খবরের সাথে সাথে ভুয়া খবর বিষয়টি হালে বেশ উচ্চারিত। বিশেষ করে শব্দটির আন্তর্জাতিকীকরণ হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘বদান্যতায়’। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি গণমাধ্যমকে, বিশেষ করে ‘ফেইক’ নিউজকারীদের প্রকাশ্য শত্রু বলে ঘোষণা দেন। তারই ধারাবাহিকতায় গোস্বা হন বিশ্বখ্যাত সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর এক সাংবাদিকের ওপর। শুধু গোস্বাই হননি, জিম অ্যাকোস্টা নামে ওই সাংবাদিককে তিনি হোয়াইট হাউজে নিষিদ্ধও করেন। তার অপরাধ, তিনি সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। আমাদের সরকারপ্রধানের সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে তার সাথে বিতর্কে জড়ানো তো দূরে থাক, সাংবাদিকদের টার্গেটেই থাকে তাকে কে কতটা খুশি করার মতো প্রশ্ন করতে পারলেন।
আমাদের দেশেও অনেক সময় অনেক সাংবাদিককে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বা তার বাসভবন গণভবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার উদাহরণ আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের তফাৎ হলো, সেখানে জিমকে নিষিদ্ধ করা হলেও সে দেশের আদালত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছেন এবং ওই সাংবাদিককে পুনরায় হোয়াইট হাউজে প্রবেশে বাধা না দিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় তার নামে পাস ইস্যু করতে। উপরন্তু ভুয়া বা ভুল খবরের কারণে সে দেশে কোনো সাংবাদিককে হাতকড়া পরিয়ে থানায় বা আদালতে নিয়ে যাওয়ার ছবি কেউ কোনোদিন দেখেছেন বলে মনে করতে পারবেন না।
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সারা বিশ্ব তো বটেই, খোদ তার দেশের লোকেরাও গালি দেয়। কিন্তু তাপরও একজন সাংবাদিককে তিনি নিজে হোয়াইট হাউজ থেকে বের করে দেয়ার পরে পুনরায় বাধ্য হয়েছেন তার নামে পাস ইস্যু করতে। এটাই গণতান্ত্রিক রীতি, এবং এটাই আইনের শাসনের স্পিরিট। স্বয়ং রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তও আদালত খারিজ করে দিতে পারেন।
ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত নির্বাচনের ফলাফল সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন সঠিক ও তথ্যভিত্তিক না হওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পত্রিকাটির খুলনা প্রতিনিধি মো. হেদায়েৎ হোসেন মোল্যাকে ১ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করে পুলিশ। খুলনার সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও বটিয়াঘাটা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা দেবাশীষ চৌধুরী মামলাটি দায়ের করেন। তিনি একইসঙ্গে অনলাইন গণমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনেরও খুলনা প্রতিনিধি। তাকে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়ার ছবি সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
খুলনার সাংবাদিকদের, বিশেষ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে ঘটনার বিবরণ যতটুকু জানা গেছে তা এরকম: ভোটের রাতে খুলনা ১ আসনের ফলাফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। তিনি প্রাপ্ত ভোটের যে হিসাব দেন, সেটি মোট ভোটারের চেয়ে বেশি বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকরা। ওই সময়ে ঘটানাস্থলে অর্ধশতাধিক সাংবাদিক ছিলেন। এরপর রিটার্নিং কর্মকর্তা বিষয়টি যাচাই-বাছাই করার জন্য সংশ্লিষ্টদের সাথে ফোনে কথা বলেন। কিছু সময় পরে তিনি জানান হিসাবে ভুল হয়েছে। তিনি সংশোধন করে তথ্যটি আবারও ঘোষণা করেন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে ঢাকা ট্রিবিউন ও মানবজমিন রিটার্নিং কর্মকর্তার ভুল তথ্যটি দিয়েই সংবাদ প্রকাশ করে। বিপত্তিটা বাঁধে এখানেই। সংবাদটি খুব বেশি সময় ওয়েবসাইটে না থাকলেও মুহূর্তেই এর স্ক্রিনশট চলে যায় নানাজনের কাছে। এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ফলাফল ঘোষণার সময় রিটার্নিং কর্মকর্তার ভুল হতেই পারে; তিনি যেহেতু কিছুক্ষণ পরে সঠিক তথ্যটি দিয়েছেন আগের তথ্যটি ভুল ছিল বলে স্বীকার করেছেন, ফলে ওই ভুলটি ধরেই সংবাদ প্রকাশ করা কতটা পেশাদারিত্বমূলক ছিল বা এখানে কোনো ধরনের অতি উৎসাহ কাজ করেছে কি না? আবার রিটার্নিং কর্মকর্তা যদি ভুল তথ্য পরিবেশন করেও থাকেন, তাহলে সেটিও সংবাদ। কেননা পরদিনই আমরা দেখেছি খোদ নির্বাচন কমিশন সচিব জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা নিয়ে ভুল তথ্য দিয়েছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। জাতীয় পার্টির অভিযোগের ভিত্তিতে এই সংবাদ প্রকাশিত হলেও এর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো মামলা হয়নি।
তৃতীয়ত, ধরেই নেয়া গেলো যে, একজন বা দুজন সাংবাদিক ভুল তথ্য দিয়ে এবং অতি উৎসাহী হয়ে সংবাদটি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তার মানে কি এই যে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়ে যাবে? তাকে হাতকড়া পরিয়ে দাগী আসামির মতো আদালতে নিতে হবে? তাকে তিনদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে? রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ কী জিজ্ঞাসা করে এবং কোন তরিকায় করে, তা কে না জানে? তার কাছ থেকে পুলিশ কী জানতে চাইবে? এই সংবাদ পাঠানোর জন্য বিএনপি তাকে কত টাকা দিয়েছে? মনে রাখা দরকার, ঢাকার বাইরে থেকে একজন সাংবাদিকের কাজ সংবাদটি পাঠানো। সেটি প্রকাশিত ও প্রচারিত হবে কি হবে না, সেই সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষের।
৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আরও অনেক অনিয়মের খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে। ভোট শুরুর আগে ব্যালট বাক্স ভর্তির ছবি খোদ বিবিসিও দেখিয়েছে। ভোটের অনিয়ম নিয়ে আরও অনেক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তাহলে শুধু একজন বা দুজন সাংবাদিক কেন টার্গেট? এখানে অন্য কোনো রাজনীতি আছে? সাংবাদিক হেদায়েত কি স্থানীয় কোনো প্রভাবশালী বা রাজনীতিকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন যে এখন তিনি সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিচ্ছেন? এগুলোও খতিয়ে দেখা দরকার।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার ভয়াবহ অপপ্রয়োগ বন্ধের দাবির মুখে সরকার যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়, তখন আইনমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বারবারই এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই আইনের অপপ্রয়োগ হবে না বা এই আইন স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বাধা তৈরি করবে না।
তাহলে সাংবাদিক হেদায়েতের বিরুদ্ধে আইনটির প্রয়োগ হলো নাকি অপপ্রয়োগ? প্রশ্নটা এ কারণে যে, যদি কোথাও ভুল বা মিথ্যা সংবাদ প্রকাশিত হয়, প্রথমত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সেই সংবাদের প্রতিবাদ জানাবেন। সেই প্রতিবাদ সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্র প্রকাশ করবে এবং প্রয়োজনে দুঃখপ্রকাশ এমনকি ক্ষমা চাইবে। অপরাধ যদি আরও গুরুতর হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এমনকি তাকে চাকরিচ্যুত করারও বিধান আছে। কিন্তু এসব স্বাভাবিক পথে না গিয়ে সরসারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে সাংবাদিককে গ্রেপ্তার ও হাতকড়া পরিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেও কারো কারো অতি উৎসাহ আছে কিনা, এবং এই অতি উৎসাহীরা সরকারের জন্য কতটা উপকারী কিংবা ক্ষতিকর, সেটিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
পরিশেষে আবারও মনে করিয়ে দেয়া দরকার, যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়, তখন সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিক সমাজের তরফে জোর দাবি জানানো হয়েছিল, এই আইনে শুধু একটি লাইন যুক্ত রাখা হোক যে, ‘এই আইনে যাই থাকুক না কেন, সংবাদ ও সাংবাদিকতা সম্পর্কিত বিরোধ প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্টের আওতায় মীমাংসা হবে।’ কিন্তু বিধানটি আইনে যুক্ত করা হয়নি। সম্ভবত সচেতনভাবেই সাংবাদিকদের এই পরামর্শটি উপেক্ষা করা হয়েছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)