চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: এক অন্যরকম গীতিকবির কথা

৩ সেপ্টেম্বর ছিল দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকবি ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ১১ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৮ সালে এই দিনে তিনি প্রয়াত হন। যশোরের খড়কীতে জন্ম নেওয়া মানুষটি ছিলেন অধ্যাপক, কবি এবং ভাষাবিজ্ঞানী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনার সাথে যুক্ত ছিলেন। সাহিত্য সাধনা করেছেন জীবন অব্দি। তবে ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান অনেক উঁচুমাপের গীতিকবি হলেও তা অনেকের কাছেই যেনো অজানা এক অধ্যায়।

সেই পঞ্চাশ দশকের শেষ লগ্ন থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি অসংখ্য কাব্য সৌন্দর্যময় জনপ্রিয় গান রচনা করে গেছেন। বিশেষ করে সিনেমার জন্য তাঁর রচিত অনেক গানই কালজয়ী। অনেকের মতেই আধুনিক কবি কাজী নজরুল ইসলামের পর আমাদের দেশে কাব্য নির্ভর গান রচনার ক্ষেত্রে তিনি এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। রেডিও, সিনেমাতে তিনি যত গান লিখেছেন তার বেশিরভাগই শ্রোতা কর্তৃক সমাদৃত ও নন্দিত হয়েছে।

ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখক জীবনের ইতিহাস খুঁজে দেখা যায় মূলত পঞ্চাশ দশকের শেষ লগ্নে তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মূলত সে সময় থেকেই গান রচনায় মনোনিবেশ করেন। সে সময় তিনি বন্ধু, সতীর্থ, অগ্রজ হিসেবে যে সব গানের মানুষের কাছে পান তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-শিল্পী সুরকার আনোয়ার উদ্দিন খান এবং খন্দকার নুরুল আলম। এরপর ধীরে ধীরে তার সখ্যতা গড়ে উঠে দেশের স্বনামধন্য সুরকার আব্দুল আহাদ, আলী হোসেন, আব্দুল লতিফ, সমর দাস, সত্য সাহা, দেবু ভট্টাচার্য, সুবল দাস, আজাদ রহমান, জালাল আহমেদ, আলম খানসহ আরো কেউ কেউ। এদের মধ্যে বর্তমানে বেঁচে আছেন শুধু মাত্র সুরকার আজাদ রহমান এবং আলম খান। অন্যরা সবাই আগে পরে প্রয়াত হয়েছেন। উল্লিখিত সুরকারদের করা অপূর্ব সুরেই তার লেখা প্রচুর গান কালজয়ী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

ষাট সত্তর দশকে তার লেখা সিনেমার গান সঙ্গীত প্রেমিকদের মাঝে অন্যরকম এক মুগ্ধতা ছড়ায়। প্রখ্যাত সিনেমা পরিচালক মুস্তাফিজ পরিচালিত ডাক বাবু (১৯৬৬), নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত চাওয়া পাওয়া (১৯৬৭), এতটুকু আসা (১৯৬৮), ছন্দ হারিয়ে গেল (১৯৭২), দ্বীপ নিভে নাই, নীল আকাশের নিচে (১৯৬৯), মমতাজ আলী পরিচালিত নতুন নামে ডাকো, কামাল আহমেদ পরিচালিত অশ্রু দিয়ে লেখা (১৯৭২), জহীর চৌধুরী পরিচালিত পরশ মনি, আলমগীর কবীর পরিচালিত ধীরে বহে মেঘনা (১৯৬৯)সহ আরো অনেক সিনেমার গান রচিয়তা তিনি। সিনেমার প্রতিটি গানই তিনি লিখেছেন হ্নদয় থেকে। যেখানে যেমন পরিষ্ফুটিত হয়েছে বাঙালি মধ্যবিত্তের বঞ্চনা, তেমনি হ্নদয়ের কথাও। এতটুকু আসা ছবিতে তাঁর লেখা এবং আব্দুল জব্বারের নিপুণ কণ্ঠে গাওয়া ‘তুমি কী দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’ গানটির আবেদন এখনও যেনো অমর-অক্ষয়।

ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সিনেমার গান তিনি প্রথম লেখেন ডাক বাবু ছবিতে। ষাট দশকের মধ্যভাগে এই ছবির গুনী সুরকার আলী হোসেন তাকে প্রথম গান লেখার জন্য অনুরোধ করেন। তার অনুরোধ সারা দিয়ে তিনি গান লেখেন এবং এই ছবির গান- ‘হলুদ বাটো মেন্দি বাটো’ এতোটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যা গ্রামে গঞ্জে তা সবার মুখে মুখে গীত হতে থাকে। এখনও এই গানটি আগের মতোই সজীব হয়ে আছে। এরপর তাঁর লেখা চাওয়া পাওয়া ছবিতে সত্য সাহার সুরে ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া ‘কিছু আগেই হলে ক্ষতি কী ছিল’, এতটুকু আসা ছবিতে সত্য সাহার সুরে প্রয়াত আব্দুল আলীমের গাওয়া ‘দুঃখ সুখের দোলায় দোলে ভব নদীর পানি’, নীল আকাশের নীচে ছবিতে আলী হোসেনের সুরে মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর কণ্ঠে গাওয়া ‘হেসে খেলে জীবনটা যদি চলে যায়’, মাহমুদুন নবীর কন্ঠে গাওয়া ‘প্রেমের নাম বেদনা’, দ্বীপ নিভে নাই ছবিতে মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর গাওয়া ‘ঐ দূর দূর দূরান্তে’ অশ্রু দিয়ে লেখা ছবিতে আলী হোসেনের সুরে সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া ‘অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান’ এখনও সবার মুখে মুখে ফেরে।

একই ভাবে আলী হোসেনের সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া-‘আজ মানুষের দ্বারে, মানবতা কেঁদে মরে’, সুবল দাসের সুরে সৈয়দ আব্দুল হাদীর কণ্ঠে ‘ঘুর্ণিচাকায় ঘুরছে জীবন এই শহরে ভাই, ঘুরে ঘুরে অলিগলি তাইতো দেখে যায়, আমি রিকশাওয়ালা’-এ দুটি গান এখনও সবাইকে আলোড়িত করে। সৃষ্টিশীল পরিচালক আলমগীর কবীরের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবি ধীরে বহে মেঘনা ছবির দুটি গানের গীতিকার ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। সমর দাসের সুরে এই ছবির ‘কত যে ধীরে বহে মেঘনা’ এবং ‘সাগর ভেঙে বন্যার বেগে আয়’ গান দুটিতে কণ্ঠ দেন উপমহাদেশের নন্দিত কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যয় এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যয়।

এসবের বাইরে তাঁর লেখা মধুকণ্ঠী সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘গানের কোকিল আমি ফাগুনের বাসনা ফোটাই’, দেবু ভট্টাচার্যের সুরে রুনা লায়লার গাওয়া ‘অনেকতো ঘুরলাম অনেকতো দেখলাম’, আলী হোসেনের সুরে ‘ঢাকো যত না, নয়নও দুহাতে বাদল মেঘে ঘুমাতে দেবে না’, আব্দুল জব্বারের গাওয়া খন্দকার নুরুল আলমের সুরে ‘নীরবতা শুধু ঢেকে রয় অপরূপ নীরবতা’, খুরশীদ আলমের গাওয়া আলী হোসেন সুরে ‘ও দুটি নয়নে স্বপনে চয়নে নিজেরে যে ভুলে যায়’-সহ আরো অসংখ্য জনপ্রিয় গান রয়েছে।

ভাষার লড়াই, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এবং দেশাত্ববোধক গান রচনায়ও ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান অসম্ভবরকম মেধার সাক্ষর রাখেন। তার লেখা দেশপ্রেমমূলক অনেক গানই আমাদের হ্নদয়ে অন্যরকম আলোড়ন তোলে। ‘আমারও দেশেরও মাটিরও গন্ধে, ভরে আছে সারা মন, শ্যামল কোমল পরশ ছাড়া, নেই কিছু প্রয়োজন’- বাংলা গানের গানের ভূবনে এ এক অনবদ্য সৃষ্টি। এই গানটির সুরকার প্রয়াত আব্দুল আহাদ। আশির দশকের সুরকার আব্দুল আহাদ নিজেই ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা এই গানটির ভূয়ষী প্রশংসা করে বলেছিলেন ‘এই গানটি এতোটাই বাণী সমৃদ্ধ যে গানটির কোনোদিন মৃত্যু হবে না, গানটি নিশ্চিত অমরত্ব লাভ করবে।’ হয়েছেও তাই। সুর আর বাণীর অপূর্বতায় গানটি অমরত্ব লাভ করেছে।

তাঁর লেখা আরও বেশ কয়েকটি দেশাত্ববোধক গান ভীষণরকম জনপ্রিয়। প্রয়াত গুণী সুরকার দেবু ভট্টাচার্যের সুরে বিশ্বনন্দিত গায়িকা রুনা লায়লার গাওয়া ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যের আগে’, ‘ভাষার জন্য যারা দিয়ে গেছে প্রাণ, ভুলিনি তোমাদের আমরা’, ‘স্বাধীনতা এক গোলাপ ফোটানো দিন’, খন্দকার নুরুল আলমের সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা লক্ষ প্রাণের দাম’-এ গানগুলো বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি। এই অমর, কাব্যিক গানগুলোই ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানকে এ দেশের মানুষের হ্নদয়ে বাঁচিয়ে রাখবে আজীবন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)