফোনের ওপারের দুটি প্রশ্নের উত্তরে- তিনি প্রধানমন্ত্রীকে যা বললেন, তা সম্পূর্ণ বাস্তবতার বাইরে। কোন কিছু তদন্ত না করেই তিনি বললেন, আপা এটার সাথে জামাত-শিবির জড়িত। এটি শুনে হয়তো প্রধনমন্ত্রী খুশি হলেন কিন্তু সঠিক তথ্যটি পেলেন না।
স্কুলের বাচ্চারা আজ রাস্তায় নেমেছে। শুধুমাত্র দুইজন শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে বলে নয়। প্রতিদিন শত শত মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। কিন্তু, এটি নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই। যার যার ধান্দায় সে সে ব্যস্ত। দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এই আন্দোলন। যে দেশের পুলিশের, বিজিবির, দুদুকের, মন্ত্রীর, এমপির এমনকি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের গাড়ির কাগজপত্রের ঠিক থাকে না এবং তারা দেশের ট্রাফিক আইন মেনে চলেনা সেদেশে এমন আন্দোলন অযৌক্তিক কিছু নয়।
প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছিলেন, তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালাবেন। দেশের সাধারণ মানুষও চাই সত্যি সত্যি মাদকের মতো দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হোক। যেখানে- মাদকের মতো শুধু চুনোপুটি নয় রাঘববোয়ালদেরও ধরা হোক। দুর্নীতি বন্ধ হলে দেশের মানুষ শতভাগ সেবা পাবে। ভোট মানুষের কাছে চাইতে হবে না। তারা সেবা পাবার জন্যই এই দলকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব দেবে। কিন্তু, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো এত সহজ হবে না। কেননা, যারা চোর ধরবে তারাই তো চোর।
এই ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কীভাবে দেশ চালাতে হয়। খুব অবাগ লাগে যখন মন্ত্রী মহোদয় বলেন-এদেরকে জামাত-শিবিররা রাস্তায় নামিয়েছে। এই কথা বলার আগে আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত। আপনারা কী করেন? দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও তরুণ সমাজকে আকৃষ্ট করতে পারেননি! নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে সব কিছু জামাত-শিবিরের উপর চাপিয়ে দেন! এটাই আওয়ামী লীগের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। শুধু আন্দোলন নয়, আওয়ামী লীগের কোন কাজের সমালোচনা করলেও এখন সে জামাত-শিবির হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এমন কোন ফেরেস্তা নয় যে তারা ভুল করবে না। ভুল প্রত্যেকেরই হয়। সেটা থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করলে জনপ্রিয়তা কমে না বরং বাড়ে।
বুঝে না বুঝে সবকিছুতেই জামাত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বেড়ানোর কারণেই বর্তমান পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। যখন কোন আন্দোলন হয় সেটা থেকে তৃতীয় পক্ষ সুবিধা নিতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিটি আন্দোলন করার সুযোগ তো আপনারাই তৈরি করে দিচ্ছেন। অন্যদের দোষ দিয়ে লাভ কী?
জামাত-শিবিরের যদি এত হাজার হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে আন্দোলন করার ক্ষমতা থাকতো তাহলে আজ আপনার চেয়ারটি থাকতো না। দয়া করে দেশের সমস্যাগুলো অনুধাবন করুন এবং সমাধানের চেষ্টা করুন। প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা যখন দেশের সাধারণ মানুষের কাছে আকাশচুম্বী সেখানে কয়েকজন মন্ত্রী ছাড়া সবার জনপ্রিয়তা প্রায় শূন্যের কোটায়। দেশ ও দলের জন্য না হলেও অনন্ত নিজের জনপ্রিয়তার কথা চিন্তা করে কিছু ভালো কাজ করুন। পাঁচ-সাত জন মন্ত্রী ছাড়া অন্য মন্ত্রীদের নামও সাধারণ মানুষ জানে না! জনপ্রিয়তা তো দূরের কথা। জানবেই বা কেন। কী এমন করেছেন তাদের জন্য যেটার মাধ্যমে আপনাকে তারা চিনবে?
দেশ স্বাধীন হবার পর কয়েকশত মন্ত্রী দেশে তৈরি হয়েছে। কিন্তু, ক’জনের কথা দেশের মানুষের মনে আছে? যারা ব্যক্তি স্বার্থ বাদ দিয়ে দেশের ও দলের জন্য কাজ করেছে; দেশ ও দেশের মানুষ শুধু তাদের কথাই মনে রেখেছে। বাকিরা মন্ত্রীত্ব শেষ হবার সাথে সাথে হারিয়ে গিয়েছে। নিজেকে সাধারণ মানুষের জন্য উৎসর্গ করুন- তারা আপনাকে সারাজীবন মনে রাখবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)