চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড জয়ী ফ্ল্যাগ গার্ল প্রিয়তা ইফতেখার

গল্পটি অচলায়তন ভাঙার। অবরোধবাসিনী অসূর্য্যস্পর্শা ঘুমিয়ে থাকা নারীদের জেগে উঠে সারা বিশ্বকে আলোকিত করার যে বাঙালি ধারার সূচনা হয়েছিল বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল আর নূরজাহান বেগমদের হাতে- প্রিয়তা ইফতেখারের গল্প তারই ধারাবাহিকতার আধুনিক সংষ্করণ মাত্র। কে এই প্রিয়তা ইফতেখার, কি করেছেন তিনি?

বৃটিশ ভারতের বিখ্যাত পত্রিকা সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দীনের রক্ত প্রিয়তার ধমণীতে। এই দেশে নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত নূরজাহান বেগম প্রিয়তার নানি।

আর নানা কচি কাঁচা মেলার প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। নূরজাহান বেগমের নাতনি, তিনি ভাঙবেন অচলায়তন এটাই তো স্বাভাবিক।

দেশ জাতীর সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক আইকন হওয়ার পথে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছেন তরুণ নারী প্রিয়তা। দেশে বিদেশে তিনি বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ গার্ল বা পতাকা বালিকা।

ট্রাভেলিং, ভিডিও ব্লগিং আর ফিল্ম মেকিংয়ে এর নেশা তার রক্তে। সম্প্রতি বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত পুরষ্কার জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড তিনি গ্রহণ করেছেন জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নাতি সজিব ওয়াজেদ জয় এর হাত থেকে।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবেও প্রিয়তা কাজ করছেন। সারা বিশ্বে নিজে ভ্রমণের পাশাপাশি বাংলাদেশের মেয়েরা যাতে এ সুযোগ পায় এ জন্যও কাজ করে চলেছেন।

একা তিনি অসংখ্য দেশে ভ্রমণ করে তুলে ধরেন বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা। কোন কোন দেশ বেশি ভালো লেগে গেলে সেখানে ছুটে যান বারবার। কেউ বা কোন বাধাই তার সামনে দাড়াতে পারে না।

সব প্রতিকূলতাকে জয় করে ছুটে চলেন প্রিয়তা। নিজের ভ্রমণকে স্বাচ্ছন্দে করতে সারা বিশ্বে গড়ে তুলেছেন ফ্রেন্ড নেটওয়ার্ক। এই বন্ধুরাও যেসব দেশে ভ্রমণ করেন তারাও সে সব দেশে তুলে ধরেন বাংলাদেশের পতাকা।

তার দেখানো পথে এখন অন্যরাও নানা দেশে তাদের নিজেদের পতাকা তুলে ধরা শুরু করেছে। প্রিয়তাকে দেখে অনুপ্রাণিত অনেকেই। দেশি বিদেশি নারীদের নিয়ে কাজ করতে প্রিয়তা গড়ে তুলেছেন ফ্ল্যাগ গার্ল নামের একটি সংগঠন।

প্রায় দুই শতাধিক দেশি বিদেশি নারী পুরুষ এখন তার সংগঠনের সদস্য। এই সংগঠনের কাজ দেশে বিদেশে ভ্রমণ পিয়াসি বন্ধু তৈরি করা।

প্রিয়তা মনে করেন, সারা বিশ্বে মেয়েদের ভ্রমণে প্রথমে বাধা আসে তার নিজের পরিবার থেকেই। পরিবারের মানুষেরা ভাবেন, মেয়েরা বিদেশে একা একা যেতে পারে না। আমেরিকাতে যাওয়ার প্রথম ভিসা পাওয়ার পরে প্রিয়তার পরিবারের সবাই তাকে একা যেতে বাধা দেয়। এই বাধা থেকেই ফ্ল্যাগ গার্ল সংগঠনের চিন্তা প্রথম তার মাথায় আসে।

এরপরে ২০০৮ সালে তিনি এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন নারীদের ভ্রমণে সহযোগিতা করতে। এই সংগঠন থেকে সহযোগিতা হিসেবে বিদেশি কোন বন্ধু বাংলাদেশে বেড়াতে এলে তারা থাকেন প্রিয়তার বনানীর বাসায়। অতিথিদের থাকার কোন খরচ নেন না তিনি। আর এতে করে থাকার খরচ বেঁচে যাওয়ার তাদের ভ্রমণ খরচ অনেক কমে যায়। এই রকমভাবে প্রিয়তা যখন তাদের দেশে যান তখন সেখানে তিনি ফ্রিতে ওই বন্ধুদের বাড়িতে ওঠেন।

সম্প্রতি প্রিয়তা যান রাজশাহী। এই সফরে তার সাথে সঙ্গী হন ফ্ল্যাগ গার্ল নেটওয়ার্কের ১০ জনের বেশি নারী সদস্য। সবাইকে নিয়ে সেখানে নানা তথ্যচিত্র তৈরি করেন। ভ্রমণ প্রেমীরা কেন রাজশাহী বেড়াতে যাবেন তাই ছিল তথ্যচিত্রের মূল উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে তিনি এই কাজে নামেন। তাকে সহযোগিতা করেন রাজশাহীর একজন স্থানীয় ব্যক্তি। এভাবেই একে একে সারা বাংলাদেশে যাবেন তিনি।

পর্যটকদের সামনে তুলে ধরবেন ৬৪ জেলা। সকল জেলার ইতিহাস ঐতিহ্য আর আকর্ষণীয় স্থান নিয়ে ইংরেজিতে তথ্যচিত্র তৈরি করে তা ছড়িয়ে দেবেন ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

যা দেখে বিশ্বের যে কোন প্রান্তের মানুষ সহজেই বাংলাদেশে ঘুরতে আসবে। ভ্রমণটা যে একার বিষয় নয় বরং তা পরিবারের সবাইকে নিয়ে এমন কি বাড়ির কাজের মানুষকেও সাথে নিয়ে গিয়ে সকলে মিলে উপভোগ করার বিষয়- এই ধারণাকে জনপ্রিয় করতে কাজ করছেন প্রিয়তা। এই বছর নিজের মাকে হারান তিনি।

তার পরিব্রাজক হয়ে ওঠার নেপথ্যে কাজ করেছেন প্রিয় মা। শুরুর দিকে তাকে ভ্রমনে বাধা দিতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তার ভ্রমণ প্রিয় জীবনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তার মা। দেশে ও বিদেশে বেশ কিছু স্থানে মাকে সাথে করে নিয়ে যাওয়ায় তিনি পরে বুঝতে পারেন মেয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং ভ্রমণের গুরুত্ব।

মা ও মেয়ের একসাথে স্কুবা ডাইভিং, পানির স্রোতের মধ্যে রাফটিং আজও দাগ কেটে আছে মনে। মেয়ের সাথে ভ্রমণে গিয়ে তার বাবার সাথে কাটানো নানা স্মৃতি মাকে আপ্লুত করতো। মায়ের সেই সব অনুভূতি দেখে শিহরিত হতেন প্রিয়তা। এই দেশের যে কোন মেয়ে ও নারীর ভ্রমণে সবার আগে বাধা আসে নিজের বাবা মা বা ভাই বোনের থেকে।

আর অবিবাহিত সময়ে এই বাধা পেরিয়ে পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, ষ্পর্শ ও শব্দ সম্ভোগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘরের বাইরে যেতে পারেন না কোন নারীই। এই খানেই ব্যতিক্রম প্রিয়তা ইফতেখার।

বাঙালি অবিবাহিত নারীর শত বছরের প্রথাগত অচলায়তন ভেঙে বিশ্বপানে ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি। এই কারণেই আইকনিক প্রিয়তা। আর তাই এই সময়ের অগ্রগামী নারী হিসেবে এ বছর জিতে নিলেন জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০১৮।ভিসা পাওয়ার জটিলতা, ভ্রমণ খরচ আর একা ভ্রমণের জটিলতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে নিজের পরিকল্পনায় সব প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলেছেন। আর এ জন্যে দরকার হয়েছে নিজের নেটওয়ার্ক ও বন্ধু তৈরির আইডিয়া। বাংলাদেশের নারীরা গান, আবৃত্তি, নাচ, উপস্থাপনা ও রান্নাবান্নাসহ নানা কাজে পারদর্শী।

বাঙালি মেয়েদের এই সব নানা গুণ ভ্রমণকে আরও বেশি অর্থবহ করতে পারে। বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা হৃদয়ে ধারণ করে তা সারাবিশ্বে তুলে ধরতে চান প্রিয়তা।

এছাড়া তিনি সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করে ট্যুরিষ্টদের এই দেশে আসার জন্য তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে চান বাংলাদেশে আসার জন্য। যাতে করে জেগে উঠতে পারে এই দেশের স্থানীয় পর্যটন।

আর এর সাথে দেশের পিছিয়ে পড়া মেয়ে ও নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজে লাগাতে পারলে নারীদের কর্ম সংস্থানের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করা সম্ভব।

জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড তাকে তার স্বপ্ন পূরণের পথে আরো একধাপ এগিয়ে দিল। তার দায়িত্ব আরো বেড়ে গেলো এমনটাই মনে করেন প্রিয়তা।