বিকেল চারটার আগেই রাজধানীর কৃষিবিদ ইন্সটিটিউট মিলনায়তন কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আগতরা এসেছেন নোবেল জয়ী মারেইড ম্যাগুয়ার, শিরিন এবাদি এবং তাওয়াক্কাল কারমানকে নিজ চোখে দেখতে, সংগ্রামী তিন নারীর জীবন সংগ্রামের কথা নিজ কানে শুনতে। নিরাশ হতে হয়নি তাদের।
উত্তর আয়ারল্যান্ডে স্বজন হারিয়ে শান্তির জন্য অহিংস আন্দোলনের কথা শোনালেন মারেইড ম্যাগুয়্যার, জানালেন এখনো মানবতার জন্য রোহিঙ্গা এবং সিরিয়ার জনগণের হয়ে পশ্চিমা বলয় থেকে বের হয়ে মানুষের জন্য দাঁড়ানোর প্রত্যয়। প্রবাদপ্রতীম শিরিন এবাদির কথা শ্রোতারা শুনলেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। শিরিন এবাদি জানালেন ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর পছন্দের পেশা থেকে তাকে জোর করে সরানো এবং এরপর থেমে না যেয়ে পাল্টা প্রতিবাদের কথা। এই দুই নোবেল জয়ীর চেয়ে কনিষ্ঠ হলেও রাজপথে পেশার প্রতি দায়িত্বশীল-আন্তরিক এক সাংবাদিকের অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে ওঠার গল্প শোনালেন ইয়েমেনের তাওয়াক্কল কারমাইন। ২০১১ সালে নোবেল জয়ীর এই গল্প রূপ কথার গল্প নয়। তার কথাগুলো যেন আরব বসন্তে সাধারণ ইয়েমেনিদের প্রত্যাশার প্রতিফলন।
শনিবার বাংলাদেশে আসার পর থেকে এই তিন নোবেল জয়ী নারী রোহিঙ্গাদের কথা শুনেছেন, তাদের পক্ষে মানবতার দৃঢ় অবস্থান জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার তাদের ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে। এর আগে বুধবার বিকেলে সংগ্রামী নারীদের প্রতীকে পরিণত হওয়া এই তিন নোবেল জয়ী নারীপক্ষের ‘জীবন ও সংগ্রামের পথে’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে আসেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে নারীপক্ষের হয়ে অনুষ্ঠান সঞ্চালক শিরিন হক সদ্য প্রয়াত মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীরকে স্মরণ করেন। পাকিস্তানের মতো দেশের নাগরিক হয়েও মানবতার পক্ষে সদাসরব আসমাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নোবেল জয়ী তিন নারীসহ অনুষ্ঠানে আগতরা এক মিনিটের নিরবতা পালন করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই বক্তব্য রাখেন ১৯৭৬ সালে শান্তিতে নোবেল জয়ী মারেইড ম্যাগুয়্যার। তখন তিনি বিশ্বজুড়ে মানবতার সংকটের উদাহরণ হিসেবে রোহিঙ্গা এবং সিরীয়দের কথা তুলে ধরেন। রোহিঙ্গা নিধনে নোবেল জয়ী অং সান সুচির নীরবতার সমালোচনা করেন তিনি।
তিনি বলেন: টেলিভিশনে দেখি বিশ্বজুড়ে অমানবিকতা চলছে। দেখছি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিধন, পানিতে ভাসা লাশ, প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে তাদের আশ্রয় নেয়ার দৃশ্য। মিয়ানমারে যা হচ্ছে তাকে গণহত্যা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ তাদের জন্য দেশের সীমান্ত খুলে দেয়ার মাধ্যমে হৃদয় খুলে দেয়া মানবতাই প্রকাশ করেছে।
মানবতার জন্য সোচ্চার হওয়া সংগ্রামী জীবনের কথা তুলে ধরে মারেইড বলেন: মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সহিংসতার জন্ম দেয়। জাতিগত, ধর্মীয় বিভেদের সুযোগকে সুযোগ সন্ধানীরা কাজে লাগায়। উত্তর আয়ারল্যান্ডেও জাতিগত বিভেদের চরম পরিণতি দেখতে হয়েছে, স্বজন হারাতে হয়েছে। জাতিগত পার্থক্যের কারণে শৈশবে আমাদের আলাদা স্কুলে পড়তে হয়েছে। এই পৃথক করে রাখায় দানা বাঁধে অবিশ্বাস-অশ্রদ্ধা এবং অমানবিকতা। নরকের মধ্যে বসবাস করছিলাম আমরা। সেখানে ক্যাথলিক এবং প্রটেস্টান্টদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে আমার ছোট বোনের তিন শিশু সন্তান নিহত হয়। আমার বোন এই আঘাত সহ্য করতে পারেনি। আমার বোন আত্মহত্যা করে। স্বামী এবং একমাত্র জীবিত সন্তানের জন্য চিরকুটে লিখে যায়, “মাফ করে দিও, পারলাম না, তোমাদের ভালোবাসি”।
নিজের এতো কাছের স্বজন হারানোর পরও আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি এবং ব্রিটিশ আর্মির মতো সহিংসতায় যাননি মারেইড। তিনি বেছে নেন শান্তির পথে শান্তির আনার পথ। এই পথ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: আয়ারল্যান্ডে এমন পরিস্থিতিতে আমাদের রাস্তায় ব্রিটিশ সেনা নামানো হয়। অথচ সেটা কোন সমাধান ছিল না। তাই আমি এবং বেটি উইলিয়ামস গড়ি তুলি শান্তির জন্য অহিংস আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম ‘পিস পিপল’ অর্থাৎ শান্তির জনতা।
মারেইডের পর কিংবদন্তী তুল্য ইরানি নারী শিরিন এবাদি শুরু করেন জীবনের গল্প। শুরুতে আসমা জাহাঙ্গীরকে স্মরণ করেন তিনি। এরপর ইরানে শাহ শাসনের অবসান ও ইসলামি বিপ্লবের পরিণতি তুলে ধরে তিনি বলেন: ১৯৭৯ সালের আগ পর্যন্ত আমি ছিলাম বিচারক। এই পেশাকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের পর নারী হওয়ায় আমাকে এই পেশা ছাড়তে বলা হলো। আমি কিন্তু এতে কষ্ট পেয়ে চুপ করে মেনে নিইনি। উল্টো আইন সহায়তার ফার্ম খুললাম। সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে সেসব মানতে অস্বীকৃতি জানানো শুরু করলাম। ইসলামের নামে সেখানে যা হচ্ছিলো সেগুলো তুলে ধরতে শুরু করলাম। পাথর মেরে মানুষ হত্যা শুরু হলো, কব্জি কেটে নেয়া শুরু হলো। বিচার ব্যবস্থায় নারীর প্রতি বৈষম্য চাপিয়ে দেয়া হলো। অথচ প্রকৃত ইসলাম মানবাধিকারের কথা বলেছে। তাই এসবের বিরুদ্ধে আমার লেখালেখি চললো। কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হলাম । বিশ্বে আমার প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকে, ২৬টিরও বেশি সম্মান সূচক ডিগ্রি পাই আমি। আমার খ্যাতি যতো বাড়ছিলো সরকার আমার প্রতি ততো হিংস্র হচ্ছিলো। আমাকে চুপ করাতে আমার পরিবারকে জিম্মি করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল আমি থামলে ওদের ছেড়ে দেয়া হবে। উত্তরে আমি বলেছিলাম অবশ্যই আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি, কিন্তু সত্য বলাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।এবাদির এই দৃঢ় ব্যক্তিত্ব প্রকাশের পর বক্তব্য রাখেন ইয়েমেনে আরব বসন্তের অন্যতম অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে অহিংস আন্দোলনকারী তাওয়াক্কল কারমান। ২০০৭ সাল থেকে একজন নারী সাংবাদিক হিসেবে তৎকালীন ইয়েমেন সরকারের কট্টর অবস্থান, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদের কথা জানান তিনি।
‘দ্য মাদার অব দ্য রেভ্যুলুশন’ খেতাবে ভূষিত এই নোবেল জয়ী বলেন: মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য অন্যদের সংগঠিত করতে ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করি ‘উইমেন জার্নালিস্টস উইদাউট চেইনস’। বারবার তৎকালীন সরকারের রোষের মুখে উদ্যত বন্দুকের সামনে শান্তির ফুল হাতে হাসিমুখে দাঁড়িয়েছি আমরা। এরপর ২০১১ সালে ইয়েমেনে তিউনিসে শুরু হওয়া আরব বসন্তের ছোঁয়া লাগে। স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়।
আলোচনা অনুষ্ঠানে নোবেল জয়ী তিন বক্তাই বিশ্ব মানবতার পাশে সর্বদা দৃঢ় অবস্থানের প্রতিশ্রুতি জানান এবং মানবিক সবাইকে এক হওয়ার আহ্বান জানান অমানবিকতার বিরুদ্ধে।