চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ড. কামাল হোসেনের আসল মিশন কী?

খুন, হত্যা, গ্রেনেড হামলা, পেট্রোল বোমা হামলা, রেললাইন তুলে ফেলা, মানুষকে পুড়িয়ে মারাসহ নানা অপরাধমূলক তৎপরতার কারণে বিএনপি-জামায়াত জোট যখন দেশে-বিদেশে সমালোচিত হচ্ছিল, তাদের সমর্থন কমছিল, ঠিক তখনই ড. কামাল হোসেন ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তোলেন। অথচ ড. কামাল হোসেন এত দিন বলে আসছিলেন, জামায়াত থাকলে তারা কোনও ঐক্যে যাবেন না। আসলে বিএনপি কামাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে জামায়াতের দাঁড়িপাল্লায় ধানের শীষ তুলে দিয়েছে।

দাঁড়িপাল্লার সঙ্গে ধানের শীষ আগেও যুক্ত ছিল। কিন্তু যখন ড. কামাল, কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, মান্নারা সেই ধানের শীষ প্রতীকে দাঁড়িপাল্লার সঙ্গে এক হন, তখন সব একাকার হয়ে যায়। ড. কামাল হোসেন কি তবে বিএনপি-জামায়াতি রাজনীতিকে জায়েজ করার মিশনে নেমেছেন? ড. কামাল হোসেনের কোনো আসন থেকে নির্বাচনে অংশ না নেওয়া এবং জোটের নামে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে নিরলস ভূমিকা পালন করতে দেখে এই বিজয়ের মাসে এই প্রশ্নটাই বারবার সামনে আসছে।

ড. কামাল কী করে ভুলে গেলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন? সাতাত্তরে হ্যাঁ-না ভোটের নাটক, ঊনআশির বানরের পিঠাভাগের সংসদ নির্বাচন করেছিলেন। পরবর্তীকালে জিয়ার স্ত্রী বেগম জিয়া ‘৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারিতে সম্পূর্ণ একতরফা নির্বাচন করেছিল। ড. কামাল এসব প্রশ্নকে ভুলে গিয়ে কীভাবে বিএনপিকে নিয়ে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ স্বপ্ন দেখেন?

অথচ এই ড. কামালই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর শেখ হাসিনাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, মাগো আমি কখনো তোমাদের একলা ফেলে যাব না। এই কামাল হোসেনই কীভাবে এখন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে এত মরিয়া হয়ে উঠেছেন? এর পেছনে কি শুধুই ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ বাসনা, নাকি অন্য কোনো হিসাব-কিতাবও আছে?

অনেকে বলেন, ঐক্যফ্রন্ট জিতলে ড. কামাল হোসেনকে রাষ্ট্রপতি বানানো হবে। এই আশাতেই তিনি জীবনের শেষ পর্বে এসে ঘাতকদের পক্ষে ওকালতি করার মহান ব্রত পালন করছেন। মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের আমলেও তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তারেক রহমান ড. কামালকে রাষ্ট্রপতি বানাবেন সে আশা দুরাশা মাত্র। রাজনীতি বড় নিষ্ঠুর খেলা। আওরঙ্গজেব আপন বড়ভাই দারাশিকোকে দু টুকরো করেছিলেন। পিতাকে আমৃত্যু বন্দী করে রেখেছিলেন আগ্রাফোর্ডে। জিয়াউর রহমানের অন্তরঙ্গ বন্ধু ও বীরোত্তম মুক্তিযোদ্ধা তাহেরকে প্রহসনের বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। সেদিন কারা ফটকে তাহেরের বিচারের নাটক হয়েছিল। আজ একই কারা ফটকে অন্তরীণ বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়া। ড. কামাল বেগম জিয়াকে মুক্ত করার স্বপ্নও দেখাচ্ছেন বিএনপি কর্মীদের!

যদিও বেগম জিয়া নির্বাচনের আগে মুক্তি পাবেন এমন আশা বিএনপির কেউ আর করে না। বেগম জিয়া দুই মামলাতে দোষী প্রমাণিত হয়েছেন। নাইকো মামলার রায়ও সামনে আসছে। তথ্য-উপাত্ত দেখে মনে হচ্ছে, এই মামলায়ও দণ্ড থেকে তার রেহাই পাবার সম্ভবাবনা কম।

খালেদা জিয়া যেদিন জেলে যান, সেদিন সারাদেশ থেকে আসা কয়েক হাজার নেতাকর্মী তার সঙ্গে আদালত পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সেদিন কর্মীরা স্লোগান তুলেছিলেন ‘আমার নেত্রী আমার মা, জেলে যেতে দেব না’। কিন্তু এর পর আর নেতাকর্মীদের মধ্যে সেই স্লোগানের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে দেখা যায়নি! যে বিএনপি দিনের পর দিন অবরোধ হরতাল দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল, সেই বিএনপি তাদের প্রিয় নেত্রীকে জেলে নেয়ার পরে এক বেলার হরতালও ডাকেনি!

এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ক্ষমতার রাজনীতি বেশিদিন আনচ্যালেঞ্জড থাকতে পারে না। পাকিস্তানি ভাবধারার অনুসারী, অর্থনৈতিকভাবে এলিট, ইসলামী মৌলবাদী, উগ্র ডানপন্থি এবং বাংলাদেশবিরোধী মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্তদের সমন্বয়ে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটব্যাংক আছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে ভোট দিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতকে। এই ভোটারদের ভোট ধরে রাখার জন্য এবং আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য বিএনপির সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় দলে না থেকেও বিএনপি নামক দলটিকে রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন ড. কামাল হোসেন। তিনি একটি জোট করে অত্যন্ত সুন্দরভাবে পাকিস্তানি ভাবধারা, জামায়াত, জঙ্গি, সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি কর্নেল অলি, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মতো মুক্তিযোদ্ধাকেও এই জোটে শামিল করেছেন। পাশে পেয়েছেন রব-মান্নার মতো আপাত উদারবাদী নেতাকে। সবাইকে ধানের শীষের বটিকা খাইয়ে এখন পর্যন্ত অত্যন্ত চমৎকারভাবে বিএনপি-জামায়াতের অপরাজনীতিকে জায়েজ করার মিশন পরিচালনা করছেন।

তবে ড. কামালের ঐক্যফ্রন্ট সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে কিছু হেভিওয়েট প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হওয়ায়। হুমকি-ধমকি আপলি-রিট করেও দণ্ডিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন বহাল রাখা যানি। ঐক্যফ্রন্টের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা, তারা বিদেশিদের মন যোগাতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা তারেক রহমান ও জামায়াত। ২০১৪ সাল থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ দেশি-বিদেশি অনেকেই বিএনপিকে বারবার পরামর্শ দিয়েছেন জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার। বিএনপি এখনও তা কানে তোলেনি। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। ক্ষমতার ব্যালান্সের খেলায় বিএনপির স্টেক দিন দিন কমে গেছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য আমেরিকা, ইউরোপ, সৌদি, তুর্কি, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশ এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া দেশে-বিদেশে মিছিল, মিটিং, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করে; পত্রিকায় লিখে, টেলিভিশনে আলোচনা করে, যা বাংলাদেশের সরকারের ওপর বিরাট চাপ তৈরি করতে জামায়াত পৃষ্ঠপোষকদের সাহায্য করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার্থে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করেছেন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিচার বানচালের জন্য বা মুক্তির জন্য কেউ কোনো কথা বলেনি। কিছু করেনি। সংবাদমাধ্যমে এমন খবরও আসছে যে, বিএনপির ডাকা সভায় কূটনৈতিক মিশনগুলোর প্রধানরা যোগ না দিয়ে তাদের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন।

অনেকে এমন কথা বলছেন যে, খালেদা জিয়ার মামলার প্রমাণাদি অত্যন্ত শক্ত; এত শক্ত প্রমাণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কথা বলা যায় না। তাই পশ্চিমারা তার মুক্তির জন্য লবিং করেনি। যদিও এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে দাখিল করা প্রমাণাদিও অত্যন্ত জোরালো ছিল। এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের চিনত; তাদের অপরাধ সম্পর্কে জানত। দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশনে, বইপত্রে এর বহু প্রমাণ আছে। তারপরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সব রকম কারসাজি ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি কাদের মোল্লার মতো একজন ঘৃণ্য অপরাধীকে রক্ষা করার জন্য সরাসরি টেলিফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জর্জ বুশের সঙ্গে। এমন একজন মানুষ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করেন, কসাই কাদেরকে বাঁচাতে নিজে টেলিফোন করেন, তখন পরিমাপ করা যায় জামায়াত মার্কিন রাজনীতির জন্য কতটা প্রয়োজনীয় ছিল। মার্কিন তথা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা খালেদা জিয়ার জন্য কোনো কথাবার্তা বলছে না; তা থেকে বুঝে নেওয়া যায় যে পশ্চিমাদের কাছে এখন বিএনপি এবং জামায়াতের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে।

বিএনপি-খালেদা জিয়া

এই বাস্তবতায় জামায়াতের মতো চিহ্নিত সন্ত্রাসী সংগঠন, যুদ্ধাপরাধের বিচারে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াত নেতাদের দণ্ড ছাড়াও দলটিকেও ‘যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দল’ হিসেবে ঘোষণা করেছে, সেই দলকে নিয়ে, তারেক রহমান যে দলের নেতা, যিনি প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা নয়, গ্রেনেড মেরে চিরতরে নিঃশেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, এমন ব্যক্তিদের নিয়ে কোন মিশন সফল করেন-এখন সেটাই দেখার বিষয়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)