সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে, সকল জরিপ ভুল প্রমাণ করে, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর পদটি জিতে নিয়েছেন রাজনীতিতে একেবারে নতুন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে যোগ্য মানুষটিকে হারিয়েছেন ইতিহাসের সবচেয়ে অযোগ্য লোকটি – এমন মন্তব্য করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক দ্যা গার্ডিয়ানের মতামত লেখক থমাস ফ্রাংক। যে মানুষটি কোনদিন রাজনীতি করেননি, কোন সরকারী পদ পরিচালনা করেননি, সামরিক বাহিনীতে কাজ করেননি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত কোন পদ অধিকার করেননি, এমনকি কোন দিন কোন নির্বাচনে প্রার্থী পর্যন্ত হননি এমন একটি লোক জনগণের ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন এককালের আমেরিকার আরাকান রাজ্যের গভর্নরের স্ত্রী, মার্কিন ফার্স্ট লেডি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সিনেটর, ২০০৪ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রাটিক পার্টির মনোনয়নের জন্য প্রাইমারী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বারাক ওবামার কাছে হেরে যাওয়া এবং পরবর্তীতে ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে চার বছর কাজ করা মানুষ হিলারি ক্লিনটন।
ক্লিনটনের কি না আছে? ২০০১ সালে সিনেটর হিসেবে জেতার পর থেকেই শুরু করেছেন রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি। স্বামী বিল ক্লিনটনের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন ছাত্রাবস্থায়। পরবর্তীকালে গভর্নরের স্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে ছিলেন রাষ্ট্র ক্ষমতার একেবারে ভেতরে; দেখেছেন ক্ষমতার প্রকৃত স্বরূপ। সিনেটর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিজে অংশ নিয়েছেন ওয়াশিংটনের অন্দর মহলের রাজনৈতিক কারু শিল্পে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ভ্রমণ করেছেন ১০৩টি দেশ; অংশ নিয়েছেন ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, এশিয়ার দেশে দেশে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক সব ঘটনা প্রবাহে। গোল্ডম্যান স্যাক্স থেকে শুরু করে বড় বড় সব ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান পরে থেকেছে তাঁর পায়ের কাছে। লক্ষ ডলারের বিনিময়ে একটা বক্তৃতা দিয়ে ধন্য করেছেন ওয়াল স্ট্রীটের নিয়ন্ত্রকদের। নির্বাচনী ফান্ড করার জন্য পরিবারের নামে গড়ে তোলা সামাজিক প্রতিষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ ডলারের চাঁদা নিয়েছেন পররাষ্ট্র দফতরে একবার দেখা দেবার বিনিময়ে। চাঁদা ছাড়া দেখা দেননি ছাত্র জীবনের বন্ধু, নোবেল বিজয়ী ডঃ মুহম্মদ ইউনুসকেও। তাঁর নির্বাচনী তহবিলে শত শত মিলিয়ন ডলার চাঁদা দিয়ে ধন্য হয়েছে সে দেশের বিলিয়নিয়াররা।
নিজ দলের উপর তাঁর এমনি নিয়ন্ত্রণ যে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়নের জন্য নির্বাচনের সময় দলের ৭২০ সুপার ডেলিগেটদের মধ্যে ৫২০ জন সমর্থন দিয়েছেন তাঁকে। তার পরেও মনোনয়ন নিশ্চিত করতে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধানকে কাজে লাগিয়ে অন্যায় ভাবে হারিয়ে দিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নি স্যান্ডার্সকে। ডেমোক্রেটিক পার্টির সার্ভার হ্যাক করে এমন তথ্য বিশ্ববাসীকে জানিয়েছে উইকিলিক্স খ্যাত জুলিয়ান আসাঞ্জ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত অত্যন্ত গোপনীয় ইমেইল চালন করে দিয়েছেন নিজের ব্যাক্তিগত সার্ভারে – এ খবর দিয়েছে খোদ পররাষ্ট্র দফতর। তাঁর ব্যাক্তিগত সার্ভার হ্যাক করে উইকিলিক্স জানিয়েছে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা না মেনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তিনি অর্থ এবং অস্ত্র সররাহ করেছেন লিবিয়ার সন্ত্রাসীদের। তাঁর সময়কালে যুদ্ধ লেগেছে লিবিয়ায়, সিরিয়ায়; নর্দমায় ফেলে কুকুরের মত হত্যা করেছেন ৪০ বছর ধরে রাজত্ব করা লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মর গাদ্দাফীকে; ইরাকে বোনা হয়েছে পরবর্তী যুদ্ধের বীজ; পুরোপুরি দখলের পরেও শান্তি স্থাপন হয়নি আফগানিস্থানে। ট্রাম্প সমর্থকেরা যুদ্ধবাজ, দূর্ণীতিবাজ, ক্ষমতালোভী হিসেবে আপন মানসে তাঁর ছবি এঁকেছে।
অন্যদিকে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসী, মেক্সিকান, নারী, কালো মানুষ, হিস্প্যানিক, মুসলিম, প্রতিবন্ধীদের বিরুদ্ধে আজেবাজে মন্তব্য করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ১০/১২ জন নারী বিভিন্ন সময়ে যৌন হয়রানীর অভিযোগ করেছেন গণমাধ্যমের সামনে। তিনি আমেরিকার দীর্ঘ দিনের মিত্রদের সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন; সকল দেশের সঙ্গে সম্পাদিত বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করার কথা বলেছেন; ১ কোটি ১০ লক্ষ অভিবাসীকে ফেরত পাঠানোর কথা বলেছেন; জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়কে ভুয়া বলে মন্তব্য করে বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের জন্য সকল তহবিল বাতিল করবেন। তাঁর এসব মন্তব্যের এবং কর্মকাণ্ডের কারণে অনেক বড় বড় রিপাবলিকান নেতা তাঁর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। হিলারি সমর্থকেরা তাঁকে একজন চরম রক্ষণশীল, উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং ফেসিস্ট হিসেবে চিত্রায়িত করেছেন।
এরকম একজন বাজে মানুষ আমেরিকার নির্বাচনে জিতল কি করে? এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা শুরু হওয়ার পর থেকে। ট্রাম্প জেতার প্রধান কারণ হিলারি নিজেই। হিলারির সমস্ত যোগ্যতাই তাঁর অযোগ্যতায় রূপান্তরিত হয়েছে। ডেমোক্রেটিক পার্টির ভেতরের লোকেরা হিলারির ইমেইল কেলংকারী, দান বাক্স খুলে চাঁদাবাজি, তাঁর স্বামীর একাধিক যৌন নির্যাতন, দলকে অন্যায় কাজে ব্যাবহার করা, ওয়াল স্ট্রীটের সংযুক্ততা, ইত্যাদি’র প্রতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি দিয়েছিলেন বলে তিনি স্যান্ডার্সের মত একজন জনহিতৈষী মানুষকে হারিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির মত একটা প্রগতিশীল দলের প্রার্থী হতে পেরেছেন। নির্বাচনে দাঁড়ালেই তিনি জিতে যাবেন বলে তাঁর দল ধরে নিয়েছিল।
২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং তারপরের অর্থনৈতিক মন্দার ফলে খেটে খাওয়া মানুষের অর্থনৈতিক কষ্ট থেকে রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর যে ক্ষোভ জমে ছিল ডেমোক্রেটিক পার্টি তা কেয়ার করেনি। তাঁর দল বিবেচনা করেনি কেন বাঘা বাঘা রিপাবলিকান প্রার্থীদের কেউই কেন ট্রাম্পের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেনি; সাধারণ মানুষের ভাগ্যপরিবর্তনের কথা বলে জাতীয় রাজনীতিতে অচেনা স্যান্ডার্স এবং ট্রাম্প দুজনেই মনোনয়ন পর্বে অকস্মাৎ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। ডেমোক্রাটরা ক্লিনটন নেটওয়ার্কের প্রভাবে এবং চাপে এতটাই অন্ধ ছিলেন যে প্রার্থী নির্বাচনে তারা বিচক্ষণতার প্রমাণ রাখতে পারেননি।
অন্যদিকে এই নির্বাচনে জেতার জন্য রিপাবলিকান পার্টি ট্রাম্পকে ট্রাম্প করেছিলেন। পার্টি নেতারা চাইলে ট্রাম্পের শত জনপ্রিয়তার পরেও তাঁকে প্রার্থী না করতে পারতেন। এ জন্য তাদের হাতে দুইটা ব্রাক্ষাস্ত্র ছিল। মনোনয়ন পর্বে ট্রাম্পকে হারানোর জন্য তারা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্য থেকে একজনকে রেখে অন্যদের বসিয়ে দিতে পারতেন। রিপাবলিকান দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এমন ক্ষমতা ছিল যে তাঁরা চাইলে মনোনয়ন নির্বাচন শেষ হওয়ার পরেও তা অস্বীকার করে অন্য যে কাউকে মনোনয়ন দিতে পারতেন। রিপাবলিকান নেতারা তা করেননি। তারা জানতেন ট্র্যাডিশনাল রিপাবলিকান প্রার্থী দিয়ে হিলারিকে হারানো যাবে না। হিলারিকে হারানোর জন্য খেলার মাঠই তারা পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। নির্বাচনকে তারা প্রচলিত সমাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্টনীতির মাঠ থেকে তুলে বর্ণবাদ, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ, রক্ষণশীলতা, গোঁড়ামি, কেলেঙ্কারি, ইত্যাদি মাঠে নিতে চেয়েছিলেন যে মাঠে হিলারি ভাল খেতে পারবেন না; ট্রাম্পের মত একজন বিকৃত চরিত্রের মানুষই পারবে এ মাঠে ভাল খেলতে। রিপাবলিকান স্ট্রাটেজি সফল হয়েছে।
মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং উদার বাণিজ্যনীতির ফলে কমে গিয়েছিল শ্রমিকের মজুরী। ট্রাম্প বলেছে, সব দেশের সঙ্গে সব বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করবেন, আমেরিকান কারখানা চিন, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো থেকে দেশে ফেরত আনবেন, অভিবাসীদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবেন। কম শিক্ষিত, সাদা, খেটে খাওয়া মানুষেরা এর মধ্যে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের আশার আলো দেখতে পেয়েছেন। ট্রাম্প খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য অধিক কর্মসংস্থানের কথা বলেছেন, শিক্ষা এবং চিকিৎসা সহজলভ্য করার কথা বলেছেন। ট্রাম্প অর্থনীতির চেয়ে অনেক কার্যকর এবং দরিদ্র বান্ধব অর্থনীতি দেয়ার পরেও শ্রমজীবী সাদা মানুষেরা হিলারির উপর আস্থা রাখতে পারেননি। তাঁকে তারা ধনীদের বন্ধু এবং ভণ্ড, দুর্নীতিবাজ হিসেবে বিবেচনা করেছে। পক্ষান্তরে, ট্রাম্পের চারিত্রিক দূর্বলতা সত্ত্বেও তাঁর সরাসরি কথা বলার ধরনের কারণে তাঁকে আপন করে নিয়েছে।
২০০১ সাল থেকে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা এবং যুদ্ধে জড়িয়ে মার্কিন রাজকোষের ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে; জুটেছে আমেরিকানদের জন্য বিশ্ববাসীর নিন্দা; তৈরি করা হয়েছে ইসলামের নামে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। সাধারণ মানুষ দেখেছে ইসলামই হচ্ছে যত নষ্টের গোঁড়া। মুসলমানদের দেশে ঢুকতে দেয়া হবে না বলে ট্রাম্প এইসব মানুষদের আশ্বস্ত করেছেন। হিলারিকে সহজেই এইসব যুদ্ধের অনেকগুলোর জন্য দায়ী করা সহজ হয়েছে। মার্কিন সমাজে মুসলিম বিদ্বেষ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে নিজেদের অভিবাসন স্বার্থ ভুলে বাঙালি অমুসলিমেরাও ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে; এশিয়ানদের গালাগালি করার পরেও চিনারা ছিল ট্রাম্পের পক্ষে; খ্রিষ্টান কালো মানুষদের অনেকে ভোট দিয়েছে ট্রাম্পের বাক্সে। ব্যাক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে জানতে পারলাম, ওবামাকেয়ারের বীমা প্রিমিয়ামের দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য স্বচ্ছল বাঙালি মুসলিমও ভোট দিয়েছেন ট্রাম্পের হাতি মার্কায়।
ট্রাম্পের মত একজন উগ্র জাতীয়তাবাদী, বর্ণ এবং নারী বিদ্বেষী, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক লোককে ভোট দেয়নি সে দেশের সুস্থ বুদ্ধির প্রগতিশীল মানুষেরা। হিলারির সকল অপকর্মের পরেও তারা দুই অসুরের মধ্যে চেনা অসুরকে বেছে নিয়েছে; বিকৃত মানসিকতার ট্রাম্পকে নয় ভোট দিয়েছে ডেমোক্র্যাটিক বাক্সে। স্যান্ডার্স প্রার্থী হলে হিলারির সকল ভোটের সঙ্গে যোগ হত কম শিক্ষিত, সাদা, খেটে খাওয়া মানুষের ভোট। দুশ্চরিত্রের, রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ ট্রাম্পকে নয় স্যান্ডার্সের উপর তারা আস্থা রাখত। হিলারি হেরে যাওয়ায় আগামী দিনের বিশ্ব বাণিজ্য, রাজনীতি, সমরনীতি পড়েছে অনিশ্চয়তায়; আশংকায় পড়েছে বিশ্ব ব্যবস্থার ভারসাম্য; বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার আভাস দিয়েছেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান। স্যান্ডার্স প্রার্থী হলে জিতে যেত মানবতা, প্রগতিশীলতা; বিশ্বব্যাপী অনেকখানী কমে যেত ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)