চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

তথ্য সত্য দূরত্ব

হাতে বইটি তুলে নিয়ে মনে রাখা দরকার, কী গণমাধ্যম পরিস্থিতি ও দেশীয়-বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সাংবাদিক লিখলেন অশেষ দাবার চাল।

সাংবাদিকের কলম কখনো হয়ে ওঠে রাইফেল আবার কখনো হয়ে ওঠে নতমুখী।সাংবাদিক হরেক রকম অস্ত্র নিয়ে চলেন; তিনি কখনো রচনা করেন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, আবার বিশ্লেষণধর্মী হয়ে ওঠে কখনো কোনও প্রতিবেদন; প্রতিবেদনে থাকতে পারে সত্যের উন্মোচন- তা যেমন সত্যি; আবার সত্য গোপনও ঘটে যেতে পারে অলক্ষ্যে।
হলুদ সাংবাদিকতা, এমবেডেড সাংবাদিকতার মতো অপ-সাংবাদিকতায় মাত্রা যোগ হয়ে এসেছে যেখানে সীমান্ত নাই, এমনই কপি-পেস্ট আর নীল সাংবাদিকতার নতুন ক্ষেত্র বিস্তার। খবর খোঁজার জন্য সাংবাদিকতা নাই। আছে দাম্ভিকতা। আছে লোলুপতা; 3W: War, Women and wine নিয়ে যত সংবাদ সৃষ্টি হয় বলে স্বতঃসিদ্ধ যে প্রস্তাব একদা উচ্চারিত ছিল তা এখন সাংবাদিকের ব্যক্তিলগ্নতার মধ্য দিয়ে নিজেদের করে তুলেছে সংবাদ তথ্য।

বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত হয়েছে তথ্যায়ন, যেখানে তথ্যকে আনয়ন করা হচ্ছে ভোগ্যপণ্যের অবাধ প্রসারে, উৎপাদক শ্রেণীর পোষকতায় এবং খাদকের মতো অন্তরে-বাহিরে।

ইন-ডেপথ রিপোর্টিং পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসলে ছোবলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে কেউ আপোষহীন হলেও গড্ডলিকার মতো দেখা যায়, বেশুমার আত্মসমর্পণ।

গণমাধ্যমের বহিঃরঙ্গে আছে যেমন ‘শক্তিদর্পী’ অবস্থান, অন্তরঙ্গে রয়েছে দুর্বলতার অধিষ্ঠান। বিজ্ঞাপনদাতারা সেখানে অশেষ দুর্বলতার উৎস। বিজ্ঞাপন হারিয়ে দিচ্ছে সংবাদকে।

গণমাধ্যম শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলে মানুষকে এবং বিজ্ঞাপনও মানুষকে শেখাচ্ছে অনেক কিছুর কানেকশন এবং কানেকশন- এখন গণমাধ্যমের পরিবেশনার উপাদান হয়ে উঠেছে বিজ্ঞাপন; বিজ্ঞাপন ও তথ্য সব একাকার হয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করছে, শিক্ষিত করছে। ফলে এক ধরনের pseudo তথ্য সমাজে বসবাস করছি আমরা।

অবিরাম তথ্য বৃষ্টিতে আমরা স্নাত হচ্ছি; ভারাক্রান্ত হচ্ছি; তথ্যায়নের পণ্যায়ন হচ্ছে আর পণ্যের তথ্য আনয়ন ঘটছে। তথ্যকে সিনক্রোনাইজেশন করে পাঠক-দর্শকের পক্ষে যেমন সম্ভব হচ্ছে না, তথ্য সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে অবসর মিলছে না, উপসংহার কিংবা অংক মেলানোর অবকাশ।

সংবাদভোগ্য মূঢ় পাঠক-দর্শক এখন নিশ্চুপ ও নীরব। বাঁচোয়া যে, আমাদের একটা শাহবাগ আছে, প্রেসক্লাবের ফুটপাথ আছে। স্ট্রিট ফাইটারদের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি হতে পারে এই জন্য যে, কেউ কেউ তো আছে সংবাদ বিদ্যায় পারদর্শী শতরঞ্জ কী খিলাড়ির জগৎ ভেদ করে অন্তর্দৃষ্টিতে পরিবীক্ষণ করতে সক্ষম, অতএব আমার হাতে সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার সাংবাদিক গদ্যের গ্রন্থ ‘বিষম দাবার চালে।’ এখানে পাওয়া গেল খবর খোঁড়ার ইতিবৃত্ত।

গণমাধ্যম বর্তমানে গণমানুষের চরিত্র হারিয়েছে। সেখানে গণমানুষের চেয়ে স্থান পায় প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি, সুশীল, আমলা ও মন্ত্রী-মিনিস্টার সংবাদ। গণমানুষের কাগজ গণমানুষের কথা বলে না। রাজ-রাজড়ার কথা বলে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে, সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা যখন আমাদের আঙুল দিয়ে দেখান যে কীভাবে দাবার চাল অশেষ হয়ে ওঠে এবং দাবার একেক চালে কী কী ঘটে- তা আমাদের জন্য অবশ্য পাঠের দাবি রাখে।

প্রবন্ধের সীমানায় অযাচিত হস্তক্ষেপ না করেও বলা যায় যে, সাংবাদিকতা-গদ্যের মধ্যদিয়ে সময়ের ভাষ্যকার হিসেবে তার উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। তিনি যেন সময়ের ধারাভাষ্যকার ও চিকিৎসক।

ধারাবিবরণী চলে সময়ের, রচিত হয় যে ভাষ্য, তাতে সাংবাদিক সুলভ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যুক্ত করেছেন, উসকে দিয়েছেন প্রশ্ন, বিস্তারিত করেছেন ভাবনা; পাঠকের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন অভিঘাত। আমরা খবর পড়তে অভ্যস্ত; কিন্তু নিউজ যেমন হয় তেমনি খবর নিয়ে তৈরি করা Views একটা সূক্ষ্ম সীমার মধ্যেও দৃষ্টিপাতে খুলে দেয় ঘটনার অতল স্পর্শ করার ছায়াপথ।

বলা যেতে পারে, হয়ে উঠতে পারে ঘটনা-খবরের ওপর ‘দৃষ্টিপাত।’-এই গ্রন্থে যা প্রকাশিত।

যে কোনও ঘটনা বা পরিস্থিতির ওপর আলোকপাতের মধ্যদিয়ে সামগ্রিকভাবে অবলোকনের ফলে একটি মানচিত্র রচনা করা সম্ভব।

‘সাহিত্য চর্চা নয়, বরং সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপট হতে লেখা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক ঘটনা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যুক্তির সীমার মধ্যে থেকে চেষ্টা করা হয়েছে।’- এই বক্তব্যে সম্মত হওয়ার প্রেক্ষিত রয়েছে তবে ‘যুক্তির সীমার মধ্যে’ কোথায় যেন কাটা বিঁধে আছে। নি:সন্দেহে বলা যায় গণমাধ্যম পরিস্থিতি এক্ষেত্রে খচ খচ করে বিঁধে থাকছে।

সম্প্রচার সাংবাদিকতায় অন্যতম প্রধান হিসেবে নিয়োজিত তাকে নিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মাধ্যমগত প্রতি ঘণ্টার সংবাদ প্রচার ও সংবাদ ভিত্তিক অনুষ্ঠানে সংবাদ নিয়ে চুলচেরা পরিবেশনা এমনকি বিস্তারিত আলোকপাত ‘সময়’ এর আটোসাটো বাঁধায় স্বাভাবিকভাবে পরিপূর্ণ রূপায়িত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। শুধু তাই নয়, সংবাদ পত্রের মতো সেখানে স্থায়ী স্বরূপ ধরে রাখা যায় না; ক্লোজ-আপ মিডিয়ায় ঘটনা থেকে সংবাদ তথ্য থেকে সংবাদ সম্প্রচারকালীন উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, বটে তবে সেই খবরের ঠিকানা আগামীতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

এই অভাব বোধ এবং বাই-ডিফল্ট সীমাবদ্ধতাকে উৎড়াই হিসেবে মোকাবেলা করতে চলমান সময়ের ঘটে যাওয়া কাণ্ড-কারখানার লিখিত ও মুদ্রিত স্বরূপটি উপস্থাপন করেছেন অসামান্যতায় এবং তার নিজস্ব অন্ত:শীল ভাবনায়।

সৈয়দ ইশতিয়াককে বিচলিত করেছে এবং সমাজ-দেশ আক্রান্ত হওয়ার আশংকা উপলব্ধ হয়েছে বলেই জরুরি হয়ে উঠেছে কালবেলায় যখন কুলায় কালস্রোত তখন কলম হাতে তিনি বিস্তারিত অক্ষরপাতে আকর্ষিত করেছেন পাঠকের দৃষ্টি।

তথ্য ও সংবাদের মধ্যে রয়েছে পার্থক্য। তিনি তথ্যস্নানের বর্তমান দিশাহারা পরিস্থিতিকে ব্যবচ্ছেদ করে তথ্যক্রমের মিছিলকে নির্দিষ্ট অভিমুখে পরিচালনার দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছেন। সত্যের প্রতি ইপ্সাকে তিনি সংহত করার জন্য অজস্র তথ্য ভারাক্রান্ত সংবাদ সাম্রাজ্য থেকে পাঠককে সূত্রবদ্ধ তথ্য ভিত্তিক লক্ষ্য অভিমুখী হয়ে সত্যের নিকটবর্তী থেকে বিভ্রান্তির উপকূল ছেড়ে নোঙর গুটিয়ে নতুন দীপমালার দিকে আগুয়ান হওয়া সম্ভব হতে পারে তেমন নকশা ও সূত্র; বিশ্লেষণের হাতিয়ার পাঠকের জন্য অবারিত করার সাক্ষর রেখেছেন বলে মনে করি।

স্বদেশের মানচিত্রে ডানা মেলেছে অজস্র শকুন। মুক্তিযুদ্ধ আজও শেষ হয় নাই; স্বাধীনতা অর্জন করেছি- এই যে স্বাদ হীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না, পতাকা বহনের শক্তি নড়বড়ে করে তুলছে- কুযুক্তি আর কুতর্ক- এই মন্দ প্রবণতায় আশংকিত বাংলাদেশ সমাজ প্রয়োজন অনুভব করছে যেন দাবা খেলার কূটচাল চুরমার করার আকাঙ্খা- সেই অনুভবের প্রতি সম্মান দিয়েছেন সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।

আমরা মনে করতে পারব, নির্মল সেনের সেই অসামান্য সাংবাদিকতা- গদ্য গ্রন্থ ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।’ নির্মল সেন লিখেছিলেন- সত্যকে হত্যা করে সত্যের প্রার্থনা করতে পারেন না; যেখানে বিধৃত হয়েছিল স্বাধীনতার বছরপূর্তি না হতেই সত্যকে হত্যাকারীরা কীভাবে স্বমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করছে এবং চোখে আঙুল দিয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন, কাদের আশ্রয়ে দুর্যোগের ঘনঘটা তৎকালে জাহির হচ্ছে।

সে সময়ে তার লেখনীতে সোচ্চার চিত্তে প্রকাশ করেছিলেন সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্রকারীরা কোন অভিপ্রায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় প্রতিপন্ন করার মিশন গ্রহণ করেছিল।

তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন, সেই অকালে কালবেলায় নিত্যদিনের সন্ত্রাস ও শংকার মৃত্যু কাম্য নয়। চাই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। স্বাভাবিক মৃত্যু তখন ছুটি নিয়েছিল।
এই সব লেখায় ছিল সাংবাদিকের কলমে সময়ের ভাষ্য এবং অবলোকিত পরিস্থিতির ভেতর সত্য নির্মাণ এবং আধ-মরাদের ঘাঁ দিয়ে বাঁচিয়ে তোলার তাগিদ।

নির্মল সেনের লেখনী পাঠক সমাজের মধ্যে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল তা বলা বাহুল্য।

আমি ভয় পাই- নির্মল সেন লিখছেন যে, ১৯৭২ -এর ফেব্রুয়ারি মাসে কেমন যেন ভীতি অনুভূত হচ্ছে। ১৯৭১-এর ন’মাসে ভয়ের যে আকার-প্রকার ছিল তা ভয় সৃষ্টি করতে না পারলেও দেশ স্বাধীনের পর ভয় আর আতংক আরো বেশি ঘনীভূত।

তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, সচেতনতা সৃষ্টিকে অবলম্বন করেছিলেন, শুভবুদ্ধির প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। ‘আবার শুরু হলো বোমাবাজি। কেউ লক্ষ্য করল না। এ ঘটনা গড়িয়ে গেল… অন্যায়কে অন্যায় মনে হচ্ছে না… চার মাস পূর্বের আমাদের সংগ্রামী মানসিকতা আজ বিভ্রান্ত। … এই বিভ্রান্তির সুযোগেই ষড়যন্ত্রের শিকার বড় হচ্ছে। … পলিমাটি সৃষ্টি করাই হচ্ছে ষড়যন্ত্রকারীদের একমাত্র উদ্দেশ্য। যদি এ ধরনের একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায়, যদি আজ সেখানে কাল ওখানে বোমা ফাটানো যায় তাহলে এর মধ্যে একটি বোমা তাদের বাঞ্ছিত স্থানে রেখে কাজ হাসিল করা সম্ভব হবে। … যারা রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য হত্যার আশ্রয় নিচ্ছে তারা আর পাঁচটি ঘটনার আড়ালে নির্বিঘ্নে মিলে যাচ্ছে জনতার ভীড়ে। আজ মানুষ বিভিন্ন সমস্যায় বিব্রত। হত্যাকাণ্ড আজ আর চমক দেবার মতো নয়। … এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য আমরা কোন মতেই কম দায়ী নই।’

স্বাধীনতার প্রথম বছরে যে পরিস্থিতির উৎপাত তা আজ পঁয়তাল্লি­শ বছর পর বিষবৃক্ষ হয়ে বিষাক্ত নি:শ্বাসে জর্জরিত করছে। তীব্রতা ব্যাপক হয়েছে। আরো জ্বালাময়ী হয়ে উঠেছে।
সৈয়দ ইশতিয়াকের এই গ্রন্থময় পাঠ্যক্ষেত্রে ভ্রমণ করলে সেই প্রথম জমানার সঙ্গে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং নতুন মাত্রায় নতুন ঘনঘটায় বিপদ-আপদ বড় তীব্র হয়ে আমাদের অস্তিত্বকে সময়ের অজগর গ্রাসে পরিণত করছে। অবলম্বন তাই বিষম দাবার চালে আমাদের আত্মসাক্ষাতকার কতটা সহায়ক।

সৈয়দ ইশতিয়াক ধ্যানস্থ হয়ে উত্তাপহীন যে গদ্য প্রকাশ করেছেন তা থেকে নৈরাশ্যবাদী নই আমরা একটি স্বর খুঁজে নিতে চাই- পুরানো আলো নিভেছে, নতুন আলো জ্বলেনি। রাষ্ট্র কী কিছু দেখছে না?

বিষম দাবার চালে
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
শ্রাবণ প্রকাশনী
মূল্য: ২৫০ টাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সৌজন্যে: বইনিউজ