বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের আয়োজনে এক ‘দল নিরপেক্ষ’ সেমিনার বেশ নজর কেড়েছে মূলত দু’টি কারণে। একটি আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে মার্কিন দূতসহ বিদেশী দূতদের চিন্তিত হওয়ার কারণে আর দ্বিতীয়টি হলো, এই আয়োজন ছিল ‘দল নিরপেক্ষ।’ দল নিরপেক্ষ বলার কারণ বাংলাদেশের সবকিছুই যখন দলীয়ভাবে বিভাজিত সেখানে সাংবাদিকরাও মুক্ত নন। সাংবাদিকরা বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নীতি বাস্তবায়ন নিয়ে বিভক্ত। এজন্য সাংবাদিকদের অধিকার আদায় নিয়ে যারা আন্দোলন করেন সেই সাংবাদিক ইউনিয়নও দুভাগে বিভক্ত।
মার্কিন দূতাবাসের আয়োজনে এই সেমিনারে সাংবাদিকদের দুই ইউনিয়নের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। ফলে বলা যায় এই আয়োজন ছিল দল নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সেমিনার।
এই সেমিনারেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তার দু’টি আতঙ্কের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের অন্যতম কঠোর একটি আইন। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য বিটিআরসি ও আইসিটি বিভাগ আরও দু’টি আইনের প্রস্তাব করেছে। মি. পিটারের আশঙ্কা এ দুটি আইনও সাংবাদিকদের আরও আতঙ্কিত করতে পারে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই আলোচনা বা মন্তব্য নিয়ে একটু পর্যালোচনা করা যাক। প্রথমত, যদি দেশপ্রেমের কথা বলি তা হলে বলতে হয়, কোনো একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিদেশী দূত এসব কথা বলতে পারেন কি না!
বাংলাদেশ কোন আইনে চলবে এবং কী আইন বানাবে এটা দেশটির নিজস্ব ব্যাপার। কিন্ত বাস্তবতা হলো বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ও অবাধ বিশ্বে কোনো দেশ চাইলেই কি কোনো কালাকানুন তৈরী করতে পারে? আর যদি কালাকানুন তৈরী হয় বা কোনো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় তা হলে কি এর প্রতিবাদ কেউ জানাতে পারবেন না?
আমার মনে হয় এই অবস্থান থেকেই মার্কিন দূতসহ বিদেশী কূটনীতিকরা কথাবার্তা বলছেন।
আমেরিকায়ও অনেক কালাকানুন আছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আছে। লেখাটি যখন লিখছি তখনই খবর পেলাম টেক্সাসে একটি প্রাইমারী স্কুলে গুলি করে ২১ জনের বেশি শিশু শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে। তাই বলে কী, আমরা মার্কিন দূতকে বলবো, মিয়া আপনার দেশ আগে ঠিক করেন তার পর আমাদের জ্ঞান দিতে আসেন। কিংবা ওয়াশিংটন, নিউইয়র্কে আমাদের রাষ্ট্রদূত সেখানকার মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কোনো সেমিনারের আয়োজন করবেন? সে দেশের সাংবাদিক নেতা বা প্রভাবশালী সম্পাদকরা থাকবেন? সেই ক্ষমতা আমাদের নেই।
জানিনা। এটা হয়তো উচ্চমার্গের কথা। তবে এটা জানি একদিকে আমরা তৃতীয় বিশ্বের দেশ তার ওপর গরীব। আর গরীবের বউ সবার ভাবী, সবাই জ্ঞান দেয়। আবার এটাও সত্য আমেরিকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও যেমন আছে, মানবাধিকার রক্ষার জন্যও তাদের আইন বিচারব্যবস্থা সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে।
যাক। পত্রিকায় দেখলাম এ আলোচনায় অংশ নেন দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী সম্পাদক প্রথম আলোর মতিউর রহমান, মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, সাংবাদিকদের শীর্ষ স্থানীয় নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলসহ সাংবাদিক ইউনিয়নের শীর্ষ নেতারা। ফলে বলাই যায় বিদেশী কুটনীতিকদের কথা বলার সুযোগ এবং তাতে সায় রয়েছে দেশের প্রভাবশালী সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতাদের।
এখন প্রশ্ন হল মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার বাধা হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ যে আইনগুলোর কথা বলেছেন একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে সেটাকে আমরা কেমন মনে করি। এ প্রশ্ন যদি করা হয় তা হলে এটা বলাই যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের প্রধান বাধা।
সাংবাদিকদের প্রতি মুহূর্তেই আতঙ্কে থাকতে হয়, সরকার বা প্রভাবশালীর কোনো অন্যায় কার্যকলাপ নিয়ে লিখলেই যদি এ আইনে মামলা করে দেয় এবং তা হচ্ছেও।
এ আইনের কয়েকটি ধারায় পুলিশকে অসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কয়েকটি ধারায় জামিন পর্যন্ত পাওয়া যায় না।
আইনটি প্রণয়নের পর থেকে সাংবাদিকরা এর বিরোধিতা করে আসছেন। সাংবাদিক সংগঠনগুলো আন্দোলন করছে। সাংবাদিকরা সুনির্দিষ্টভাবে ৯ টি ধারার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে সেগুলো বাতিলের দাবিও জানিয়ে আসছেন। বিশেষ করে এ আইনের ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২৫ (ক) (খ), ৩১, ৩২, ৩৫ ধারাগুলো বিপজ্জনক। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধারাগুলোতেই মামলা দেয়া হচ্ছে বেশী। এ আইনের ১৪ টি ধারা রয়েছে যেগুলোর অপরাধ অজামিনযোগ্য।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে এবং বাতিল বা সংশোধনের জন্য শুরুতেই সাংবাদিকরা একাধিকবার সরকারের আইনমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ধর্ণা দিয়েছেন। মন্ত্রীরা আশ্বাসও দিয়েছিলেন আইনটি সংশোধন করা হবে। কিন্তু বাস্তবে ২০১৮ সালে প্রণীত এই আইনটি সংশোধন আর হয়নি। এটার যথেচ্ছ প্রয়োগ হচ্ছেই।
প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো স্থানে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হচ্ছে, সাংবাদিকদের হয়রানি করা হচ্ছে। অবস্থাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এর অপপ্রয়োগের কথা এখন মন্ত্রীরাও স্বীকার করছেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বুধবার সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে অপপ্রয়োগের কথা স্বীকার করলেও এ আইনটির পক্ষেই তিনি অবস্থান নিয়েছেন।
ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য করা হয়নি। তবে মামলা এস্টাবলিশ হলে বা কোর্ট যদি মনে করে যে এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ হয়েছে, তাহলে সে রকম পদক্ষেপ নেবে। আর যদি মনে করে যে, না, সমন জারি করলেই যথেষ্ট তাহলে সমন জারি করবে। কিন্তু তাই বলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ‘বাতিল প্রজেক্ট’ হবে, এটা কোনোভাবে আমি সমর্থন করবো না।’
আইনমন্ত্রীর মতে, প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কিছু সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছে। এর একটি হচ্ছে সাইবার ক্রাইম। এই সাইবার ক্রাইমও মোকাবেলা করতে হবে। এখন পেনাল কোডের অনেক অপরাধ আছে যেগুলি আর ফিজিক্যালি করা হয় না, কম্পিউটারের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি করা হয়। এগুলো রোধ করার জন্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দরকার রয়েছে। তিনি আশ্বাস দেন, কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হলে এখন সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার না করতে পুলিশকে বলা হয়েছে। এ জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি সেল রয়েছে। সেই সেলের অনুমতি নিয়ে গ্রেফতার করতে হবে।
তবে খবর নিয়ে জানা গেছে অনুমতি ছাড়া গ্রেফতার করা যাবে না আইনমন্ত্রী বা অন্যান্যমন্ত্রী যে ভাবে আশ্বাস দিচ্ছেন এটা শুধু মৌখিক আশ্বাসই। এই মৌখিক আশ্বাস কে বাস্তবায়ন করবে বা করছে কী না তা মনিটর করার কেউ নেই। ফলে সাংবাদিকরা বলছেন, মৌখিক আশ্বাসের কোন ভিত্তি নেই, বিশ্বাসও নেই। মামলা করলেই গ্রেফতার করা যাবে না এ সংক্রান্ত সরকারি পরিপত্র জারি করলে এর ভিত্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু সরকার সেটা করছে না।
এ ছাড়া শুধু সাংবাদিক কেনো রাষ্ট্রের অন্য নাগরিকের বিরুদ্ধে যদি আইনটি প্রয়োগ হয় সে ক্ষেত্রে কি হবে? একই আইন দু ধরনের প্রয়োগ কী হতে পারে?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি যে কালো আইন এটা নিয়ে এতোদিন সাংবাদিকরা বলে আসলেও দেশের অন্য পেশার লোকজনদের এ নিয়ে খুব একটা কথা বলতে দেখা যায় না। অথচ কবি, লেখকরাও কিন্তু এ আইনের গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন। এ আইনের মামলায় কারাগারে বন্দি থেকে একজন লেখক মারাও গেছেন।
কাজেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন শুধু সাংবাদিকদের জন্যই বাধা না, অন্য পেশার লোকজনও এর শিকার হচ্ছেন। এই কালো আইনের প্রতিবাদ এতোদিন ধরে সাংবাদিকরা করছেন এখন বহির্বিশ্বের লোকজনও জানছে। ফলে বিদেশী রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বপালন করতে এসে তাদেরকে এই কালাকানুনের বিরুদ্ধে কথা বলতে হচ্ছে। তাদের উদ্বিগ্ন হতে হচ্ছে। এটা অবশ্যই দেশের মর্যাদার জন্য ভালো না।
মার্কিন দূতাবাসের আয়োজনে, ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে উদযাপনের নামে এই সেমিনারের আলোচনা অবশ্য প্রেস ফ্রিডমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। আলোচনা গড়িয়েছে আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচনে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে দেশের জনগণকে তাদের পছন্দের সরকার বেছে নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। প্রেস ফ্রিডমের আলোচনায় মি. হাসের এ ধরণের বক্তব্য না রাখলেই বরং ভালো ছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কেউ বোধহয় এটা বলবে না নানা কারণে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)