মুলতান মনে আছে? ইনজামাম-উল-হক? কিংবা ফতুল্লায় জেসন গিলেস্পি? একটা জয়ে জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকা বাংলাদেশের হাত থেকে মঞ্চ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন দুজনে। এ তো গেল প্রতিপক্ষের হাতে বঞ্চিত হওয়ার কথা। নিজেরাই ছুঁড়ে আসার ইতিহাসও তো কম নয়। টাইমমেশিনে চড়ে খুব বেশি পেছনে যাওয়া দরকার নেই, নিকট অতীতে তাকালেই চলবে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রামে, নিউজিল্যান্ড আর ভারতে সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটানোর দৃশ্যগুলো গলেও দেখা গেছে। কলম্বোতেও মাথাচাড়া দিচ্ছিল। ২২ রানেই দুই উইকেট নেই। শেষ পর্যন্ত আর পা হড়কায়নি। টেস্ট ক্রিকেট ইজ দ্য বেস্ট ক্রিকেটের মঞ্চে নিজেদের শততম টেস্টে জিতেই ফিরেছে বাংলাদেশ।
গলে প্রথম টেস্টে জিতে এগিয়ে ছিল শ্রীলঙ্কাই। তবে পিছিয়ে ছিল না বাংলাদেশও। শুধু নিজেদের সামর্থ্যটা মাঠের পারফরম্যান্সে অনূদিত করার দরকার ছিল। সেটা করা গেছে। তার আগে ম্যাচের পরতে পরতে জমে থাকল টেস্ট ক্রিকেটের রোমাঞ্চ।
শুরুতে ব্যাট করে ৩৫ রানেই লঙ্কানদের প্রথম ইনিংসের তিন উইকেট নেই। পরে কয়েকটি মাঝারি ইনিংস আর দিনেশ চান্দিমালের ঝলমলে এক সেঞ্চুরিতে তিনশ পেরিয়ে গেল স্বাগতিকদের সংগ্রহ। বোলিংয়ে অবদান রাখলেন বাংলাদেশের প্রায় সকলেই। মিরাজের সর্বোচ্চ ৩টি।
নিজেদের ব্যাটিংয়ের পালা এলো এরপর। স্বপ্নের এক শুরু এনে দিলেন তামিম-সৌম্য, ৯৫ রানের জুটি। এরপর দ্রুত কয়েকটি উইকেট হারিয়ে লাইনচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা। দ্বিতীয় দিন বিকেলের ওই পথ হারাতে থাকা তৃতীয়দিনে সামলে নিলেন মুশফিক-সাকিব। টেনে তুললেন ৯২ রানের জুটিতে, টাইগার অধিনায়কের অবদান ৫২!
সাকিব পরে আরো অনেকক্ষণ থাকলেন। অভিষিক্ত মোসাদ্দেককে নিয়ে তুলে নিলেন সেঞ্চুরি। ১১৬ রানের ইনিংসটা তাকে বসিয়ে দিল আরো সাত কীর্তিমানের পাশে। যারা দেশের শততম টেস্টে শতক ছুঁয়েছিলেন। সাকিব ফিরলে ভারটা বইলেন তরুণ মোসাদ্দেক। শুধু বইলেন না, প্রথম ইনিংসে ১২৯ রানের লিড এনে দেওয়া পথে ৭৫ রানের ঝলমলে একটি ইনিংস খেললেন। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ফেরার সময় বাংলাদেশের নামের পাশে ৪৬৭ রানের সংগ্রহ বসিয়ে গেলেন।
দ্বিতীয় ইনিংসে ফিফটির ওপর উদ্বোধনী জুটি গড়ার পর লঙ্কানরা চোখ রাঙাচ্ছিল। তখন ত্রাতা মোস্তাফিজ-সাকিব। প্রথম ইনিংসে দুটির পর দ্বিতীয় ইনিংসে সাকিবের চারটি। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর শুরুটা করে দিয়েছিলেন মোস্তাফিজ। চোট আর পুনর্বাসন শেষে মাঠে ফিরে রঙিন পোশাকে খেলেছেন। টেস্টে শ্রীলঙ্কাতে তাই প্রত্যাবর্তনই তার। ছাপটাও রেখে দিলেন দ্রুত কয়েকটি উইকেট তুলে নিয়ে। শুধু সংখ্যার বিচারে হয়তো তিন উইকেট, কিন্তু ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় সেটি তিনশ!
চতুর্থদিন শেষ বিকেলে সেঞ্চুরিয়ান করুনারত্নেকে ১২৬ রানে ফেরানো গেল। কিন্তু অলআউট করা গেল না স্বাগতিকদের। পঞ্চম দিনে তো চীনের প্রাচীরই গড়লেন পেরেরা-সান্দাকান। দুজনের অবদান যথাক্রমে ৫০ ও ৪২ রান করে। ইতিহাসে নাম লেখাতে বাংলাদেশের লক্ষ্যটা হয়ে দাঁড়াল ১৯১!
লক্ষ্যটা আহামরি নয়! আবার গড়পড়তাও নয়! ২২ রানে দুই উইকেট হারিয়ে তাতে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ডেকে আনলেন সৌম্য-ইমরুল। এরপর আবারো টেস্টের রোমাঞ্চ। সেখান থেকে বাইশ গজের ক্যানভাসে রং-তুলির নিপুণ শিল্পী হয়ে উঠলেন বহু জয়ের সারথি তামিম। সঙ্গী সাব্বির। ১০৯ রানের জুটি। সবকিছু যখন কক্ষপথে, তামিম ৮২ রানে উইকেট বিলিয়ে গেলেন। সাব্বির ৪২, সাকিব ১৫; শঙ্কায় বাংলাদেশ।
টেস্ট ক্রিকেটের সবটুকু ডানা তখন মেলেছে পি সারায়। একটু পা হড়কালেই শামুকে কাটা যাবে জয় বাংলা কাপ সিরিজে সমতা ফেরানোর স্বপ্ন, শততমের মাইলফলকের মঞ্চে জয়ের ইতিহাস।
ঠিক এসময় যার হাত ধরে তীরে নোঙর ফেললে পূর্ণতা পায়, সেই অধিনায়ক মুশফিকই এগিয়ে এলেন তলোয়ার নিয়ে। সঙ্গী অপার সম্ভাবনার জানান দেওয়া মোসাদ্দেক। দুজনে সাদা পোশাকের ম্যাচকে জয়ের রঙে রঙিন করার মঞ্চ গড়েই বিচ্ছিন্ন হয়েছেন।
ওয়ানডেতে বাংলাদেশের জয়ের অভ্যাসটা তৈরি হয়ে গেছে। টি-টুয়েন্টিতে গুছিয়ে নেওয়ার পর্ব চলছে। কিন্তু টেস্টে সবকটি ডানা না মেললে যে অভিজাতদের কাতারে পৌঁছানো যাবে না। টেস্ট ক্রিকেট যে বেস্ট ক্রিকেট। রোববার পি সারার ক্যানভাসে সেই বেস্ট ক্রিকেটের মঞ্চে দৃপ্ত পদচারণার পথে আরেকধাপ এগিয়ে গেল লাল-সবুজের বাংলাদেশ। সবটুকু আলো কেড়ে নিয়ে। সবটুকু রং-তুলির আঁচড় কেটে।