শতবর্ষ পূরণ করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উপলক্ষ গর্বের, আবেগের। বিষাদও আছে। ১৯৭১ সাল আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণের বছর। আমাদের এ ভূখণ্ডের স্বাধীনতার জন্য শত শত বছরের আকাঙ্ক্ষা ছিল, বিচ্ছিন্ন ও সংগঠিত প্রয়াস ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, কর্মচারী ও শিক্ষকরা স্বপ্ন পূরণের সারথী হয়ে উঠলেন, যা তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তার সঙ্গে এক মোহনায় মিলেছিল। ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি খ্যাতিমান সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে সাক্ষাৎকালে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো?’ উত্তর এসেছিল- ‘সেই ১৯৪৭ সালে। … একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলা ভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে। ভাষাভিত্তিক আন্দোলনই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে।… তারপর স্লোগান দিই, জয় বাংলা।’
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানেই ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনে উত্তোলন করা হয় লাল-সবুজ-সোনালী রংয়ের পতাকা, যা মাত্র দেড় মাস যেতে না যেতেই জাতীয় পতাকার স্বীকৃতি পায়। এ পতাকার মর্যাদা রাখতে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দু’শ জন ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-কর্মচারী জীবন বিলিয়ে দেয়। স্বাধীনতার জন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এতজনের আত্মত্যাগের নজির বিশ্বে বিরল।
১৯৭১ সাল ছিল ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ যে জেনোসাইড শুরু করে, তার অন্যতম প্রধান টার্গেট ছিল আমাদের প্রিয় এ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি হানাদারদের ক্ষোভ-রোষ-বিদ্বেষ এতই প্রবল ছিল যে কলাভবনের সামনের বট গাছটি তারা শিকড়সহ উপড়ে ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত শহীদ মিনার ধূলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়। চা-সিঙ্গারা বিক্রির অতি সাধারণ মধুর ক্যান্টিনটিও বাদ যায় না। তখন শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিত হওয়া মানেই হানাদার কিংবা তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হওয়ার শঙ্কা। এমন ভয়ঙ্কর সময়ে, এই মৃত্যু উপত্যকায় কেউ কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের কথা ভাবতে পারে?
আমাদের দুর্ভাগ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের যে বছরটি একইসঙ্গে পালিত হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী হিসেবে, আনন্দ-উৎসবে পালন তো দূরের কথা, এমনকি ঘরোয়া অনুষ্ঠান করারও সুযোগ নেই। গোটা বিশ্ব একযোগে গ্রাস করা ভয়ঙ্কর ব্যাধি করোনা আমাদের ঘরবন্দি করে রেখেছে। কবে এ থেকে নিষ্কৃতি মিলবে, কেউ বলতে পারে না।
স্বাধীনভাবে কাজ পরিচালনার সুযোগদানও গুরুত্বপূর্ণ। কোনো শিক্ষক কিংবা কোনো বিভাগ থেকে মৌলিক গবেষণার প্রস্তাব এলে যদি বিশ্ববিদ্যালয় তার অনুমোদন প্রদানে সময়ক্ষেপণ করে? যদি সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ে তা আটকে পড়ে থাকে?
অন্যভাবেও বিষয়টি দেখা যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রছাত্রীদের অনেকে বাংলাদেশের ভেতরে কিংবা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভাল অবস্থানে রয়েছেন। তারা নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য ফান্ড কিংবা প্রযুক্তি হস্তান্তর করায় উদ্যোগী হতে গিয়ে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাংলাদেশ সরকারের কাছে হোচট খায়? যদি তাদের সামনে বাধানিষেধের প্রাচীর দাঁড়া করানো হয়?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই এ সব বিষয় স্পষ্ট করতে হবে। শতবর্ষ উপলক্ষে তারা একশ’ বিশেষ ধরনের গবেষণার বিষয় নির্বাচন করতে পারে। এ জন্য সাবেক ছাত্রছাত্রীদের কাছে তহবিল ও পৃষ্ঠপোষকতার আবেদন যেতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শত শত ধনাঢ্য পরিবারের অভ্যুদয় আমরা দেখছি। বিগ বিজনেস হাউজ গড়ে উঠছে। তাদের বিকাশের জন্য গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। দেশের প্রয়োজনও তাদের ভাবতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কেন এ নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলবে না?
আমরা রিভার্স ব্রেন ড্রেন চাই। মেধাবীদের ফিরিয়ে আনতে চাই। যারা বাংলাদেশের বাইরে চলে গেছেন, সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন তাদের সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিকভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। কিন্তু তথ্য-প্রযুক্তির যে বিকাশ আমরা দেখছি তাতে শারীরিক উপস্থিতি সব ক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়। বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সম্ভব। শ্রেণিকক্ষে কিংবা নিজের ঘরের পড়ার টেবিলে থেকেও বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকে অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের আলোচনা শোনার ব্যবস্থা করা যায়। অধ্যাপক রেহমান সোবহান নিজের বাসায় বসে বলবেন, কিন্তু একইসঙ্গে অনেক অনেক ছাত্রছাত্রী শুনবেন, এটাও সাধারণ বিষয় হয়ে গেছে। একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যারা রয়েছেন তাদের অনেকেও দেশের ভেতরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। বাংলাদেশের শত শত কলেজে এখন অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। যোগ্য-দক্ষ শিক্ষকের চাহিদা সর্বত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকেই নিজের ঘরে বসে তাদের ক্লাস নিতে পারেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ যে সুবিধা সৃষ্টি করে দিয়েছে, আমরা কেন তা আরও ভালভাবে কাজে লাগাব না?
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মোবাইল টেলিফোন, ল্যাপটপ ও অন্য প্রযুক্তির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে। দু’পক্ষ অত্যাধুনিক মোবাইল-ল্যাপটপ সেট ও ইন্টারনেট সংযোগের বিষয়ে চুক্তিতে উপনীত পারে। অনুদান আসতে পারে, বিলম্বে মূল্য পরিশোধ হতে পারে। সাবেক শিক্ষার্থীদের এ মহতী উদ্যোগে সামিল হওয়ার আহ্বানে যেতে পারে।
শতবর্ষ উদযাপন কেবল মিছিল-সমাবেশ, স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিষয় নয়। এ সব অবশ্যই প্রয়োজন। করোনাকালে এ ধরনের কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী করা যায়নি। এ জন্য হতাশা আছে। সুদিনের জন্য তা তুলে রাখতে সমস্যা নেই। কিন্তু সাবেক ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট হতে করোনা বাধা নয়। তাদের আমরা যুক্ত করতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। যারা সরাসরি ফিরে আসবেন, তাদের জন্য পরিকল্পনা চাই। যারা অন্যভাবে যুক্ত হতে চাইবেন- তাদের জন্যও পরিকল্পনা চাই। প্রকৃতপক্ষে এটাই হতে পারে মূল ফোকাস। আমরা আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানকে দেখতে চাই বিশ্বসেরাদের কাতারে। এ জন্য অপরের ওপর নির্ভরতা কেন? আমাদের নিজেদেরই তো অনেক রিসোর্স রয়েছে। অনেকে তো হাত বাড়িয়ে আছেন কিংবা অপেক্ষা করছেন সামান্য আমন্ত্রণের। তাদের কাছে আমরা কেন পৌঁছাব না? মেধাবীদের আমরা ফিরিয়ে আনতে চাই। তারা নানাভাবে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান উদ্যোগ আসতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)