আর একদিন পরেই হোয়াইট হাউজের নতুন বাসিন্দা হতে চলেছেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রস্থান আর ট্রাম্পের প্রবেশের এই সময়টা যেনো ৫ ঘন্টার এক সুনামি।
প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারের পরিবর্তনের এই কর্মযজ্ঞকে ‘সুশৃঙ্খল হট্টগোল’ বলে অভিহিত করেছেন গ্যারি ওয়াল্টার। যিনি ২১ বছর যাবত হোয়াইট হাউজের প্রধান সহকারী (গৃহস্থলী কাজের কর্মচারীদের প্রধান) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বেশ কয়েকটি পরিবারের এমন পরিবর্তনের আয়োজনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার।
২০ জানুয়ারি, শুক্রবার ট্রাম্পের অভিষেক দিনের আগে এবং সেই ৫ ঘন্টার বিপুল কর্মযজ্ঞ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
‘উদ্দিপণাপূর্ণ কিন্তু ক্লান্তিকর’ আমেজের সেই দিনটির কথা শোনা যাক। ভোর থেকেই নানা কাজ ও আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও মূল হট্টগোলের সূচনা হবে সকাল সাড়ে দশটা থেকে, বারাক ওবামার হোয়াইট হাউজ ত্যাগের পর।
দিনের শুরু: হট্টগোলের আগে শান্ত
হোয়াইট হাউজের স্থায়ী এবং কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্মচারী ভোর ৪ টা থেকেই প্রধান সহকারীর নেতৃত্বে এই পালাবদলের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবে। এই বাহিনীর সংখ্যা কিন্তু ৯০ জনেরও বেশি। প্রধান সহকারী অ্যাঞ্জেলা রেইডের ক্ষেত্রে এবারেরটি প্রথম হলেও অন্যান্যরা কম করে হলেও একবার এর অভিজ্ঞতা পেয়েছে। কারণ এখানে কর্মচারী পরিবর্তন বিরল ঘটনা।
তবে রান্নার কাজে নিয়োজিত কর্মচারীরা এই যজ্ঞ থেকে বিরত থাকে। কারণ তারা এক বিশাল সংখ্যক মানুষের জন্য নাস্তা, ঐতিহ্যবাহী কফি, দুপুরের স্ন্যাক্স, ডিনার এবং পরবর্তী দিনের সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর প্রস্তুতি শুরু করে।
আবার পূর্ব থেকেই নতুন প্রেসিডেন্টের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস গ্রাউন্ড ফ্লোরে এনে রাখা শুরু হয়। তবে এক্ষেত্রে যথেষ্ট বিনয় এবং গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় যাতে বিদায়ী প্রেসিডেন্টের মনে কোন বিরূপ ধারণার (যেমন আমাকে বেরিয়ে যেতে বলছে) জন্ম না হয়। বা এমন পরিবেশ সৃষ্টি না হয়।
সময় ঘনিয়ে আসছে
সকাল সাড়ে আটটায় সকল কর্মচারীরা ওবামার পরিবারকে বিদায় জানাতে ডাইনিং রুমে সমবেত হবে। এসময় বিদায়ী প্রেসিডেন্টকে একটি বিশেষ উপহারও দিবে তারা। ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের বিদায়ের সময় যার প্রচলন করেছিলেন তৎকালীন প্রধান সহকারী ওয়াল্টার। ঐতিহাসিক হোয়াইট হাউজ কাঠের তৈরি একটি বক্স উপহার দিয়েছিলেন তিনি, যেখানে প্রেসিডেন্টের অভিষেক ও অফিসের শেষদিন সকালে হোয়াইট হাউজে উড়ানো পতাকাগুলো থাকে।
এই সময়টা সবসময়ই প্রবল আবেগের। এর আগের প্রধান সহকারী স্টিফেন রোশান স্মৃতিচারণ করে বলেন, “কর্মচারীদের সাথে কথা বলার সময় প্রেসিডেন্ট বুশ (জুনিয়র) অশ্রুসজল ছিলেন। একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে আমার কান্নার কথা ছিলো না, কিন্তু আমিও কেঁদেছিলাম এবং অন্যান্য স্টাফদেরও একই অবস্থা হয়েছিলো।”
স্টাফদের সাথে কিছু সময় কাটানোর একঘন্টা পর হোয়াইট হাউজে শেষ বিদায়ী আনুষ্ঠানিকতায় প্রেসিডেন্ট অংশ নিবেন, এতে নতুন ও পুরাতন ভাইস প্রেসিডেন্টের পরিবার এবং কংগ্রেসের প্রহরীদের সাথে ব্লু রুমে এক কাপ কফি পান করবেন তিনি।
সকাল সাড়ে দশটায় নর্থ পোর্টিকো দিয়ে ওবামা পরিবার হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করবেন। লিমুজিনে করে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে ক্যাপিটল।
সকাল ১০:৩১, হুড়োহুড়ির শুরু
বিদায়ী পরিবার অধিকাংশ জিনিসপত্র প্যাকিং করে গেলেও কর্মচারীরা এবার রেখে যাওয়া জিনিসপত্র বাক্সে ভরবেন। বিশেষত প্রেসিডেন্টের লিভিং কোয়ার্টার প্রথম ও দ্বিতীয় তলা এবং ওয়েস্ট উইংয়ের পুরোনো জিনিসগুলো বাক্সবন্দী করা হবে।
সকল গোছগাছ শেষে তা ট্রাকে তোলা হবে। ট্রাক থেকে নামানোর কাজে পেশাদারদের কাজে লাগানো হলেও হোয়াইট হাউজের ভেতরে পণ্য আনা-নেওয়ার কাজ ঘরের কর্মচারীরাই করে। গোয়েন্দা বাহিনী ও ইউএস পার্ক পুলিশের নিরাপত্তায় বিদায়ী প্রেসিডেন্টের ট্রাক সাউথ পোর্টিকোর ড্রাইভওয়ের পশ্চিম দিয়ে বেরিয়ে যাবে আর নতুন প্রেসিডেন্টের ট্রাকগুলো পূর্ব দিয়ে প্রবেশ করবে, বরাবরের মতো।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, মেরামত
বিদায়ী প্রেসিডেন্টের সকল জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় পুরো বাড়ি জুড়ে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম। প্রতিটি অংশ মুছে-ঘষে পরিষ্কার করা হয়। এছাড়াও নতুন প্রেসিডেন্টের পোষা প্রাণীতে অ্যালার্জি থাকলে তাদের দূর করা হয়। রুমের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা মাত্রা নতুন পরিবারের পছন্দ অনুযায়ী সেট করা হয়।
গ্যাস লাইন, কাঠের কাজ সকল ক্ষেত্রেই ছোটখাট মেরামত করে নেয়া হয়। নতুন শিল্পচিত্র টানানো হয়। পেইন্টারেরও ডাক পরে। কিন্তু অভিষেকের দিনে কোন বড় ধরনের মেরামত, পেইন্টিং হয় না। কারণ সময় খুবই কম।
বেডরুম ঠিক করা
দরজা-দেয়ালের পার্টিশন খোলা-বন্ধ করে বেডরুমেও পরিবর্তন আনা হয়। এমননিতে হোয়াইট হাউজে ১৬টি বেডরুম রয়েছে। রিগান পর বুশ আসলে এর অধের্কের পরিবর্তন আনতে হয়েছিলো, বুশের বড় পরিবারের কারণে।
মেট্রেস, হেড শাওয়ার, শ্যাভিং ক্রিম থেকে শুরু করে সকল সকল ধরনের প্রয়োজনী জিনিস কিনে নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়। রান্নাঘর বা অন্যান্য স্থানেও প্রয়োজনীয় জিনিস মজুদ করা হয়।
তরতাজা ফুল দিয়ে সাজানো হয় গোটা বাড়ি। থিয়েটারে নতুন মুভির সংকলনগুলো জমা করে রাখা হয়। ছাদের সাজসজ্জ্বাতেও কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়।
ওভাল অফিস
তবে সাজসজ্জায় অন্যান্য রুমের পরিবর্তনের হলেও ওভাল অফিসকে সেই রকমই রাখা হয়।নতুন প্রেসিডেন্ট চাইলে সকল আসবাব আর্টওয়ার্ক, পর্দার পরিবর্তন করা হয়। এর মাঝেই ন্যাশনাল আর্কাইভ এবং রেকর্ডস প্রশাসনের কর্মচারীরার পুরো অফিস পরিষ্কার করে, যাতে পুরোনো প্রশাসনের কোন নথি থেকে না যায়। কম্পিউটার হার্ড ড্রাইভও তারা তা দেখে নেয়।
শেষ মিনিট
আড়াইটার মধ্যে অভিষেক প্যারেড শরু হয় এবং প্রধান সহকারী নিশ্চিত করে যে, সব ঠিক আছে। এসময় অনাকাঙ্খিত কিছুও ঘটতে পারে যার জন্য তাকে প্রস্তুত থাকতে হয়। জর্জ ডব্লিউ বুশের (সিনিয়র) প্যারেডের সময়টিতে তার নাতি জমজ বোন বারবারা ও জেনা বিরক্ত হয়ে উঠালে তাদের ফুল সাজানোর সংক্ষিপ্ত একটা ক্লাস করাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।
সাড়ে তিনটা: ডেডলাইন
সাড়ে তিনটা থেকে ৫টার মধ্যে নতুন পরিবার নতুন করে সাজানো হোয়াইট হাউজে ফিরেন। সাউথ পোর্টিকো দিয়ে তারা প্রবেশ করলেই প্রধান সহকারী রেইড তাদের সম্ভাষণ জানাবেন, প্রথমবারের মতো বলবেন, “নতুন বাসায় আপনাদের স্বাগতম, প্রেসিডেন্ট।”