চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

টাঙ্গুয়ার হাওরের হৃদয় মাঝি

‘আমার নৌকায় আসেন, আমি ভালা কইরা ঘুরাইয়া আনমু। গানও শুনামু।’ সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ওয়াচ টাওয়ার ঘিরে ডিঙি নৌকা নিয়ে অপেক্ষায় থাকা ক্ষুদে মাঝিরা পর্যটকদের এভাবে ডাকতে থাকে। ১০/১২ বছর বয়সী এই শিশুদের একজন হৃদয়। পুরো নাম হৃদয় আহমেদ মোবিন। তার বাবার নাম মো. হিরু মিয়া, মা নূরজাহান। হৃদয়রা পাঁচ ভাই বোন; তিন ভাই আর দুই বোন। সে তৃতীয়। হৃদয়ের নৌকায় টাঙ্গুয়ার হাওরের জলাবনে হিজল-করচ গাছের ফাঁকে ঘুরতে ঘুরতে এইসব কথাবার্তা হলো:

– তোমাদের গ্রামের নাম কী?
– আমাদের গ্রামটা এখন এই পানির নিচে। গ্রামের নাম জয়পুর। থানা তাহিরপুর, জেলা- সুনামগঞ্জ।
– তোমার বাবা কী করেন?
– আমার বাবা অসুস্থ। আগে গ্রাম পুলিশের চাকরি করতেন।
– ভাইবোনদের মধ্যে কে বড়?
– আমার বোন বড়। বড় বোনের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।
– অন্য ভাই বোন?
– অন্য ভাই-বোন আছে এক রকম।
– তারা তোমার বড় না ছোট?
– আমার বড় আছে একজন। বোন। আর ছোট দুই ভাই।
– বোন কী করে?
– সেই বোন বিয়ার যোগ্য হইসে। এখন ঘরেই।
– পড়ালেখা করেছে?
– জ্বী, ক্লাস সেভেন পর্যন্ত।
– তুমি কোন পর্যন্ত পড়েছ?
– ক্লাস ফোর।
– আর পড়নাই কেন?
– আমি তো আর সেই রকম সুযোগ পাই নাই। মা-বাবা অসুস্থ। এখন ঘরের সব চাপ আইসা পড়সে আমার উপরে।
– তোমাদের ঘরবাড়ি?
– আমাদের ঘর পানিতে ডুইব্যা গেছে। মানে ঘরের ভিতরে পানি ঢুইক্যা পড়ছে। পালঙ্কের (খাট) উপরে সবাই কোনোমতে থাকি।
– তোমাদের কৃষি জমি আছে?
– না। একটা আসিলো। সেইটা নিয়া অনেক ঝগড়া হইসে। পরে দিয়া দিসি।
– তোমাদের এলাকায় কোনো সমস্যা আছে?
– আছে… ধরেন, আমি দশ হাজার টাকার মাছ ধরার জাল ফেললাম। সেইটা দিয়া আমার ২/৩ হাজার টাকা লাভ হইলো। ধরেন, সেইটা আপনে দেইখ্যা ফেললেন। পরে যখন আবার জালটা আমি পাতবো, সেইটা আর থাকবো না। কেউ উঠাইয়া নিয়া যায়। তখন তো আমার পুঁজি শেষ। আমি তখন কী করি?
– কী হলে ভালো হতো?
– একজনকে আরেকজন যদি উদ্ধার করতো। ধরেন, কেউ একজন বিপদে পড়সে। ধরেন আমার নৌকাটা অর্ধেক ডুইব্যা গেছে। কেউ দূরে থেইক্যা দেখসে। সে আইসা যদি উদ্ধার করত, এইটা অনেক ভালো হইতো। আসলে… একজন যদি আরেকজনের বিপদে সাহায্য করতো আর কি…
– এখন মানুষ কেমন করে?
– কেউ কাউরে বিপদে পড়তে দেইখা যত দূরে দিয়া যাইতে পারে। ততোই যেন তার ভালো!
– তোমাদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা কী করে?
– তারা আছে তো… তাদের ব্যস্ততা নিয়া তারা আছে। আমাদের পর্যটন পুলিশ একবার একটা কার্ড দিসিলো। সেইটা দিয়া আমার মা ১০ হাজার টাকা পাইসিলো। সেই টাকা দিয়া ছোটো একটা ঘর বানানো হইসিলো।
– সেইটা কবে কীভাবে হইসিলো?
– ওইতো, একবার এরকমই পানি হইসিলো। তখন একজন সাংবাদিক আইসা ছবিটবি তুলসিলো। পরে সেই যোগাযোগেই একটা ফয়সালা কইরা দিসিলো।
– তোমার ছোট ভাইবোন পড়াশোনা করে?
– আমার ছোট দুইটা ভাই। আমি সারাদিন নৌকা চালাই। ভোরে আসি। সারাদিন নৌকা চালাই। আসরের ওয়াক্তে যাই। তারা আমার এই টাকা দিয়াই পড়ে।
– তারা কোন ক্লাসে পড়ে?
– একজন ক্লাস ফোর। একজন ক্লাস ফাইভে।
– এখানে তোমার আয় কেমন হয়?
– এখন কম। সারাদিন ২/৪টা ট্রিপ দিতে পারলে ৭/৮শ’ টাকা হয়।
– আর শুকনো মৌসুমে?
– শুকনা মৌসুমে ট্যুরিস্ট নিয়া হাঁটাহাঁটি করি। প্রকৃতি দেখাই। তারা খুশি হইয়া ২/৪শ’ যা পারে দিয়া যায়। তারা আমার সংসারের উন্নতি কইরা দিয়া যায়।
– কোন সিজনে আয় বেশি হয়?
– পানির সিজনে আয় বেশি হয়। কিন্তু ক্ষতি বেশি। ধরেন, বাড়ি ডুবে। আবার বান্ধা লাগে। কষ্ট কইরা থাকা লাগে। আর হেমন্ত কালে আমার যদি ২শ’ টাকা হয় সেইটা দিয়া চাল-ডাল কিইন্যা খাওয়া যায় এক রকম। আর এখন যদি ৫শ’ টাকাও হয়, বেশিটাই বাড়ির নিচে দেওয়া লাগে।– বড় হলে তুমি কী হতে চাও?
– আমি চাই বাবা-মা’কে নিয়া সুন্দর মতন চলতে। আমার এলাকায় তো বেশি কিছু করার নাই। এই রকমই জীবন। যে রকম যায়…
– তোমার কোনো ভালো স্বপ্ন আছে?
– গত বছর এখানে একটা তিনতলা লঞ্চ আইসা থামতো। অনেক পর্যটক নামতো। তাদের সাথে একজন সাংবাদিক আসছিলো। আমাদের বাড়িতে গেসিলো। আমাদের ঘর ডুইবা গেসে দেইখ্যা তার মনে অনেক মায়া লাগসিলো। পরে ২ হাজার টাকা দিসিলো। সেইটা দিয়া অনেকদিন চলসি। সেই সময় আরও অনেক ট্যুরিস্ট আসতো। ইনকাম ভালো হইতো। এখন একটু কম।
– ট্যুরিস্টরা কী বেশি পছন্দ করে?
– আমাকে অনেক ট্যুরিস্ট চিনে। আমি ৩/৪ বছর ধরে পর্যটকদের নিয়া ঘুরি। আমার কারো সাথে কোনো মনমালিন্য হয় নাই।
– তুমি যে গান গাও, সেটা কোথায় শিখেছ?
– না। নিজে নিজেই। একজনেরটা শুইন্যা শুইন্যা। কোথায় শিখব?