একুশ শতকের এই সময়ে যে মানুষেরা পৃথিবীতে বাস করছেন, তারা সৌভাগ্যবান এই অর্থে যে, তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো উগ্রবাদী শাসকের বিপরীতে জেসিন্ডা আরডার্নের মতো একটি আপাত অপরিচিত মুখ দেখছেন, যিনি এরইমধ্যে সারা বিশ্বের মানবিকতা আর উদারতার প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আগামীর পৃথিবী যে যুদ্ধবাজ, অস্ত্রব্যবসায়ী, চরমপন্থি, উগ্র জাতীয়তাবাদী আর বর্ণবাদীদের দখলে চলে যাবে না, জেসিন্ডা আরডার্ন সেই বার্তাটি খুব স্পষ্টভাবেই দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন।
শান্তিপ্রিয় মানুষের দেশ হিসেবে পরিচিত নিউজিল্যান্ড বিশ্বরাজনীতিতে ওই অর্থে খুব বেশি আলোচিত কোনো নাম নয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শুধুমাত্র ক্রিকেট আর মাঝেমধ্যে ভূমিকম্পে নড়ে ওঠা ছাড়া খুব একটা সংবাদ শিরোনামও হয় না। ফলে নিউজিল্যান্ডের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান কে—তা নিয়ে বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষেরও খুব একটা আগ্রহ ছিল বলে মনে হয় না।
যতটা আলোচনায় থাকেন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও। কিন্তু এইসব রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানকে ছাড়িয়ে বিশ্বের মানুষ এখন জেসিন্ডা নামে এই নারীর মুখে যে মায়া, যে সংবেদনশীলতা আর যে ভালোবাসার রঙ দেখছেন, তা সত্যি অভুতপূর্ব।
জেসিন্ডা বলে দিয়েছেন, আগামী বিশ্ব উগ্রবাদীদের নয়; আগামীর পৃথিবীর ধর্ম ও বর্ণের নামে হত্যাকারীদের নয়; আগামী দুনিয়া স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে প্রার্থনালয়ে ঢুকে ভিন্ন ধর্মের মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণকারীদের জন্য নয়; বরং আগামীর পৃথিবী মানুষের। আগামীর পৃথিবী ভ্রাতৃত্বের। আগামীর বিশ্ব ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে জাত-পাতের ঊর্ধ্বে ওঠা মানুষের ভালোবাসায় রঙিন।
প্রশ্ন হলো একজন মানুষ যে পুরো বিশ্ববাসীর চোখ, সমস্ত ক্যামেরার লেন্স তার দিকে ফোকাস করাতে সক্ষম হলেন, তার ক্যারিসমা কী? এই প্রশ্ন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নকে করা হলে তিনি সম্ভবত এক কথায় জবাব দেবেন, এখানে কোনো ক্যারিসমা নেই; যা আছে, তার নাম মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সংবেদনশীলতা আর ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা। এখানে কোনো জাদু নেই। মানুষকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারা এবং মানুষকে মানুষ হিসেবে তার প্রাপ্য সম্মান ও অধিকারটুকু দিতে সচেষ্ট থাকলেই সারা বিশ্বের মানুষের চোখ এবং সমস্ত ক্যামেরার লেন্স তার দিকে ফোকাসড হবে। কত সহজেই সারা বিশ্বের মানুষ এখন নির্বিবাদে, একবাক্যে জেসিন্ডা নামে এই নারীর প্রতি এক গভীর ভালোবাসা আর নিঃস্বার্থ শ্রদ্ধায় নত।
তার দেশের দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পরে তিনি সে দেশেরই শুধু নয়, সারা বিশ্বের মুসলমানদের আস্থা অর্জন তথা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের কাছে তার নিরপেক্ষ অবস্থান পরিস্কার করার জন্য যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন, জুমার নামাজের আজান একযোগে সারা দেশের টেলিভিশন ও রেডিওতে প্রচার করেছেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তার দেশের সকল মানুষকে মুসলমানদের সাথে সংহতি জানাতে ফুলের তোড়া হাতে রাস্তায় দাঁড় করিয়েছেন, অপরাধীকে দ্রুততম সময়ে শুধু গ্রেপ্তার করাই নয় বরং তার দেশে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন, মুসলমান কমিউনিটির সদস্যদের কাছে বারবার ছুটে গেছেন, তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন,মুসলমান নারীদের পোশাক হিজাব পরেছেন—সেগুলোকে নিছকই ‘পলিটিক্যাল স্টান্টবাজি’ বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।
কারণ একজন মানুষ ভেতর থেকে ওউন না করলে, অর্থাৎ বিশ্বাস না করলে শুধুমাত্র ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়া বা বিশ্ববাসীর কাছে নিজেকে হিরো বানানোর উদ্দেশ্যে এইসব কাজ করলে তার মেকি রঙ এরইমধ্যে প্রকাশিত হয়ে যেতো। কিন্তু জেসিন্ডা যা করছেন, সেখানে তার আন্তরিকতার যে কোনো ঘাটতি নেই, তিনি যে বিশ্বাস, সংবেদনশীলতা আর ভালোবাসা নিয়েই কাজগুলো করছেন, সে বিষয়ে আশা করি কেউ সন্দেহ পোষণ করবেন না।
বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নারী প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা জানিয়ে দিয়েছেন, বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি নির্দেশনাতেই হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে; তাকে হয়তো সারা বিশ্বের মানুষ ভয়ও করে, কিন্তু সেই ভয় ও শঙ্কার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিশ্ববাসী এখন একজন একজন মায়াবতী মায়ের চেহারা দেখছে।
উগ্রবাদ, সহিংসতা, বর্ণবিদ্বেষ যে আগামীর পৃথিবী শাসন করবে না বা করতে পারবে না, জেসিন্ডা আরডার্ন খুব স্পষ্টভাবে সেই বার্তাটি দিয়েছেন।
শুধু জেসিন্ডাই নন,তার দেশ নিউজিল্যান্ডের সাধারণ নারীরাও এক অনন্য ভালোবাসা ও সংহতির নজির স্থাপন করেছেন। শুক্রবার অন্য ধর্মের অনেক নারী মাথায় কাপড় দিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। জঙ্গি হামলার ভয়ে এক নারী হিজাব পরে বাইরে আসতে ভয় পাচ্ছেন—এমন কথা শুনে থায়া অ্যাশম্যান নামে অকল্যান্ডের এক চিকিৎসক ভাবেন, সব ধর্মের নারীরা আজ এভাবে ভীত নারীর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে পারেন। তাই তিনি অন্য ধর্মের নারীদের আহ্বান জানান, যেন তারা এই ভীতি ও শঙ্কার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সন্ত্রস্ত মুসলিম নারীদের পাশে দাঁড়ান।
ক্রাইস্টচার্চ,অকল্যান্ড ও ওয়েলিংটনের অনেক নারী মাথা স্কার্ফ দিয়ে ঢেকে ছবি পোস্ট করেন, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক শিশুকেও স্কার্ফ পরতে দেখা গেছে। এইসব মানুষের জন্য জীবনানন্দ অনেক আগেই লিখে গিয়েছেন: ‘চারিদিকে ব্যর্থ মৃত্যুশীল তবুও আশ্চর্য সব আশাশীল মানুষের আলোড়ন।’
তবে এটা ঠিক যে, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় ইসলামের নামে উগ্রবাদী বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতা কিংবা ইউরোপ আমেরিকায় উগ্র শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদী আচরণের সঙ্গে লড়াই করে একটি সহনশীল, মানবিক, পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থায় পূর্ণ একটি পৃথিবী নির্মাণে জেসিন্ডার মতো রাষ্ট্রনায়কের সংখ্যা বাড়তে হবে।
ক্ষমতায়-প্রতিপত্তিতে এখনও ডোনাল্ড ট্রাম্প বা নেতানিয়াহুর মতো রাষ্ট্রপ্রধানরাই হয়তো এগিয়ে। ফলে এই ক্ষমতা আর পারমাণবিক হুমকির বিপরীতে গোলাপের উষ্ণতায় ভরা পৃথিবী নির্মাণ খুব সহজ নয়।
বরং সেই কঠিন কাজটি জেসিন্ডা আরডার্ন যতটা সহজে করতে পারছেন এবং করছেন, সেটি পুরো পৃথিবীর জন্যই শিক্ষনীয়। কেউ কি আদৌ শিক্ষা নিচ্ছেন?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)