চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

টুঙ্গীপাড়ার স্মৃতি

টুঙ্গীপাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ। সেই সৌধে কিছুটা সময় কাটানো এক সুন্দর স্মৃতির কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।

তিনি তার পোস্টে লিখেছেন,

‘অনেকে শিরোনাম দেখেই চমকে উঠবেন জানি। ইদানীং দেখছি দলবেঁধে অনেকেই টুঙ্গীপাড়া যাচ্ছেন, অবিরাম সেলফি বর্ষণ করছেন। এই মৌসুমী ভক্তদের ভীড়ে আমার টুঙ্গীপাড়ার স্মৃতি কারো কাছে পানসে মনে হবে। কেউ কেউ আমাকেই মৌসুমী ভক্ত মনে করবেন।

ক্ষমতাসীন দলের ভক্তসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে। ঝাঁকে ঝাঁকে। এটা আগেও দেখেছি। বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাব গঠনের কিছুদিনের মধ্যে, ৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আশাতীত ভালো ফল নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করল। ঝাঁকে ঝাঁকে বেড়ে গেলো এর সদস্য সংখ্যা। ছাত্রজীবনে যারা ছাত্রদল করে এসেছেন, তারাও অনেকে পিছনে পড়ে গেলেন, মৌসুমীদের ভীড়ে। ক্ষমতার পালাবদলে এই মৌসুমী ভক্তরা ঠিকানা বদল করেন।

আমার নিজের কর্মস্থলে ২০০১-২০০৭ মৌসুমে যাদের দেখলাম কোর্সে ভর্তি, প্রমোশন, এমনকি একসাথে ডাবল প্রমোশন নেয়ার জন্য ড্যাবের সদস্য ও প্রচন্ড জিয়াভক্ত, টানা দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তারা স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নেতা বনে গেছেন। মুগ্ধ হয়ে এদের বক্তৃতা শুনি। ১৮ বছর একসাথে চাকরি করার পর যার মুখে একবার বঙ্গবন্ধু নামটা শুনেছি মনে পড়ে না, মিনিটে মিনিটে তার মুখে বঙ্গবন্ধু আর জননেত্রী বন্দনা। যাদেরকে চিনি জেনুইন আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে অনেক দিন ধরে, তারা কেমন যেন ম্রিয়মান হয়ে থাকেন। সবক্ষেত্রে, সব আমলে হাইব্রিড আর কাউয়াদের দৌরাত্ম।

আমি কেন বলছি এসব? কারণ আছে। আমার অভিজ্ঞতা বলে, যাদের ছাত্র বা পেশাজীবী রাজনীতির নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা আছে, প্রাতিষ্ঠানিক/ প্রশাসনিক দায়িত্বে অন্যদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে তাদের পারফরম্যান্স ভালো। আর নেতৃত্বের অভিজ্ঞতাহীন তথাকথিত ‘ভাল ডাক্তার’ কোন ফাঁকে এ ধরণের পদে আসীন হলে তেলবাজি আর বন্দনায় তাদের সময় চলে যায়, প্রতিষ্ঠানের বারোটা বাজতে সময় লাগে না।

২০০৩ সালের কথা। ক্যান্সার ইন্সটিটিউটের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। ‘ওরিয়েন্টেশন অব কমিউনিটি লিডারস অন প্রিভেনশন এন্ড আরলি ডিটেকশন অব ক্যান্সার’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরি সহায়তায়। আমি তখন চীফ মেডিকেল অফিসার, সেন্সিটিভ একটা দায়িত্বে। কিন্তু প্রাইভেট প্র্যকটিস নষ্ট করে কেউ যেতে চান না দূরের জেলাগুলিতে। বেশিরভাগ জেলায় একাই যেতে হয়েছে। একটা বুদ্ধি করলাম, সহকর্মীদের মধ্যে যার যে জেলায় বাড়ি, সেখানে সঙ্গী হতে উদ্বুদ্ধ করলাম।

গোপালগঞ্জ সদরে বাড়ি ডাঃ মোল্লা ওবায়দুল্লাহ বাকী ভাইয়ের। কাশিয়ানি উপজেলায় ডাঃ শেখ গোলাম মোস্তফার। দুজনকেই বললাম। মোস্তফা ভাই বললেন, কাশিয়ানি আসলে ফরিদপুর সংলগ্ন, উনি ফরিদপুরে যাবেন। গোপালগঞ্জের প্রোগ্রামে বাকী ভাইকে নিতে। বাকী ভাইয়ের ভাগ্নের বিয়ে ওইদিন খুলনাতে। উনার পোস্টিং তখন খুলনা মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে। যখন খুলনা গিয়েছিলাম, তার আন্তরিক কথা ভুলার মত নয়। ভাগ্নের বিয়ে, তাই আমি বুঝলাম উনার সমস্যা। বললাম, আপনার আসতে হবে না, আমি চালিয়ে নিব।

সিভিল সার্জন সব আয়োজন করলেন। সার্কিট হাউসে থাকা খাওয়া। অনুষ্ঠানে সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো। তিনি বাসস্ট্যান্ড থেকে সোজা তার বাসায় নিয়ে আপ্যায়ন করলেন। সার্কিট হাউসের দিকে যাওয়ার আগে বললেন, রাসকিন ভাই, কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলে আমার গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। আমি বললাম, সকালে টুঙ্গীপাড়া যেতে চাই, ১০টার মধ্যে ফিরে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবো।

ভদ্রলোক চমকে উঠলেন। আমি ড্যবের নেতা ছিলাম, অল্প কিছুদিন হলেও। এখন ক্যান্সার প্রতিরোধ আমার ধ্যানজ্ঞান, কিন্তু ডিগবাজি দিয়ে মতাদর্শ বদলের কোন সম্ভাবনা ইহ জনমে নাই। তিনি বিনয়ের সাথে জানালেন, ওইদিন ছিল জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন। প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ সেলিম অবস্থান করছেন টুঙ্গীপাড়া ডাকবাংলোতে।সিভিল সার্জনের গাড়িতে আমি গেলেও, অনেকে ভাববেন সিভিল সার্জন গিয়েছেন। এতে উনার সমস্যা হতে পারে। আমি বললাম, থাক লাগবে না।

পরদিন ভোরে দরজায় কড়ানাড়ার শব্দে আমার ঘুম ভাঙ্গলো। দরজা খুলে দেখি বাকী ভাই এসেছেন। হাবিবুল্লাহ, আপনি এসেছেন আমাদের জেলায়, তাই না এসে পারলাম না। ভাগ্নের বিয়েতে বিকেলে গিয়ে যোগ দিব। ফজর নামাজ পড়ে মাইক্রোবাস নিয়ে রওনা দিয়েছি। আমি উনার আন্তরিকতায় মুগ্ধ। বললাম, প্রোগাম তো ১০টায়। আমার একটু ইচ্ছে ছিল, টুঙ্গীপাড়া যাওয়ার। উনিও চমকে উঠলেন। আপনার সমস্যা হবে না ?

আপনিতো ড্যাব ঘরানার লোক। আমি বললাম, আমি যাবো একজন জাতীয় নেতার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার জন্য দোয়া করতে। আবার কোন দিন গোপালগঞ্জ আসা হবে কিনা কে জানে? একজন জাতীয় নেতার প্রতি সম্মান জানাতে তার দলীয় সমর্থক হতে হবে, কিংবা এতে নিজের মতাদর্শচ্যূতি ঘটবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমি ছোটবেলা থেকেই এটা শিখে এসেছি বড় একজন জাতীয়তাবাদী ঘরানার নেতার কাছে। তাছাড়া এর কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া টুঙ্গীপাড়া এসে সম্মান জানিয়ে গেছেন।

ভিন্ন মতাদর্শের হলেও জাতীয় নেতাদের প্রতি সম্মান জানানোর সংস্কৃতি যদি আমরা ধরে রাখতে পারতাম, তাহলে এদেশের রাজনীতি আরও বেশি জনকল্যাণমূলক হতে পারতো। এটা হতে হবে দ্বিপাক্ষিক। উপরের স্তর থেকে আসতে হবে শিক্ষনীয় উদাহরণ আর প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা। তাহলে তরুণ ও হাইব্রিডরা প্রতিদ্বন্দ্বী দলের জীবিত ও মরহুম জাতীয় নেতাদের গালিগালাজকেই নিজের উপরে উঠার ‘শিওর সাকসেস’ সিঁড়ি বিবেচনা করবে না।

আমার বন্ধু তালিকায় থাকা বিপুল সংখ্যক সরকারি ও বিরোধী রাজনীতির সমর্থকদের প্রতি অনুরোধ আমার এই বক্তব্যে কেউ অযথা কষ্ট পাবেন না। রাজনীতির প্রতি আমার কোন ধরণের আকর্ষণ নেই। যা বললাম, একান্ত বিশ্বাস থেকে বললাম।’