প্রত্যেক জিনিসের একটা সীমা-চৌহদ্দি থাকে। ব্যক্তি হোক, প্রতিষ্ঠান হোক যে যার সীমা-চৌহদ্দি রক্ষা করে চলবে- এটাই নিয়ম, নৈতিকতা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবি সীমা অতিক্রম করে কথাবার্তা বলতে গিয়ে নানা সময় বিতর্কের সূত্রপাত করে। সাম্প্রতিক সময়ে সংসদ নিয়েও তারা তাই করেছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সত্তার প্রতীক। একটা জাতীয় সত্তার প্রতীককে শালীনতাহীন কথা বলে আক্রমণ করা নিশ্চয়ই গর্হিত কাজ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যেভাবে কথা বলে একটি এনজিও হিসেবে টিআইবি সেভাবে কথা বলার অধিকার রাখে না। অথচ টিআইবি কথা বলছে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মতো করে। তাও অসংযত ভাষায়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষকতার দায়িত্ব নিয়ে এদেশে আসেনি। তার পক্ষে শিক্ষকের মতো আচরণ করতে যাওয়া অশোভন। তারা ওয়াচডগ। তাদের ভূমিকা ওয়াচডগের মতোই হবে। টিআইবিতে যারা কাজ করেন তারা এদেশেরই লোক। কেউ কোনো না কোনো মতাদর্শের অনুসারী হতে পারেন; কিন্তু সংস্থাটির হয়ে যখন তারা রিপোর্ট তৈরি করেন তখন তা হতে হবে নিরপেক্ষ, নিখুঁত এবং বাস্তবতার সঙ্গে সাম্য রক্ষা করে।
ভারতের লোকসভার গত অধিবেশনে বিরোধীদের হট্টগোলের মধ্যে সরকারি দল কোনো বিলই পাশ করাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত স্পিকার লোকসভার অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেন। এতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর ভারত শাখা কখনো ভারতের লোকসভাকে বিদ্রুপ করে কথা বলেনি এবং আগামীতেও বলতে সাহস পাবে না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের নিজস্ব চোখ আছে, বুদ্ধি আছে, বিবেচনাবোধ আছে। তিনি তা প্রয়োগ করে কোনো বিষয়ে কথা বলবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন দেখছি তার কথা আর বিরোধী বিএনপি-জামায়াত এর কথায় কোনো বিরোধ দেখা যাচ্ছে না। তাই বলতে হচ্ছে- ভাড়া করা বিবেক বুদ্ধি, বিবেচনা দিয়েতো চলবে না।
টিআইবি গত ২৫ অক্টোবর তার প্রতিবেদনে বর্তমান সংসদ একটি ‘পুতুল নাচের নাট্যশালা’ বলে মন্তব্য করেছে। সংস্থাটির মতে, দশম সংসদ ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র অধীনে চলছে এবং সেখানে বিরোধীদলের ভূমিকা লেজুড়ভিত্তিক। তাই বিতর্কের উর্ধ্বে থেকে একটি কার্যকর সংসদের জন্য আরেকটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দরকার বলে মনে করে সংস্থাটি। দশম সংসদের দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ অধিবেশন পর্যবেক্ষণ করে পার্লামন্টে ওয়াচ প্রতিবেদন তৈরি করেছে টিআইবি। সংস্থাটির মতে, বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে দশম সংসদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এমনকি জনগণের আস্থা অর্জনে কোনো চেষ্টাও ছিল না এই সংসদের, যা হতাশাজনক বলে মনে করে টিআইবি।
ইফতেখারুজ্জামান শুধু টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক নন, তিনি এদেশেরও নাগরিক। টিআইবি বাংলোদেশের দুর্নীতি এবং সুশাসন নিয়ে কাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। আমরা জানি, তারা বাংলাদেশকে যত সমস্যা সঙ্কুল দেখাতে পারেন এনজিও হিসেবে তত বেশি প্রজেক্ট নিতে পারেন এবং বিদেশী সাহায্যও আসে তাতে। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশকে বিশ্বে হেয় প্রতিপন্ন করার কোনো অধিকার তারা রাখেন না। জাতীয় সংসদ আর দশটি প্রতিষ্ঠান নয় যে- যা ইচ্ছে এর সম্পর্কে বলা যাবে। তারা পরামর্শ দিতে পারেন, কিন্তু রাজনৈতিক দলের মতো আচরণ করতে পারেন না।
দশম সংসদের নির্বাচন যে একটি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে এই নির্বাচন অনুষ্ঠান যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিলো- সবাই আমরা জানি। এই নির্বাচনে ভোট গ্রহণ সুষ্ঠু হয়নি এটাও সবার জানা কথা। কিন্তু টিআইবি যখন শুধু এটার দিকে ইঙ্গিত করে সংসদের মর্যাদাহানির চেষ্টা করে তখন তাদের প্রতিও প্রশ্ন থাকে যে- ওই নির্বাচন প্রতিরোধে বিরোধীদল ২০১৩ সালের শেষ চারমাস দেশজুড়ে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে টিআইবি কি তা বিবেচনায় আনবে না!
দেড়শ নির্বাচনী কেন্দ্র জ্বালিয়ে দিলে, প্রিসাইডিং অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যা করলে, ৩১৯ জন লোককে পুড়িয়ে মারলে, তিন শতাধিক লোককে অগ্নিদদ্ধ করলে, ভোটার না আসার জন্য পথে পথে বোমাবাজি করলে- সে নির্বাচনে ব্যাপক ভোটারের উপস্থিতি কিভাবে সম্ভব! টিআইবি কি একবারও এটা নিয়ে কোনো গবেষণার ফল প্রকাশ করেছে? একবারও তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে?
টিআইবি তার প্রতিবেদনে বলেছে, জনগণের আস্থা অর্জনে কোনো চেষ্টাও ছিল না এই সংসদের। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে সংসদ আস্থাহীনতায় নেই। নির্বাচন এবং পরবর্তী সময়ে বিরোধীদলের কার্যক্রমের কারণে জনসাধারণ নির্বাচনও মেনে নিয়েছে, সংসদও মেনে নিয়েছে এবং সরকারও মেনে নিয়েছে। এমনকি বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটও তাদের দাবি দাওয়া পেশ করছে এই সরকারের কাছে। বিরোধীদল এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি অব্যাহত রেখেছে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যদি বিরোধীদলের দাবি অনুসারে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে হয় তাহলেতো এই ‘পুতুল নাচের সংসদকেই’ করতে হবে। সুতরাং প্রক্রিয়ার সমালোচনা করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানকে হেয় এবং ধ্বংস করার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)