হ্যাঁ, ট্রাম্প এই প্রথম শক্ত আঘাত পেলেন। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ। জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি বাতিল করা হোক, এই প্রস্তাবের ওপর গত বৃহস্পতিবার সাধারণ পরিষদে ভোট হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন ভারতসহ ১২৮টি দেশের প্রতিনিধিরা, ভোটদানে বিরত থেকেছে ৩৫টি দেশ, আর বিপক্ষে ভোট পড়েছে ন’টি। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়া দেশগুলির মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদের চার স্থায়ী সদস্য চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও ব্রিটেনসহ আমেরিকার মিত্র দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানির মতো রাষ্ট্র। অর্থাৎ ন্যাটোর সদস্যভুক্ত প্রায় সব রাষ্ট্রই আমেরিকার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে জাতিসংঘের ভোটমঞ্চে।
আমেরিকার পক্ষে যে মাত্র ৮টি দেশ ভোট দিয়েছে, তারা সরাসরি মার্কিন অনুদানে চলে। যাদের মধ্যে রয়েছে আমেরিকা, ইজরায়েল, গুয়েতেমালা, হন্ডুরাস, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, মাইক্রোনেশিয়া, নাউরু, পালাউ ও টোগো। ভোটদানে বিরত থাকা দেশগুলির মধ্যে রয়েছে কানাডা ও মেক্সিকো। যদিও জাতিসংঘের এই প্রস্তাব মানার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই আমেরিকার। তবে এটা যে ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
জেরুজালেম ইস্যুতে গোটা দুনিয়ার ১২৮টি দেশকে হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। জেরুজালেম ইস্যুতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ভোটের আগেই তিনি জানিয়েছিলেন, ‘জেরুজালেম নিয়ে আমাদের বিপক্ষে ভোট যারা দিয়েছে তাদের জন্য হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক সাহায্য কমবে।’ হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘তারা লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি ডলার সাহায্য নিচ্ছে, আর আমাদেরই বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছে। ঠিক আছে, কারা এই ভোট দেয় আমরা দেখছি। আমাদের বিরুদ্ধে ভোট দিক। আমরাও প্রচুর অর্থ বাঁচাব। এতে আমাদের কিছু যায় আসে না।’
এই ভোটাভুটির আগেই সাধারণ পরিষদের সদস্যরাষ্ট্রগুলির প্রতি হুঁশিয়ারি বার্তা পাঠিয়েছিল আমেরিকা। জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হ্যালি আমেরিকার বিপক্ষে ভোট দিলে সেই দেশগুলিকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সাধারণ পরিষদে আমাদের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া দেশগুলির বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। প্রেসিডেন্ট এই ভোটাভুটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। যারা আমেরিকার বিরুদ্ধে ভোট দেবে, আমার ওপর নির্দেশ আছে ওই দেশগুলির নাম সংগ্রহ করে ট্রাম্পের কাছে একটা প্রতিবেদন পাঠানোর। আমরা জেরুজালেম প্রশ্নে প্রত্যেকটা ভোটের হিসাব রাখব।
এটা ঠিক ট্রাম্প প্রশাসন জেরুজালেম ইস্যুতে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে। হুমকি-ধমকিতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। এমনকি মিত্র দেশগুলোও ট্রাম্পকে উপেক্ষা করেছে। অনেকে সমালোচনায় ফেটে পড়ছেন। অনেকে ট্রাম্পের বিপক্ষে রাগে-ক্ষোভে হাত কামড়াচ্ছেন! খোদ আমেরিকায় ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে!
তবে দোষ তো ট্রাম্পের নয়। তিনি আগাগোড়া, এতটুকু রাখঢাক না করে, অসভ্য নির্লজ্জ ভাষায় ভঙ্গিতে, চাঁচাছোলা দ্ব্যর্থহীন বলেছেন, তিনি কেমন মানুষ ও কী চান। তার নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের থিম ছিল: ঘেন্না কর, থুতু দে, মার সবাইকে, তাড়া সবাইকে। মেক্সিকানরা রেপিস্ট, চীনারা শয়তান, ভারতীয়রা মার্কিনদের চাকরি খায়, মুসলিমগুলো টেররিস্ট, আর হ্যাঁ, নারীগুলো ভোগ্যবস্তু। তা, এই লোক ক্ষমতায় এলে কী করবে? ফুল্লকুসুমিত মানবিকতা ও কল্যাণময়তার চাষবাস? তা হলে তো তার ‘ইন্টিগ্রিটি’-ই থাকবে না! সে বলল, আমায় ক্ষমতা দাও, আমি তোমায় মুসলিমশূন্য স্বর্গ দেব— তার পর কুর্সি পেয়ে সে কী বলবে? মুসলিমদের বুকে টানো? বরঞ্চ সে ক্ষমতা পাওয়ার আগে যে-আপদ ছিল, এখনও সে-আপদই আছে। আর যারা আমেরিকার রা-রা-রা ডেমোক্রেসির ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে পিটিয়ে হাতে বাত ফলিয়ে ফেলেছিল, তাদের ভাবার সময় এসেছে— যে দেশে বুঝেশুনে এই লোককে লাখে লাখে মানুষ ঝাঁপিয়ে ভোট দেয়— সেখানকার লিবার্টি-মহোদয়ার কি উচিত নয়, ঊর্ধ্বমশাল-টি অবিলম্বে স্বখাত সলিলে চুবিয়ে, রিটায়ার করা?
দোষ দিলে দিতে হয় আমেরিকান ভোটারদের, দিতে হয় সেখানকার সিস্টেমকে! হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য বিরুদ্ধ-মিছিল হয়েছে ট্রাম্পের অভিষেকের দিন, ওয়াশিংটন নিউইয়র্ক আরও কোথায় কোথায়, এ কূল ও কূল ছ’কূল উপচে পড়েছে, মেয়েরা ‘পুসিহ্যাট’ পরে ট্রাম্পকে দুয়ো দিয়েছেন, গ্লোরিয়া স্টাইনেম বলেছেন গণতন্ত্রের এমন বহিঃপ্রকাশ জীবনে দেখেননি, ম্যাডোনা বলেছেন তিনি ভেবেছেন হোয়াইট হাউস উড়িয়ে দেওয়ার কথা, রাস্তাঘাট সেলফোনের সিগনাল সব ব্লক হয়ে গিয়েছে প্রতিবাদের ভিড়ে, নির্ঘাত সব্বার মনে সিক্সটিজের আঁচ ডিলান-বায়েজ ধাঁচ আহ্লাদে মুন্ডু তুলছিল, বাঃ, সাচ্চা একটা আন্দোলন করেছি! ট্রাম্প এ সম্বন্ধে একটা টুইট করেছিলেন, যার মর্ম: সে কী, হেথা একটা নির্বাচন হয়েছিল না? নির্বাচনে অবশ্য ট্রাম্প প্রায় তিরিশ লক্ষ ভোট কম পেয়েছেন, আমেরিকার গণতন্ত্রের জটিল প্রক্রিয়ায় জিতে গেছেন, কিন্তু সে কথা ছেড়ে দিলেও টুইট-সূত্র ধরে একটা প্রশ্ন তোলা যায়: ট্রাম্প যখন দিনের পর দিন নারীদের সম্পর্কে (এবং অন্যদের সম্পর্কে) অসভ্য কথাগুলো বলছিলেন, তখন এই আকাশপাতাল ভাসানো মিছিল কোথা ছিল? এই প্রকাণ্ড কোরাস-হাহাকার? তখন এগুলো করলে হয়তো নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারত! তখন তাঁকে ক্লাউন ঠাউরে চুটকি গড়ে আদ্ধেকে কর্তব্য সারছিল কেন?
নিউইয়র্ক টাইমসে প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছে, ট্রাম্পের কম্মে নাকি আমেরিকানদের মান যাচ্ছে! আহারে আমেরিকানদের মান! এতদিন আপনারা কোথায় ছিলেন? নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের সময়? তিনি তো ঘোষণা দিয়েই মাঠে নেমেছিলেন! তোমরা এত কিছু বোঝো আর এইটুকু বোঝো না যে, সে সাংঘাতিক খারাপ কাজ করবে, অসহিষ্ণুতার বুলডোজার চালাবে— সমকামী, ট্রান্সজেন্ডার, নারী, অভিবাসী, শরণার্থী, যে যেখানে কোনও ভাবে প্রান্তিক এবং সুতরাং অধিক যত্ন ও মনোযোগের অধিকারী, সব্বার সর্বনাশ করে ছাড়বে, তা হলে তো তোমাদের অনেক আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল!
তোমার গণতন্ত্র যদি হয় শিক্ষিত গণতন্ত্র, তোমাকে জাগ্রত থাকতে হবে। বিশেষত উগ্র জাতি-অহং’এর হুহু ও চটজলদি আকর্ষণের বিরুদ্ধে। হিটলারও নির্বাচনে জিতেছিলেন। প্রতিটি মানুষ মূলগত ভাবে সাম্প্রদায়িক, চেতনার উখোয় ঘষে ঘষে তাকে প্রতি দিন এই গাদ তুলতে হয়। কিন্তু এখন দেশে দেশে ভিন্ন হাওয়া। সব মানুষ ভাবতে ভালোবাসে, তার দুর্দশার জন্যে তার অক্ষমতা দায়ী নয়, অন্য লোকের অন্যায় অনুপ্রবেশ দায়ী। ব্রেক্সিটেরও মূল কথা এ-ই, ট্রাম্পের জয়েরও।
সাধারণত এ সব যারা বিশ্বাস করে, তাদের বাস্তবজ্ঞান থাকে না, ঔচিত্যের ধারণাও নয়, আর সবচেয়ে বেশি তারা ভালোবাসে অশিক্ষা ও সরাসরি তার দাপুটে উচ্চারণ। তাই এদের প্রিয় মোড়ল এমন কেউ, যিনি বলেন, আমি তর্ক-যুক্তি জানি না, কিচ্ছু পড়ি না শুনি না, পুতুপুতু ভাবনাচিন্তাচর্চা পুরো ধাস্টামো, কে বলে বিশ্ব-উষ্ণায়ন হচ্ছে, ধুস, তা হলে এত ঠান্ডা পড়ছে কী করে, দে ক্লাইমেটের চুক্তিগুলো ছিঁড়ে!
খারাপ কথা নয়। দিকে দিকে না-শেখারই উৎসব। ফিল্ম শিখে ফিল্ম করতে হয় না। গান শিখে গান গাইতে হয় না। পলিটিক্সেই বা ডেকোরাম, এটিকেট জানতে হবে কেন? পড়াশোনা করতে হবে কেন? এ দিক থেকে ট্রাম্প তাদেরই ক্যাপ্টেন, যে-নেতানেত্রীরা পৃথিবীর দিকে দিকে অশিক্ষার ফ্ল্যাগ প্রকাণ্ড পুঁতছেন। যে পণ্ডিতরা চিরকাল আক্ষেপ করেছেন, সব ক্ষমতা এলিটদের হাতে থাকবে কেন, তারা এখন ‘সাবঅলটার্ন’দের অলরাউন্ড জয়ে কিছু হতচকিত: জন-অধিনায়করা কেউ ভুল উচ্চারণ বাগিয়ে নিম্নবর্গ হওয়ার গর্বে স্ফীত, কেউ কোটি টাকার গরমে ইতরামোর আস্ফালনে সিদ্ধ। ট্রাম্প তার গাড়ির স্পর্ধিত চাকায় সব নীতি গুঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছেন, কেন মস্তান হব না? কে বললে প্রেসিডেন্টকে ভদ্র হতে হবে? আমি সব ন্যায়প্রথা অস্বীকার করি, শুধু জানি, সবাই এ দেশের ভালোমানুষির সুযোগ নিয়েছে অ্যাদ্দিন, এ বার আমার বাজেমানুষিতে ভিলেনরা কাঠে-কাঠ পড়বে।
গুগল অ্যাপল-রা যত মামলা করুন, নোবেলজয়ীরা যত সই করুন প্রতিবাদপত্রে, আদালত যত পথ আটকাক, নেতার এই রাফ-টাফ মূর্তিখান বহু মানুষের কাছে ত্রাতা হিসেবে তার বেদি পোক্ত করে। ‘এই একটা লোক আন্তর্জাতিক ন্যাকামিকে কেয়ার না করে মুখের ওপর আসল সত্যিটা ছুড়ে দেয়!’ আমেরিকায় যারা ট্রামকে পছন্দ করেন না, তার চেয়ে ঢের বেশি লোক তলে তলে এই বেতোয়াক্কা ট্রাম্পকে সমর্থন করছে, আনন্দে নাচছে। এ জিনিস যদি ছড়িয়ে পড়ে, ঘৃণা ও আঘাতের প্রতি দেশকর্তার প্রশ্রয় যদি হাওয়ায় ওড়ে, তবে ঘোষিত রাষ্ট্রনীতি থাক আর না-থাক, পথচারীর পাসপোর্ট পকেটে ঝুলুক আর লকেটে, রেসিস্ট হাঙ্গামা মারধর টিটকিরি খুব দূরে নেই।
তবে, ট্রাম্প বা তার সমর্থকদের এত হাত নেওয়ার আগে ভেবে দেখা ভালো, এই ধরনের মানসিকতার জন্ম কেন হয়? কী ভাবে ক্রমে তার শিকড় গভীরতর হয়? নিরপেক্ষ ভাবে ভাবলে অনেকের ব্যর্থতাই স্পষ্ট হবে। বাংলাদেশেও যেমন। স্বাধীনতা অর্জনের পর যে গোত্রের রাজনৈতিক ও সামাজিক মতবাদের কোনও স্বীকৃতিই ছিল না, ধীরে ধীরে সেই দর্শনই মানুষের রায়ে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে গেল। এক জনের সাফল্য চির কালই অন্য কারও ব্যর্থতার প্রতীক। সাফল্যের রসায়ন বিশ্লেষণ করার সময় সেই ব্যর্থতার ব্যবচ্ছেদ করাও বাঞ্ছনীয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)