গত ৩ সেপ্টেম্বর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের বার্তা প্রধান মোস্তফা ফিরোজ ‘হায়রে কি টকশো দেখছি এক টিভিতে!’—এরকম একটি স্ট্যাটাস দেন তার ফেসবুক ওয়ালে, সেখানে টকশো নিয়ে নানাজন তীর্যক মন্তব্য করেন। মোস্তফা ফিরোজ নিজেও একজন টকশোর সঞ্চালক এবং বিভিন্ন টিভিতে টকশোতে আলোচক হিসেবে যান।
টেলিভিশনে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলোর মধ্য টকশো শীর্ষে। আবার এই টকশো নিয়েই মানুষের সমালোচনাও বেশি। রাত জেগে মানুষ টকশো দেখে। শুধু শহুরে মানুষ নয়, এখন গ্রামের হাটবাজারের চায়ের দোকানে বসেও মানুষ টিভিতে টকশো দেখে। সমকালীন নানা বিষয়ে নিজেদের ভাবনা পরস্পরের সাথে বিনিময় করে। এসব চায়ের দোকানে যে পরিমাণ রাজনীতির আলোচনা হয়, সেগুলো ভিডিও করে প্রচার করলেও বেশ দারুণ টকশো হতে পারে। কোনো কোনো টেলিভিশন অবশ্য চায়ের দোকানের এই আড্ডা নিয়েই অনুষ্ঠান করছে।
বলা হয়, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে বা রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক আবহ শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে টেলিভিশনের টকশোগুলো বড় ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে যখন রাজপথে, সংসদে বা অন্য কোথাও বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়—তখন টেলিভিশনের টকশোতে এসে দলের নেতারা সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। ফলে অনেক সময় টেলিভিশনের এই টকশোকে ‘বিকল্প পার্লামেন্ট’ বলেও অভিহিত করা হয়। আর এ কারণে কোন কোন টকশো, টকশোর আলোচক এবং উপস্থাপক ক্ষমতাসীনদের বিরাগভাজনও হয়ে থাকেন।
তবে বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক দল হিসেবে ছোট, গুরুত্বহীন এবং জনপ্রিয়তা নেই—এমন অনেক দলের নেতারাও কেবল এই টকশোর কারণে জনগণের কাছে পরিচিত এবং সেলিব্রিটিতে পরিণত হন। শুধু রাজনীতি নয়, অনেক শিক্ষক, সাংবাদিক, এনজিওকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও ব্যবসায়ীকে মানুষ টিভি ব্যক্তিত্ব হিসেবে চেনে শুধু এই টকশোর কারণে। শোনা যায়, এদের অনেকে মূল পেশায় মাসে যা আয় করেন, তার চেয়ে বেশি আয় করেন টেলিভিশনের টকশোতে এসে। কারণ প্রতিটি টেলিভিশন একটি টকশোতে অংশ নিলে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা সম্মানী দেয়া হয়। কোন কোন আলোচককে মাসের ৩০ দিনই কোন না কোন টিভিতে দেখা যায়। কেউ কেউ একদিনে একাধিক টিভিতেও যান। একটি টেলিভিশন শেষ করে আরেকটি টিভিতে যেতে যেতে সেই টিভির অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়—এরকম ঘটনাও মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে।
এর একটি কারণ বিশ্লেষণ (যোগাযোগ, সংখ্যা ১২, জুলাই ২০১৬, পৃষ্ঠা ২৩১) করেছেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসির সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু। তার মতে, ‘২৪-২৫টি টেলিভিশনে যদি প্রতিদিন গড়ে ৩০টি টকশো অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে প্রতিদিন অন্তত একশোজন অতিথির দরকার পড়ে। এই বাড়তি চাহিদার কারণে অনেক আলোচক ঘুরেফিরে বিভিন্ন টকশোতে আবির্ভূত হতে দেখা যায়। এই নিয়মিত আলোচকদের বেশির ভাগই সাংবাদিক, পত্রিকার সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আইনজীবী। তাদের অনেকেই আলোচ্য বিষয়ে কোনোরকম হোমওয়ার্ক করে আসেন না। গুরুতর বিষয়ে বাজারচলতি মন্তব্য করে বসেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুমাননির্ভর তথ্য উপস্থাপন করেন।’
এই নিবন্ধে মি. আহসান আরও লিখেছেন, ‘অধিকাংশ উপস্থাপকই আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন না। ফলে তারা কোনো চৌকষ প্রশ্ন করে আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঞ্চালকের প্রশ্ন হয় খুবই বোকা বোকা ধরনের। অনেক সময় সংবাদ পাঠক-পাঠিকাকে বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে উপস্থাপনায় বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিক আত্মবিশ্বাসী সঞ্চালক নিজেকে জাহির করার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন। সঞ্চালকদের জ্ঞানের বহর নিয়ে মাঝে মধ্যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়।’
অনেক সময় ভালো জানাশোনা লোক টকশোতে আসতে আগ্রহবোধ করেন না। অনেকে জানেন ভালো কিন্তু টিভি ক্যামেরার সামনে স্বস্তিবোধ করেন না। কেউ কেউ টকশোর আমন্ত্রণ পেলে জিজ্ঞেস করেন আর কে থাকবেন? অর্থাৎ সহআলোচক পছন্দ না হলে তিনি আসতে আগ্রহবোধ করেন না। এটা অনেকের ইগো সমস্যা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য অধ্যাপককে একদিন সমসাময়িক বিষয়ে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন আর কে থাকবেন? তার নাম ও অবস্থান জানার পরে ওই অধ্যাপক খুবই রুঢ় আচরণ করেন এবং বলেন, তুমি আমার স্ট্যাটাস সম্পর্কে জান না? অথচ ওই অধ্যাপকের সাথে সহআলোচনা হিসেবে আমি যার নাম বলেছিলাম, জ্ঞান-গরিমায় তিনি অধ্যাপকের চেয়ে কম নন।
বস্তুত যেসব মুখ আমরা প্রতি রাতে টিভির পর্দায় দেখি—তাদের সবাই যে নিজের যোগ্যতায় বা টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ খুব সম্মানের সাথে তাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে এমনটি ভাবার কারণ নেই। বরং এই অতিথিদের অনেকে বিশেষ জায়গার অনুরোধ/নির্দেশ/পরামর্শে আসেন বা তাদের আনতে হয়। এ নিয়ে টিভি কর্তৃপক্ষ খুব বেশি বাহাসে যেতে চায় না। কারণ যারা নির্দেশ/পরামর্শ বা অনুরোধ করেন, তাদের কাছে কোনো না কোনোভাবে টেলিভিশনের মালিকপক্ষ কিংবা নীতিনির্ধারকদের দায় আছে।
২.
আমাদের দেশে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হওয়া এবং এ কারণে রাজনীতি বিষয়ক আলোচনায় অতিথির কোনো অভাব হয় না। যিনি যে পেশাই থাকুন না কেন তিনি টকশোতে এসে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দিয়ে থাকেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটির অভাব তা হলো, কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে অ্যাকাডেমিক আলোচনার লোক। এক্ষেত্রে ভরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং এখানেও ঘুরেফিরে কয়েকজন পরিচিত মুখ। একই বিষয়ে কথা বলার মতো শিক্ষক নিশ্চয়ই আরও আছেন। কিন্তু নতুন আলোচকদের আমন্ত্রণ করে টিভি কর্তৃপক্ষ ঝুঁকি নিতে চায় না। কারণ তিনি লাইভে কেমন বলবেন, কী বলবেন, তাতে প্রতিষ্ঠান কোন বিপদে পড়বে কি না—এসব চিন্তার কারণে কর্তৃপক্ষ ‘পরীক্ষিত’ অর্থাৎ যারা নিয়মিত টকশোতে আসেন, তাদেরকেই আমন্ত্রণ জানায়। ফলে নতুন আলোচকের জায়গা হয় না। অথচ দিনের পর দিন বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে পরিচিতদের চেয়ে অনেক অপরিচিত আলোচকও খুব ভালো কথা বলেন—এরকম উদাহরণও আছে। কিন্তু তারপরও অধিকাংশ টেলিভিশন একই মুখ নিয়ে স্বস্তিবোধ করে।
যেমন সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা মানেই বুয়েটের এক দুজন অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত কয়েকজন শিক্ষক, পরিবেশ-জলবায়ু পরিবর্তন-নদী নিয়ে কথা বলতে হাতেগোনা দুই তিনজন। অতিথি নির্বাচনের এই দীনতা দেখে এমন প্রশ্ন ওঠাও অস্বাভাবিক নয় যে, ১৬ কোটি মানুষের দেশে টকশোতে কথা বলার লোকের এতই আকাল?
একই আলোচককে বারবার টকশোতে আমন্ত্রণ জানিয়ে টেলিভিশনগুলো একটি নিজস্ব বা ‘ঘরোয়া বুদ্ধিজীবী’ শ্রেণি গড়ে তোলে—যারা তাদের ভাবনাগুলো কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বিশেষ কারো পারপাস সার্ভ করার জন্য পরিবেশন করে থাকেন। তাতে জনমত কতটুকু গঠিত হয় বা দর্শকের মানসকাঠামোয় কতুটুক পরিবর্তন আসে—তা সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও এর দ্বারা একধরনের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রসারিত হয়। তবে যখন রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ক্রমক্ষয়িষ্ণু—তখন অন্তত টেলিভিশনের এই টকশোগুলো কিছু ভিন্নমত বা অলটারনেটিভ থিংকিংয়ের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। এর দ্বারা আমাদের গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করছে তারও কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
৩.
রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনার একটা সাধারণ প্রবণতা হলো, দুজন অতিথি থাকলে সেখানে ধরেই নেয়া হয় এদের মধ্যে একজন আওয়ামী লীগ, একজন বিএনপি। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ যখন অতিথি নির্বাচন করে তারাও সেখানে এই আওয়ামী লীগ-বিএনপিপন্থি বিষয়টি বিবেচনায় রাখে। কিন্তু সব আলোচকই যে এ দুই দলের অনুসারী বা এ দুই দলের পক্ষে-বিপক্ষে বলবেন, এমনটা নাও হতে পারে।
আবার কোন কোন উপস্থাপক তাদের অনুষ্ঠানে আলোচকদের ওপর এতটাই নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব বিস্তার করে রাখেন যে, তাতে অনেক সময় দর্শক বিভ্রান্ত হয় যে, আসলে কে আলোচক এবং কে সঞ্চালক? কোন কোন উপস্থাপক আলোচনায় কোন বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করবেন তা আগেই ঠিক করে রাখেন। ফলে আলোচকরা যাই বলুন না কেন তিনি গল্পের গরু গাছে তুলতে প্রাণপণ সচেষ্ট থাকেন।
কোন কোন টেলিভিশন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যে পরিচালিত হয় এবং তাদের বিরুদ্ধমতের কেনো বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করলে সেখানে ওই বিরুদ্ধমতের কথিত অনুসারী আলোচকদের যে ভাষায় এবং যে ভঙ্গিতে প্রশ্ন করা হয়, তাতে প্রশ্ন ছাপিয়ে সেটি একধরনের ‘জেরা’য় পরিণত হয়। তখন এটি টেলিভিশনের সেট নাকি আদালতের কাঠগড়া, তা ঠিক বোঝা যায় না। আবার এসব অনুষ্ঠান এবং ওই উপস্থাপকগণ বেশ জনপ্রিয়ও বটে। কারণ মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় ঝগড়াঝাটি দেখতে পছন্দ করে। শান্তশিষ্ট ভঙ্গিতে সিরিয়াস বিষয়ে একাডেমিক আলোচনার টিআরপি বা দর্শকপ্রিয়তার চেয়ে ঝগড়াঝাটিসম্বলিত টকশোর টিআরপি বেশি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)