স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন হয়েছে সাত বার। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে গত ২৮ বছরে শুধু ডাকসু নির্বাচনই নয়, বাংলাদেশের কোনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচনই হয়নি। দীর্ঘদিন নানা কারণে বন্ধ ছিল এই নির্বাচন।
দুই যুগের বেশি সময় ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় ২০১২ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ২৫ জন শিক্ষার্থী। আদালত সেসময় রুল জারি করে জানতে চান, ডাকসু নির্বাচন করার ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না আর সেই রুলের নিষ্পত্তি করে গত বছরের ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট রায় দেন; যাতে ছয় মাসের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়। আর ওই নির্বাচনের সময় যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তার দরকার হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সে বিষয়ে যথাযথ সহযোগিতা প্রদান করতেও আদালত নির্দেশ করেন।
আদালতের রায় পেয়ে নড়েচড়ে বসেন ছাত্র-সংগঠন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শুরু হয় আলোচনা, পরিকল্পনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের গঠনতন্ত্রের ৮(ই) ধারা অনুযায়ী ডাকসু’র সভাপতি হিসেবে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান নির্বাচনের এই তারিখ ও সময় নির্ধারণ করেন।
ডাকসু নির্বাচন-২০১৯ এর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী, ডাকসু ও হল সংসদেও মোট ভোটার ৪৩ হাজার ২৫৬ জন। কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ মিলিয়ে প্রার্থী রয়েছেন ৭৩৮ জন। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদে ২৫ পদের বিপরীতে ২২৯ জন এবং হল সংসদে ১৩টি করে ২৩৪ পদের বিপরীতে ৫০৯ জন এবং প্রতি ভোটারকে ভোট দিতে হয়েছে ৩৮টি। আর ঘোষিত ফল অনুসারে ২৫ হাজারের কিছু বেশি ভোট প্রয়োগ হয়েছে, যা মোট ভোটের ৫৯ শতাংশ।
উপরের সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরেছি এই কারণে, নানা রকমের দাবি দাওয়া, মান-অভিমান আর আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেও ডাকসু নির্বাচন-২০১৯ এ অংশগ্রহণ করেছে সকল প্রার্থী।
কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, ফলাফল ঘোষণা করার সাথে-সাথে কতিপয় প্রার্থীর বা ছাত্রনেতার মতামত জাতীয় নোংরা রাজনীতির কতিপয় ব্যক্তির নিকৃষ্ট মন্তব্যকেও পিছনে ফেলেছে। আর নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল গুজব আর নাটকে ছড়াছড়ি।
ছাত্ররাজনীতি বা ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সবারই ভিপি হওয়ার আশা-স্বপ্ন থাকে। কিন্তু এই ভিপি পদে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন কী কারণে নুরুল হক নুরুর চেয়ে ১ হাজার ৯৩৩ ভোট কম পেয়েছে-এটি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে গবেষণা করার চেষ্টা করেছি। ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল-এমন অনেক সাবেক ও বর্তমান ছাত্র নেতার সাথে কথা বলেছি। আবার ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন ছাত্র নেতাদের সাথেও কথা বলেছি, কথা বলেছি সাধারণ শিক্ষার্থীর সাথেও। জানার চেষ্টা করেছি, বুঝার চেষ্টা করেছি কারণ, ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন ডাকসু নির্বাচনে ১৫ হাজার ৩০১টি ভোট পেয়ে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
তাহলে ডাকসু নির্বাচনে ব্যক্তির জনপ্রিয়তা দেখে ভোট দিয়েছে ? নাকি এখানে অন্য কিছু কাজ করেছে-এটি খোঁজার জন্য আমাকে আরও কিছু গ্রহণযোগ্য নেতাকর্মীর ভিতরে ঢুকতে হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে আমার নিজেস্ব কিছু প্রিয় সংবাদকর্মীর সাথে একান্তভাবে আলোচনা করেও বিস্তারিত বুঝার চেষ্টা করেছি।
জানা যায়, ভিপি পদে ছাত্রলীগের প্রার্থীর পরাজয়ের পেছনে রয়েছে সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, গ্রুপিং-লবিং। যা সাবেক ও বর্তমান অনেক ছাত্রলীগ নেতাই শোভনের পক্ষে তেমনটা কাজ না করে উল্টো পর্দার আড়ালে ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেছে। আবার অনেকে মনে করছে, বর্তমান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হচ্ছে উত্তরবঙ্গের। আর নেতৃত্ব হাতছাড়া হওয়ায় দক্ষিণবঙ্গের কতিপয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুধু মানসিক দূরত্বই সৃষ্টি হয়নি, সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতির অঙ্গনেও। ছাত্রলীগের জন্য সবাই অন্তঃপ্রাণ বলা হলেও মূলত ভেতরে ভেতরে আঞ্চলিকতার কারণে গ্রুপিং-লবিংয়ের কারণে নির্বাচনে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।
আঞ্চলিকতার অভিযোগটি আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে জিটিভি ও সারা বাংলার প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে। তিনি ফেসবুকে লিখেন, ‘আমাদের সময়ে দু’দুটি ডাকসু নির্বাচন, ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি দেখার অভিজ্ঞতায় জানি-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বরিশাল গ্রুপের কোন নির্দিষ্ট দল নাই’।
অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে এ নিয়ে কথা বললে একজন তার মোবাইল থেকে নব-নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুরুর একটি ভিডিও দেখিয়ে বলেন, কুয়েত মৈত্রী হলে ‘জাল ভোটের ব্যালট পেপার’ উদ্ধার হওয়ার গুজব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মনে ছাত্রলীগ সম্পর্কে তাৎক্ষনিকভাবে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করেছে। শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ায় এবং কতিপয় অনলাইন মিডিয়া যাচাই না করে এই গুজবের তথ্য প্রকাশ করায় এটি ভোটারকে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করেছে।
ভিডিওতে নুরুল হক নুর নিজে ঘুরতে ঘুরতে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখিয়ে ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, নুরুল হক নুর ক্যাম্পাসে প্রহৃত হয়েছেন-অমন অপপ্রচার-গুজবও শিক্ষার্থীদের মাঝে নুরের প্রতি ‘সিমপ্যাথি’ জন্ম হয়েছে যা লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকে নুরুকে ভোটদানে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, কোটা সংস্কার আন্দোলনে যেভাবে গুজব ছড়ানো হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবি সিদ্দিককে হত্যা করা হয়েছে মর্মে যেসকল গুজব-মিথ্যাচারের প্রচার ঘটিয়েছে; এখান থেকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কি কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেছে? এই ধরণের গুজব যে ডাকসু নির্বাচনেও করবে না-এটা নিয়েও কি ছাত্রলীগের কোনো প্রস্তুতি ছিল? আবার আঞ্চলিকতার চেয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি দায়িত্ববান হওয়া নিয়ে ডাকসুকে ঘিরে আঞ্চলিক ওইসব নেতাদের নিয়ে আলোচনা, আহ্বান, আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল?
আমাকে কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি, ডাকসুকে ঘিরে ছাত্রলীগের কোনো মনিটরিং টিম ছিল কিনা। গুজবের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তাৎক্ষনিকভাবে সত্য-তথ্য উপাত্ত তুলে ধরার ব্যবস্থা গ্রহণে কী কী পদক্ষেপ ছাত্রলীগ নিয়েছে-এটিও স্পষ্ট করে কেউ জানাতে পারেনি।
ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতা যারা সরাসরি ডাকসুর নির্বাচনে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে, নীতিনির্ধারণী ফোরামে ছিল এবং ডাকসুর নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করেছে তাঁদের সবার একটা কথা ভালো করেই জেনে রাখার দরকার ছিল-গুজব, অপপ্রচার, মিথ্যাচার বর্তমানে এক শ্রেণি মানুষের কাছে বিভ্রান্ত করার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কোটা সংস্কার আন্দোলন আর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে গুজব-অপপ্রচার, মিথ্যাচারকে একটা সময় সত্য তথ্য-উপাত্ত দিয়ে মোকাবেলা করতে পারলেও তাৎক্ষনিকভাবে একটা শ্রেণি বিভ্রান্ত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের অফিসে কথিত ছাত্রীকে ধর্ষণ, হত্যা করে লেকের পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে-এমন মিথ্যাচারে তাৎক্ষনিক বিভ্রান্ত হয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আওয়ামী লীগের অফিসে ঢুকে বিস্তারিত দেখতে বাধ্য করেছিল এই ‘অপপ্রচার’ বা ‘গুজব’।
অর্থাৎ তাৎক্ষনিকভাবে বিভ্রান্ত হলেও ‘গুজব’ ‘একটা সিদ্ধান্ত’ গ্রহণে বাধ্য করে। আর এই বিভ্রান্ত হয়ে তাৎক্ষনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ‘ক’ এর জায়গায় ‘খ’কে ভোট প্রদান করলে তা আর সংশোধন করার কোনো সুযোগ থাকে না যা ডাকসুর নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। গুজব আর নুরুল হক নুরের ঘুরে পড়ে যাওয়ার নাটক ছাত্রলীগের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ধরনের রাগ-ক্ষোভ আর ঘৃণার জন্ম দিয়েছে।
ডাকসুর নব-নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুরকে এখন অনেকেই ছাত্রলীগের কর্মী বানানোর চেষ্টা করছে। আবার সোশ্যাল মিডিয়াতে সেই প্রমাণপত্রও ভাইরাল করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি এবং সেই কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে নুরদের পুরো টিমের আদর্শগত এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেষ্টা করেছি। এবং ২০১৮ সালের ৬ মে চ্যানেল আই অনলাইন-এ ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন, টার্গেট কারা?’ নামে লেখা লেখেছি।
আমার জানা মতে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাসে সোহাগ-নাজমুলের হাত দিয়ে সৃষ্টি আরেক সোহাগ-জাকির ছাত্রলীগের কমিটি এতোটাই কলঙ্কিত, যা উপলদ্ধি করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এই ছাত্রলীগকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছাত্রলীগে ফিরিয়ে নিতে দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়, ২০১৬ সালে ২১ মে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অফিসিয়াল প্যাডে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন স্বাক্ষরিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদনকৃত স্বাক্ষরে দেখা যায় সহ-সভাপতি মো. রুম্মান হোসাইনসহ আরো কয়েকজন নেতার নামের পাশে ব্র্যাকেট করা ‘ব ব হল’ এবং ফারুক হোসেন তালুকদারের পাশে ব্র্যাকেট করা ‘জিয়া হল’ উল্লেখ করেছে। আমি এটির প্রতিবাদ করে ফেসবুকে জানিয়েছিলাম, এটি লজ্জার বিষয়। বঙ্গবন্ধু’র নামের জায়গায় ‘ব ব’ লিখলেও তারা জিয়ার নামের ক্ষেত্রে কেউ ভুল করেনি (!) যা অনেক গণমাধ্যম ফেসবুকের স্ট্যাটাস নিয়ে আমার অনুমতিক্রমে ‘বঙ্গবন্ধু লিখতে ছাত্রলীগের ‘চরম অনীহা’’-শিরোনামে তখন এটি তুলে ধরেছে।
বির্তক একটি নয়, সোহাগ-জাকির কমিটি কেন্দ্রীয় থেকে আরম্ভ করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, জামায়াত ঘরোনার লোকদের ছাত্রলীগের পদপদবী দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলকের ভাগ্নে, জামায়াতে ইসলামীর পৌর আমিরের ছেলে খালিদ হাসানকে নাটোরের সিংড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত করেছে স্বয়ং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন মঞ্চে উপস্থিত থেকে! বিভিন্ন গণমাধ্যম তখন এই সংবাদকে হেডলাইন বা প্রধান সংবাদ হিসেবে তুলে ধরেছে। ‘নাটোরে জামায়াত আমিরের ছেলে ছাত্রলীগের উপজেলা সভাপতি’-এই শিরোনামে গুগলে সার্চ দিলে এখনো সেই সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তখন কী কারণে এই ধরণের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে? এখানে তদবির-লবিং ছিল কতটা? নাকি সিনিয়র কোনো নেতার প্রচণ্ড চাপ তারা উপেক্ষা করতে পারেনি-এটা সোহাগ-জাকির ভালো বলতে পারবেন।
কিন্তু আমার প্রশ্ন, জন্মগত আদর্শ আর রাজনৈতিক চিন্তা দর্শন ছাত্রলীগের কমিটিতে নাম লেখালেই কি রাতারাতি পরিবর্তন হবে? বা হওয়া সম্ভব? ইতিহাস কী বলে ?
ডাকসুর ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না শুরুতেই করেছেন ছাত্রসংঘের রাজনীতি যা স্বাধীনতার পরে ছাত্রশিবির হয়। পরে ছাত্রলীগ থেকে জাসদ, বাসদ, জনতা মুক্তি পার্টি হয়ে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও হয়েছেন। কিন্তু তিনি কত দিন আওয়ামী লীগের চিন্তা আর রাজনৈতিক দর্শন লালন করেছেন? কতদিন তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার নিয়ে রাজনীতি করতে পেরেছেন-এটা সকলের জানা।
মাহমুদুর রহমান মান্না আওয়ামী লীগ থেকে বিতাড়িত হয়ে আবারও নিজস্ব চিন্তা-চেতনা আর ছাত্রসংঘের রাজনৈতিক দর্শনে ফিরে যান। পুরনো রাজনীতির দর্শনে সরাসরি নিজের নাম না লেখালেও তিনি সেই খোলস বা লালন করা আদর্শ থেকে বের হতে পারেননি, বের হননি-এটি তার সকল আলোচনায় প্রতীয়মান।
পুরো বিশ্ব থেকে আরম্ভ করে শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তান যখন বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে প্রশংসা করছে তখন জাতীয় প্রেস ক্লাবের তখনকার সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মুহম্মদ শফিকুর রহমানের সাথে টকশোতে বসে এই মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলাদেশকে তিরস্কার করে পাকিস্তানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ!
ডাকসুর নব-নির্বাচিত নুরুল হক নুর কখনোই বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগের আদর্শ ধারণ করেনি, ধারণ করে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় এই নুর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কথা বলেছে। ভিন্ন মত আর বাক স্বাধীনতার নামে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কটূক্তি করেছে নুরের সহযোদ্ধারা। ‘আমি রাজাকার’ বলে তখনই নিজেদের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরেছে।
আমরা জানি, ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালেই এই কোটা ব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারিত করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করেন। নতুন করে যোগ করেন এক শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা। আর তখন এর প্রতিবাদ করেন জামায়াত-শিবির যার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল নুরুল হকরা।
আর কোটা সংস্কার আন্দোলনে তখনকার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কী ভূমিকা ছিল-এটিও আওয়ামী লীগসহ সাবেক ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী ভালো করেই অবগত আছে বলে আমার বিশ্বাস।
ডাকসুর নব-নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর ১২ মার্চ বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘ছাত্রলীগ একটা গুজবের সংগঠন। তারা সব সময় শুধু গুজব ছড়ায়’! নুরুল ছাত্রলীগ করলে বা ছাত্রলীগের আদর্শ ধারণ করলে নিশ্চয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে জানা থাকতো, পড়াশোনা থাকতো।
ব্যক্তিগত স্বার্থ আর ক্ষণিকের প্রাপ্তির আশায় শুধু সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদি গোষ্ঠীকেই নয়; একজন বিতর্কিত অক্ষম মানুষকেও সক্ষম করে গড়ে তুললে, বিশ্বাস করলে একটা সময় নিজের জায়গাটাই ছেড়ে দিবে বাধ্য হতে হয়। আর সেখান থেকেই উত্থান হয় মোশতাকদের আর পতন ঘটে জাতীয় চার নেতার।
নানা আলোচনা-সমালোচনা মধ্য দিয়ে ডাকসু নির্বাচন-২০১৯ সম্পন্ন হয়েছে। এখান থেকে সকল ছাত্রছাত্রী ও ছাত্ররাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছাত্রনেতাদের শিক্ষা নেওয়ার পটভূমি তৈরি হয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থ, আঞ্চলিকতা, গ্রুপিং-লবিং, রাগ-ক্ষোভ-অভিমানের চেয়েও দলীয় স্বার্থ, সংগঠনের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাওয়া হচ্ছে- ছাত্রনেতারা নিশ্চয় এটি বিচার-বিশ্লেষণ করবে এবং সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ২৮ বছর পর নতুন করে ভাবতে, সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও ঢেলে সাজাতে সাহায্য পাবে বলে মনে করছি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।