চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ঢাকা শহরের গাড়িগুলো সবচেয়ে নিষ্ঠুর

৩ এপ্রিল রাত ১০ টায় স্ত্রীর বাম পায়ে প্লাস্টার করার জন্য পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের সামনে যেতেই দেখি দুই মহিলা অঝোরে কাঁদছেন। পাশে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছেন এক তরুণ। দাঁড়ানো তরুণকে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তিনি দুপুরে পান্থপথের সার্কফোয়ারা মোড়ে হাত হারানো তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হাসানের করুণ কাহিনীর কথা বললেন।

ততক্ষণে রাজীবের অপারেশন শেষ হয়নি, অপারেশন চলছে। মা-বাবা হারানো রাজীবের আপন দুই খালা জাহানারা এবং খাদিজা অঝোরে কাঁদছিলেন। কান্না কিছুটা থামলে তাদের কাছ থেকে জানতে পারি দুপুরে ঘটে যাওয়া পান্থপথের সার্কফোয়রা চত্বরের নিষ্ঠুর নির্মম ঘটনা। ততক্ষণে অনলাইন পত্রিকাগুলোতে রাজীবের হাত হারানোর করুণ কাহিনীর খবর চলে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে সবাই কমবেশি জেনে গেছে-রাজীবের একটি হাত শরীর থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে দুই সন্ত্রাসী বাসচালক। তবে পরের দিন স্তম্ভিত হই দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পাতায় লিড হিসেবে ছাপা হওয়া ছবিটি দেখে। বেপরোয়া, নিষ্ঠুর দুই বাসের মাঝে রাজীবের শরীর থেকে ছিঁড়ে যাওয়া আটকে পড়া রক্তাক্ত একটি হাত ঝুলছে। অনেকক্ষণ ধরেই রাজীবের এই বিচ্ছিন্ন হওয়া হাতটি ঝুলে ছিল। শত শত মানুষ সেটি স্বচক্ষে দেখে বিস্মিত ও স্মম্ভিত না হয়ে পারেননি।

রাজধানীতে অনেক বাস দুর্ঘটনা ঘটলেও নিকট অতীতে এরকম নিষ্ঠুর ছবি নগরবাসী দেখেছে বলে মনে হয় না। কিন্তু বেপরোয়া চালকদের কারণে এই নিষ্ঠুর চিত্র মানুষকে দেখতে হলো। ৩ এপ্রিল বিআরটিসির একটি বাস এবং স্বজন পরিবহন এই দুটি বাসের অশুভ প্রতিযোগিতার কারণেই তরুণ রাজিবকে হাত হারিয়ে এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে হচ্ছে। গত কয়েক দিন ধরে নিবিড় চিকিৎসার পরও রাজীবকে নিয়ে অনেক আশংকাই থেকে যাচ্ছে। সর্বশেষ চিকিৎসকরা বলেছেন রাজীবের মাথায়ও প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে। ফলে তারা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না, রাজিব নিশ্চিত সেরে উঠবেন কি উঠবেন না।

রাজীবকে দেখতে গিয়েছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা মোহাম্মদ নাসিম এমপি। তিনি রাজিবের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং রাজিব সুস্থ হলে তাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এদিকে ঘটনার পরেরদিনই আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রাজিব হাসানের চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার গ্রহণে অভিযুক্ত দুইবাসের মালিককে নির্দেশ প্রদান করেন। সাথে ক্ষতিপূরণ বাবদ এক কোটি টাকা প্রদানের নির্দেশ দেয়া হবে না তাও জানতে চেয়েছেন।

অল্প বয়সে মা-বাবা হারানোর কলেজ ছাত্র রাজিবের মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। নীতি-নির্ধারকরা খানিকটা নড়েচড়েও বসেছেন। কিন্তু এটাওতো নিশ্চিত যে কয়েকদিন পর আরেকটি নতুন ঘটনার নিচে চাপা পড়ে যাবে এই হ্নদয় বিদারক ঘটনা। আমাদের আবেগ ভাবাবেগগুলোও হারিয়ে যাবে। এরপর আবার যা ছিল তাই হবে। আমরা দেখেছি এই নগরীতে এর আগেও বেপরোয়া বাস কেড়ে নিয়েছে অনেক শিক্ষার্থীর প্রাণ। এইতো গত বছর মিরপুর আইডিয়াল স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তাসলিম আলম তৃষাকে চাপা দিয়ে হত্যা করে তেতুলিয়া পরিবহনের এক চালক। ২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি সেগুরবাগিচার বেগম রহিমা আক্তার উচ্চ বিদ্যালয়ের জেএসসিতে এ প্লাস পাওয়া ছাত্রী সাবিহা আক্তার সোনালী বাস চাপায় মারা যান।

ডা. তৃষ্ণা রাণী মোদকের কথা নিশ্চই অনেকের মনে আছে। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ থেকে সদ্য এমবিবিএস পাশ করা এই তরুণীকে ২০১৬ সালে ৩ আগস্ট কলাবাগানে মিরপুর লিংক নামে একটি বাস চাপা দিয়ে হত্যা করেছিল। বছর তিনের আগে এসএসসিতে ‘এ’ প্লাস পাওয়া মারাজানা জাহান মুনমুনকেও বাস চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল রাজধানীর মুগদা এলাকাতে। এরকম আরো অনেক নির্মম ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে এই রক্তাক্ত নগরী। সেই ধারাবাহিকতা এখনও চলমান রয়েছে।

তবে রাজিবের শরীর থেকে ছিন্ন হয়ে যাওয়া রক্তাক্ত হাতটি এই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এই শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থা কতটা বেপরোয়া, ভয়াবহ এবং বিভৎস। রাজিবের ঘটনা কোনোভাবেই দুর্ঘটনা ভাবার অবকাশ নেই। আমরা যারা নিত্য গণপরিবহনে যাতায়াত করি তারা জানি রাজধানীর গণপরিবহনে কতটা নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে। রাজধানীর বিভিন্ন রুটে যে কয়েক হাজার গণপরিবহন চলাচল করে, চলার পথে তারা আসলে কোনো নিয়ম-নীতিই মানে না। তারা তাদের ইচ্ছেমতো চলাচল করে। যেখানে সেখানে গাড়ি দাঁড়িয়ে রাখা, স্টপেজের বাইরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলা, রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অন্যের যাতায়াতে বাধা সৃষ্টি করা, ওভারটেক করা এসব তাদের কলঙ্কময় চরিত্রের বড় এক উপাদান।

প্রায় সময়ই দেখা যায়, যাত্রী তোলার লোভে এক গাড়ি অন্যগাড়ির সাথে বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় নেমে ইচ্ছেমতো গাড়ি চালাচ্ছে। পান্থপথের সার্কফোয়ারার যেখানে রাজিবের ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না বাস অশুভ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে। রাজধানীতে যতগুলো চত্বর আছে সন্দেহ নেই এর মধ্যে ভয়ংকর এক চত্বর হলো সার্কফোয়ারা চত্বর। এখানে যাত্রীদেরকে সবসময়ই হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে বাসের জন্যে যেমন অপেক্ষা করতে হয়, তেমনি বাস থেকে নামতে হয়। এই চত্বরে প্রতিদিনই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এই চত্বরটি খুবই বিপজ্জনক।

ঢাকা শহরে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী পরিবহনগুলো এখন সামান্য নিয়ম-কানুন মানে বলে মনে হয় না। এর বড় প্রমাণ হলো আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতার কারণে কেউই সিগন্যাল মানতে চায় না। নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়ায় না। বেশিরভাগ পরিবহন নিয়ম ভঙ্গ করে জেব্রাক্রসিং বা নির্দিষ্ট দাগ দেওয়ার স্থানের পরিবর্তে কয়েক গজ সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এরমধ্যে সামনের গাড়িগুলো থেমে না থেকে একটু একটু করে সামনে এগুতে থাকে। এতে করে পথচারীদেরও অনেক ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হতে হয়। আবার সব গাড়িই সবার আগে যাওয়ার জন্যে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ে।

রাজধানীর রাস্তার জেব্রাক্রসিংগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে অনেক আগেই। কোথাও এখনও আর জেব্রাক্রসিং নেই। যেখানে আছে সেটাও বোঝার উপায় নেই। কারণ বেপরোয়া বিভৎস চরিত্রের গাড়িগুলো আগেই জেব্রাক্রসিং এর উপর এসে দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে অনেক স্থানের চরম ঝুঁকি নিয়ে যাত্রী বা পথচারীদের রাস্তা পারাপার হতে হয়। জেব্রাক্রসিংগুলো দৃশ্যমান না থাকায় খুবই বিরক্তিকরভাবে বাস, প্রাইভেটকার রাস্তা পারপারের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে সাধারণ যাত্রীরা বাসে ওঠা ও নামার জন্য তেমন একটা জায়গা পান না। এসব কারণেও প্রতিদিনই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। 

সন্দেহ নেই ঢাকা শহরের গাড়িগুলো সবচেয়ে বেপরোয়া, সবচেয়ে নিষ্ঠুর। মানুষের জীবন তাদের কাছে একেবারেই তুচ্ছ। এই নৈরাজ্যকর ভীতিকর অবস্থা অনেকদিন ধরেই চলমান। বাস, প্রাইভেটকারের বেপরোয়া আচারণের কারণেই মুখ থুবড়ে পড়েছে ট্রাফিক সিস্টেম। যানজটেরও অন্যতম কারণ নিয়ম-কানুন না মেনে গাড়ি চলাচল না করা। পরিবহনগুলো নিয়ম ভাঙতে ভাঙতে এখন এমন অবস্থায় গিয়েছে বাস ধরার জন্য কোনো যাত্রীকে আর স্টপেজে যাওয়া লাগে না। বাস নিজেই যাত্রীর কাছে চলে আসে। রাস্তার যেখানে যাত্রী সেখানেই বাস হুট করে দাঁড়িয়ে পড়ে।

গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও বাস্তবে কিছুই হয়নি। কোনদিন হবেও বলে মনে হয় না। কেননা যারা নীতিনির্ধারক, আমলা, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তারা গণপরিবহনে চড়েন না। গণপরিবহনের সমস্যার মুখোমুখি তাদের হতে হয় না। গণপরিবহনে চড়ে এই শহরের ছোট লোকগুলো। ছোটলোকের রক্তাক্ত হাত যতই দুই বাসের মাঝে ঝুলে থাকুক এতে বড় লোকের হ্নদয়ে রক্তক্ষরণ হবে বলে মনে হয় না।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।