ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের সমগ্র ছাত্র ছাত্রীর ন্যায় সকল শ্রেণির মানুষ নতুন নেতৃত্বের প্রত্যাশার সাথে সাথে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে সুবাতাসের আগমনী বার্তার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছেন।
যে কোন বিবেচনায় বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ডাকসু নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যময়। গুরুত্ব ও আলোচনা তখন আরও বহুগুণে বেড়ে যায়, যখন দেখা যায় দীর্ঘ ২৮ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আগামী ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচনের ভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির গতি প্রকৃতি ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন তথা সার্বিকভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন সহ যে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ডাকসুর নেতাদের অগ্রগণ্য ভূমিকার মূল্যায়ন বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে।
পরবর্তীকালে ডাকসুতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশের জাতীয় রাজনীতিতে অর্থবহ অবদানের মাধ্যমে ডাকসুর মতো ছাত্র সংসদের নির্বাচনের গুরুত্বের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। প্রথিতযশা রাজনীতিবিদরা হতাশার সুরে প্রায়শই বলে থাকেন, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিয়মিত হওয়া উচিত। তা না হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে তা বহমান থাকলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য তা সুখকর হবে না। কাজেই, দেরিতে হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে এবং এ সংক্রান্তে বর্তমান প্রশাসন অবশ্যই কৃতিত্বের দাবিদার।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় নির্বাচন সহ স্থানীয় নির্বাচনে সকল দলের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ থাকছে না। আবার কিছু কিছু জায়গায় অংশগ্রহণ থাকলেও নির্বাচনের শেষ সময়ে নানা অভিযোগের ভিত্তিতে সংবাদ সম্মেলন করে প্রার্থীরা তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ এবং রাজনীতির আধুনিকায়নের জন্য যে কোন ধরনের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ করা উচিত।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের পাশপাশি যে কোন যৌক্তিক দাবির বিষয়ে বিরোধী দলগুলো জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করতে পারে।
প্রথিতযশা রাজনীতিবিদদের জীবনচরিত থেকে আমরা কিন্তু এ ধরনের ঘটনা ও অনুষঙ্গ খুঁজে পাই। সেদিক বিবেচনায় এবারের ডাকসু নির্বাচনে সকল দলের প্রতিনিধিদের পরিষদ প্রদান রাজনীতিতে ইতিবাচক বার্তাই দিচ্ছে। এখনো পর্যন্ত দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু বলেই সংবাদ মাধ্যম মারফত জানা যাচ্ছে এবং কোন দলের পরিষদ নিজেদের প্রার্থীতা বাতিল করেননি।
ভোট গ্রহণ পর্যন্ত নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা এবং ফলাফল ঘোষণা করা পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলের নিরপেক্ষতা প্রদানের মাধ্যমে ডাকসুর নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।
তবে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিরা তাদের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন। তাদের অভিযোগের জায়গাগুলো হচ্ছে: হলগুলোতে ভোট কেন্দ্র স্থাপন, ভোট গ্রহণের সময় কম রাখা, নির্বাচনে ভোট গ্রহণ সরাসরি সম্প্রচার না করা, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য নিরপেক্ষ শিক্ষকদের একটি টিম গঠন না করা ইত্যাদি। পাশাপাশি অনেকেই শঙ্কায় রয়েছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেকেই ভয়ে ভোট প্রদানে বিরত থাকবে। আমাদের সকলের প্রত্যাশা থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে সকলের নিকট নিরপেক্ষতার মানদণ্ডে বিবেচিত হবেন।
প্রশাসনের পাশাপাশি ডাকসুতে যারা ভোটার আছেন তাদেরকে অবশ্যই ভোটাধিকার প্রদানের জন্য উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট প্রদান করে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে হবে যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য।
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির জন্য ডাকসু নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ প্রভাব রয়েছে। আমি আমার বিভিন্ন লেখায় রাজনীতিবিদদের নানাবিধ উদ্ধৃতি, বক্তব্য তুলে ধরে প্রসঙ্গ বিবেচনায় বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করি। কারণ, যারা মাঠের,রাজপথের রাজনীতির সাথে দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত তাঁরা তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কারণেই ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপথ নিয়ে সহজেই ব্যাখ্য বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা রাখেন।
রাজনীতিবিদেরা বলে থাকেন; রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই, চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের হাতে। তার মানে হচ্ছে, রাজনীতিতে নেতৃত্বের সংকট রয়েছে যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে ব্যবসায়ী ও অন্যান্য পেশাজীবীদের হাতে দলীয় মনোনয়ন তুলে দিচ্ছেন। আমাদের বর্তমান সংসদে কতজন সরাসরি দীর্ঘদিন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থেকে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন সে হিসাব কষলেই রাজনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চিত্র নিয়ে সহজেই আলোকপাত করা সম্ভব হবে।
রাজনীতিতে যে সংকট রয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, পরিবার থেকে মেধাবী ছেলেমেয়েদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ব্যাপারে নিরুৎসাহ প্রদান করা হয়। ছাত্র রাজনীতি নিয়ে মিডিয়ায় যেভাবে সংবাদ পরিবেশিত হয় সে বিষয়ে সচেতন অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহ করে তুলেন।
আমার কথা হচ্ছে, ছাত্র রাজনীতি হচ্ছে জাতীয় রাজনীতির গেটকিপার। ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য হলে পর্যায়ক্রমে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়,কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনের জন্য উৎসব সৃষ্টি হবে। ফলশ্রুতিতে, সারা দেশের ছাত্র সংসদের নির্বাচনের মাধ্যমে মেধাবী তরুণেরা নেতৃত্বে পদায়ন করে ছাত্র,ছাত্রীদের অধিকার আদায়ে নিজেদের বিকশিত করে জাতীয় রাজনীতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে তুলবে।
আর এভাবেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকট দূরীভূত হবে। ছাত্র সমাজ সচেতন রাজনীতির পরিক্রমায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে ইতিবাচক রাজনীতির সুবাতাস নিয়ে আসবে এমনটাই প্রত্যাশা সকল শ্রেণির মানুষের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)