চাচির খুব শখ ছিল তার ছেলে রুপসু তবলা শিখবে। সেই আমাদের ছোটবেলায় আমার ভাই ও বন্ধু রুপসুকে তবলা কিনে দেয়া হল, সাথে নিযুক্ত হলেন তবলার শিক্ষক। এরপর ৬ মাস কেটে গেল রুপসু আমাদের একটি গানের বোলও শোনাতে পারলো না। উল্টো পরপর চারটি তবলা ভেঙে ফেললো!!, বাজানো শিখতে গিয়ে, মারামারি করতে গিয়ে নয়। অবস্থা বেগতিক দেখে ৬ মাস পর ওর তবলা শেখানোর শিক্ষকও বিদায় নিলেন। ব্রাদার রুপসুর ৪ টি তবলা ভাঙাই সার হলো, চাচির আশা আর পূরণ হলো না।
হঠাৎ এই কথাটি মনে পড়ার কারণ হলো, সেদিন আমার পরিচিত একজন খুব খুশি খুশি কন্ঠে এসে জানালো, জানেন আপা আমার পাঁচ বছরের ছেলেটি পরপর তিনটা ল্যাপটপ ভেঙে ফেলেছে। আমারতো চক্ষু চড়কগাছ। “বলেন কী!! তিনটা ল্যাপটপ!! সেতো সাংঘাতিক ব্যাপার, অনেক টাকার মামলা।” শিশুটির বাবা বলল,“ হ্যাঁ তা ঠিক কিন্তু কী জানেন এই যুগে বাচ্চারা যদি এসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার না শেখে তাহলেতো পিছিয়ে পড়বে। এভাবে ভাঙতে ভাঙতেই শিখবে। তাই ওকে আরেকটা ল্যাপটপ কিনে দিবো।” আমার চোখ সেই যে কপালে উঠেছিল তা কপালেই থেকে গেল, আর তা নামলো না। বরং মনে পড়ে গেল রুপসুর তবলা শেখার স্মৃতিটি, ঔতো পরপর ৪টি তবলা ভেঙেছিল।
খালাতো বোনটি জানালো, তার ৪ বছরের ছেলেটি এবিসিডি লিখতে শিখছে না কিন্তু কম্পিউটারে ওর ফোল্ডার খুলে ছড়া বা কার্টুন দেখতে পারে। গল্পের বই পড়ার চেয়ে ও ভিডিও গেম খেলতেই বেশি মজা পায়। আর এসব কাজে ওর বুদ্ধিও খুব কাজ করে। বোনটি বলল, অবশ্য এখনকার যুগে এসব শেখাই দরকার। কথাটি বলার সময় আমার বোনের চেহারাখানাও বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল।
এক সহকর্মী জানালো তাদের বাচ্চা ছেলেটা কিছুতেই খাতায় লিখতে চাচ্ছে না। স্কুলে কেজি ক্লাসে গেলেও লেখালেখিতে দারুণ অনাগ্রহ। লিখতে বললেই বলে,“তোমরাতো কাগজে কলমে কিছু লেখোনা। শুধু ল্যাপটপে লেখো, তাহলে আমি কেন খাতায় লিখবো? আমাকেও ল্যাপটপ কিনে দেও স্কুলে গিয়ে আমিও ল্যাপটপে লিখবো।” কী বিপদ হলো বাচ্চাটিকে নিয়ে। সত্যিইতো সে তো তার বাবা মাকে কখনই কাগজে কিছু লিখতে দেখেনি। তাহলে একটি ল্যাপটপতো শিশুটি চাইতেই পারে। শিশুরা বাসায় বড়দের বিশেষ করে বাবা মাকে যা করতে দেখে তাই শেখে।
আমার মেয়েটি যখন ছোট ছিল, তখন আমাদের কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ছিলনা। তাই মেয়েটি এই আবদার করেনি। তবে ও পেন্সিল দিয়ে লিখতে চাইতো না। কলম চাইতো লেখার জন্য। সেও বলতো, তোমরাতো পেন্সিল দিয়ে লেখো না, তাহলে আমি কেন লিখবো? আমাকেও কলম কিনে দিতে হবে। খুবই যৌক্তিক দাবি। ওকে খুব কষ্ট করে বোঝাতে হয়েছিল স্কুলে পেন্সিল দিয়ে লিখতে হয়, আর বড় হলে হাতে কলম নিতে হয়। ওর দাবি মেটাতে আমিও মাঝে মাঝে পেন্সিল দিয়ে লিখতাম, ওকেও কলম দিতে হত।
আমার বন্ধুর মেয়েটি ছোটবেলায় হাতে গুণে অংক করতে চাইতো না। বলতো ক্যালকুলেটর দিয়ে গুণবে। হাতে কেন গুণতে হবে? এতো আরেক বিপদ। বহু কষ্টে তাকে বোঝানো হয়েছিল হাতে গুণতে না শিখলে ক্যালকুলেটর ব্যবহার করা কঠিন হবে।
আজকের এই যুগে বসে আমরা শিশুকে প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে সরিয়ে রাখতে পারবো না, আর তা উচিত হবে না। কিন্তু তাই বলে ল্যাপটপ ভেঙে ভেঙে শিখবে বলে পরপর ৩টি ল্যাপটপ কিনে দেব? এটা কি আদতে ঠিক কাজ হচ্ছে? এখন বাচ্চারা স্কুল থেকে বাসায় ফিরে কার্টুন নিয়ে বসে। খেতে খেতে দেখে বা গেম খেলে। তাদের জন্য বাবা মা বাধ্য হয়ে তাদের প্রিয় কার্টুন ডাউনলোড করে রাখে, নয়তো বাচ্চা খায় না।
বাবা মায়েরা খুব যে খুশি হয়ে সন্তানের এই ইচ্ছা মেনে নিচ্ছে, তা নয়। অধিকাংশ বাবা মা বাধ্য হয়ে বা উপায় না পেয়ে এটা করছে। বাচ্চা কার্টুন দেখবে, ভিডিও গেম খেলবে, ছড়া সিনেমা দেখবে– তাতে দোষের কিছু নেই কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এটাতে তারা রীতিমতো আসক্ত হয়ে পড়ছে। এর বাইরে তাদের আর কোন জগৎ নেই। সেদিন একটি রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েও দেখলাম বাবা মা খাচ্ছে, আর বাচ্চাটি ট্যাব দেখতে দেখতে মুরগির রান হাতে নিয়ে বসে আছে।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ স্যার একবার বলেছিলেন, শিশুদের বইপড়ার অভ্যাস করাতে হবে এবং সেটা ছোটবেলা থেকেই। বাচ্চাদের বইয়ের চেয়ে স্বভাবতই টিভি দেখাতে আগ্রহ বেশি থাকে। কারণ টিভি গতিশীল। ওকে কষ্ট করে কোন কিছু চিন্তা করতে হয় না। সব চোখের সামনে একপলকে হাজির হয়ে যাচ্ছে।
বাচ্চা তার পরিবার থেকে শেখে। আর তাই আমি অভিভাবকদের কাছে অনুরোধ করছি প্রযুক্তি শেখার আগে আপনার শিশুকে বই পড়তে শেখান। বই না পড়লে শিশুর সৃজনশীলতা তৈরি হয় না। বই তাকে ভাবতে শেখায়, কল্পনা করতে শেখায়, ভাষা শেখায়। দয়া করে আপনার শিশুকে বই পড়ার সুযোগ করে দিন ।
আমরা যারা আজকালের শহরের আধুনিক মা বাবা তাদের হাতে সময় খুব কম। আমাদের জন্য বই পড়ার বা বাচ্চাকে বই পড়ে শোনানোর চেয়ে একটা যন্ত্র হাতে বসিয়ে দেয়া সহজ বাচ্চা ওটাতেই সব দেখে দেখে শিখে নিচ্ছে। আর আমরাও অনেকটা রেহাই পাচ্ছি।
টেলিনর মানে গ্রামীণফোনের জরিপে যে তথ্য বেড়িয়ে এসেছে গত ১০ ফেব্রুয়ারি, সেটাও আমাদের জন্য কম আশঙ্কাজনক নয়। দেশের শতকরা ৪৯ ভাগ শিশু নাকি প্রতিনিয়ত সাইবার হয়রানির শিকার হচ্ছে। এরা বন্ধুবান্ধবের চাপে পড়ে মন্দ ওয়েবসাইটে গিয়েছে বা সামাজিক মাধ্যমে বাজে ভাষা ব্যবহার করেছে। টেলিনর আশা প্রকাশ করেছে বাবা মা বা অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সঠিক পথটি দেখাতে সহায়তা দিবে।
আমার বাবা নাকি দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রথম ট্রেন দেখেছিল। আর নিজের চোখে টেলিভিশন দেখেছিল প্রায় ৩০ বছর বয়সে এসে। সেখানে আমরা জন্মের পরপরই টেলিভিশন দেখেছি। আমাদের বাচ্চারা আরো কিছুটা এগিয়ে ছিল। কিছুটা বড় হয়েই হাতে পেল কম্পিউটার বা ল্যাপটপ। আরো একটু বড় হয়ে হাতে পেল মোবাইল ফোন।
আর আজকের শিশু মায়ের পেট থেকেই মোবাইলের এ্যাপস চিনে নিয়ে পৃথিবীতে আসে। আর জন্মের পর বড় হতে হতে ৩ টা ল্যাপটপ ভেঙেও ফেলতে পারে।
প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা রোধ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় আর তা আমরা চাইও না। শুধু চাই শিশু যেন প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার শিখে বড় হতে পারে। শুধু ল্যাপটপ ভাঙলেই হবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)