বছরখানেক আগে পাকিস্তানের বোলিং কোচ আজহার মাহমুদ বলেছিলেন, পেসার মোহাম্মদ আমিরকে ওয়ানডের চেয়ে টেস্টেই বেশি চান তিনি, ‘আমরা চাই সে টেস্ট ক্রিকেট খেলুক। কারণ তিনি আমাদের নাম্বার ওয়ান বোলার। কিন্তু তাকে নিয়ে আমাদের উদ্বেগ এটা যে, ভবিষ্যতে আমরা তার উপর থেকে চাপটা কমাতে পারব কিনা।’
বছর ঘুরতে ঘুরতেই নিজের ওপর থেকে চাপটা কমিয়ে নিলেন আমির নিজেই। কোচের চাওয়া পাশে ঠেলে শুক্রবারই টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন বাঁহাতি এই পেসার। তবে সাদা পোশাক ছেড়ে দিলেও রঙিন পোশাকে খেলা চালিয়ে যাবেন তিনি।
ক্রিকেটের ‘তীর্থভূমি’ লর্ডস যেখানে স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে ক্যারিয়ারই শেষ হতে বসেছিল আমিরের। ২০১০ সালে কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞার পর ২০১৬তে আবার ক্রিকেটে ফেরেন পাকিস্তানি পেসার।
দীর্ঘ বিরতির পরও নিজের জাত ধরে রেখে নিয়মিত হয়েছেন তিন ধরনের ক্রিকেটেই। পাকিস্তানের পেস ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমিরই। প্রতিটি ফরম্যাটে খেলার কারণে তার উপর চাপও পড়ছে।
এক বিবৃতিতে ২৭ বছরের আমির বলেছেন, ‘শীর্ষ এবং ঐতিহ্যপূর্ণ ফরম্যাটে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করাটা সম্মানের। তবে সাদা বলে (ওয়ানডে-টি-টুয়েন্টি) আমি যাতে বেশি সময় দিতে পারি সেজন্যই এই সিদ্ধান্ত।’
বিবৃতিতে তার আরও সংযোজন, ‘বাকি সময়েও পাকিস্তানের হয়ে খেলা আমার একমাত্র লক্ষ্য। আগামী বছরের আইসিসি টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের সঙ্গে দলের আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলোতে অবদান রাখার জন্য আমি শারীরিকভাবে নিজেকে ফিট রাখতে যথাসাধ্য এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
ক্যারিয়ারের ৩৬ টেস্টে ১১৯টি উইকেট নিয়েছেন আমির। তিনি বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত নেয়াটা মোটেও সহজ ছিল না। এটা নিয়ে আমি অনেক সময় ভেবেছি। আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ কাছে আসছে। পাকিস্তানও কিছু তরুণ পেসারকে সামনে আনতে চায়। ফলে এটাই আমার জন্য শেষ বলে দেয়ার সঠিক সময়। এর ফলে নির্বাচকরা সেইমতো পরিকল্পনা করতে পারবেন।’
‘আমি লাল বলের (টেস্ট) ক্রিকেটে আমার দলের সকল সতীর্থ এবং প্রতিপক্ষকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই। কারণ তাদের সাথে এবং তাদের বিরুদ্ধে খেলাটা আমার জন্য বিশেষ সুযোগ ছিল। আমি নিশ্চিত যে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে আমাদের পথ ক্রমাগত চলবে, কারণ আমরা সবাই একই জোর এবং দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করি।’
অনেক বিরোধিতার পরও নির্বাসন শেষে তাকের দলে নিয়েছে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড। তাই বিদায় বেলায় দেশের ক্রিকেট বোর্ডকেও ধন্যবাদ জানাতে ভুল করেননি আমির, ‘আমার বুকে সোনালী তারকা জড়ানোর সুযোগ পাওয়ার জন্য পিসিবিকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তাছাড়া আমার ক্যারিয়ারের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাকে তৈরি করেছেন এমন সব কোচদের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ।’
আমিরের বিদায়ে বিবৃতি দিয়েছে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডও। পিসিবির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ওয়াসিম খান বলেছেন, ‘ সাম্প্রতিক সময়ে আমির টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ এবং প্রতিভাবান বাঁহাতি ফাস্ট বোলারদের মধ্যে একজন। তিনি একজন তরুণ ক্রিকেটার হিসাবে বিপদকে পরাভূত করেছিলেন এবং শুধু ক্রিকেটার হিসাবে নয় বরং একজন ভালো মানুষ হিসেবেও শক্তিশালী হয়েছিলেন। তার দক্ষতা, মাঠে এবং মাঠের বাইরে তার ব্যক্তিত্ব পাকিস্তান ড্রেসিংরুম মিস করবে। তবে, আমরা তার সিদ্ধান্তকে সম্মান করি এবং সাদা বলের ক্রিকেটে তিনি পাকিস্তানের জন্য ভূমিকা পালন করতে থাকবেন।’
২০০৯ সালে গলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকের পর এ পর্যন্ত ৩৬ টেস্টে ৩০.৪৭ গড়ে ১১৯ উইকেট নেন আমির। তার সেরা বোলিং ৪৪ রানে ৬ উইকেট, ২০১৭তে কিংসটনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।
আরও দুই বছর আগেই অবশ্য টেস্ট থেকে অবসর নেয়ার চিন্তা করেছিলেন পাকিস্তানের আলোচিত পেসার। দলের ঘনিষ্ঠ কয়েক জনের সঙ্গে বিষয়টি তিনি শেয়ারও করেন। সেই কথা আবার পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমে তখন চাউর হয়ে যায়। ঘটনার পর আমির মানসিকভাবে আহত হন। কে ফাঁস করলো, সেটা জানতে পিসিবিও তদন্তে নামে।
তখন পাকিস্তানি গণমাধ্যম দাবি করে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্ট শেষে আমির অবসর নিয়ে ভাবতে থাকেন। টি-টুয়েন্টি এবং ওয়ানডেতে মনোযোগ দিতে তার এই ভাবনা। সে সময় না হলেও পাকিস্তানি মিডিয়ার সেই দাবি দু’বছর পর হলেও সত্যি হল।
২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ওঠে আমিরসহ পাকিস্তানের তিন ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে। পরে এ ঘটনায় ইংল্যান্ডে জেল খাটেন আমির। আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পাঁচ বছর নির্বাসনে ছিলেন। জেল হয় তার অন্য দুই সতীর্থ তৎকালীন অধিনায়ক সালমান বাট ও পেসার মোহাম্মদ আসিফের।
দীর্ঘ বিরতি পর চলতি বছর আবার দেশের জার্সি গায়ে তোলার সুযোগ পান আমির। তবে সেটা এতো সহজে হয়নি। আন্তর্জাতিকভাবে তো ছিলই, নিজ দেশের বাঘা বাঘা অনেক সাবেকও আমিরের মাঠে ফেরার ঘাের বিরোধী ছিলেন। শুধু সাবেকরা কেন, তার দলের বর্তমান সতীর্থদের অনেকেই পষ্ট করে বলেছিলেন আমির ফিরলে দলের হয়ে খেলবেন না তারা। যার জন্য মাঠ থেকে কেঁদেও ফিরতে হয়েছিল এই পেসারকে।
অনেক বিরোধীতা যেমন ছিল তেমনি সহানুভূতিও পেয়েছেন। ইমরান খান থেকে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস থেকে শহিদ আফ্রিদ সবাই আমিরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বেকে বসা দু-একজনও তাকে মেনে নেন।
যেকোনো ইভেন্টের একজন খেলেয়াড়ের জন্য পাঁচ বছর বিরাট সময়। এতো সময় বাইরে থেকে নিজের আসল কাজটা ধরে রাখা বেশ কঠিন। তবে আমির যেন আন্তদহণে আরো খাঁটি হয়ে ফেরেন। নির্বাসন শেষে মাঠে ফিরেই ঝড়। কায়দে আজম ট্রফির প্রথম চার ম্যাচেই ২৬ উইকেট তুলে নেন তিনি। এরপর আর পেছেন তাকাতে হয়নি তাকে।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ২০১৬ আসলে দারুণ শুরুর পর পিসিএলে সমান উজ্জ্বল পারফরম্যান্স তার। ক্যারিয়ারের প্রথম হ্যাটট্রিকটাও তুলে নেন সেখানে।
এর পর নিউজিল্যান্ড সফরের টি-টুয়েন্টি ও ওয়ানডেতে নিজের সেরাটা প্রমাণের পর ঝলক দেখান ভারতে অনুষ্ঠিত ২০১৬’র টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপেও। এক স্পেলেই রোহিত-কোহলি-রাহানেসহ তিন উইকেট নিয়ে মামুলি টার্গেটে ব্যাট করতে নামা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন।
টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে কাঁপন ধরিয়ে কিছু করতে না পারলেও এক বছর পর ঠিকই পেরেছেন আমির। ২০১৭’র চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে রোহিত-কোহলি-ধাওয়াকে এক স্পেলে বিদায় করে দলকে শিরোপা এনে দেন তিনি।
সবশেষ বিশ্বকাপেও কম যাননি আমির। পাকিস্তান সেমিফাইনালে উঠতে পারলেও আমির ছিলেন আমিরে। সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহকদের তালিকায় সাতনম্বরে। আট ম্যাচ খেলে ২৫.৭ গড়ে উইকেট নেন ১৭টি।