বেশ লম্বা সময় ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে না। বরং দাম কমে এক বছর আগে যেখানে ব্যারেল প্রতি ছিলো ১০৩ ডলার, সেখানে চলতি সপ্তাহে তা অর্ধেকেরও বেশি কমে ৪২ ডলারে নেমে এসেছে। ২০০৯ সালের পর জ্বালানি তেলের দাম কখনও এতো কমেনি।
খুব শিগগির আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ার সম্ভাবনা নেই বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। তাই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত জ্বালানি তেলের দামে সমন্বয় আনার কথা বলার পর জ্বালানি এবং জ্বালানি অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশে তেলের দাম অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সর্বশেষ সমন্বয় করা হয়েছিলো ২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারি। তখন থেকে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি মুনাফা করেছে বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)।
কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড বা অপরিশোধিত তেলের দাম ৪২ থেকে ৪৯ মার্কিন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে জানিয়ে এনার্জি এন্ড পাওয়ার ম্যাগাজিনের সম্পাদক মোল্লাহ আমজাদ হোসেন বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজার বিবেচনা করে দেশের বাজারে তেলের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক বছর ধরে তেলের দাম কম রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তেলের দাম কমছে না প্রায় দেড় বছর। শেষ কমেছিলো যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ছিলো ১০০ মার্কিন ডলার। এর মাঝে অবশ্য জেট ফুয়েলের দাম একবার কমেছে। তবে সেটা তো সবার ব্যবহারের জিনিস না।
গত ২৩ আগস্ট আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ’র বিদায়ী নির্বাহী পরিচালক রাকেশ মোহনের সঙ্গে বৈঠক শেষে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ইঙ্গিত দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম নিয়ে বৈঠকে বসবেন বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে মোল্লাহ আমজাদ হোসেন বলেন, অর্থমন্ত্রী এ ধরণের কথা আগেও বলেছেন। তেলের দামের কারণে আমরা আগেও অনেক লোকসান করেছি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে পরিবহন ভাড়া বাড়ে। কিন্তু তেলের দাম কমলে ভাড়া আর কমে না। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নীতিমালা হওয়া দরকার।
জ্বালানি খাতে দেশের একমাত্র পত্রিকাটির সম্পাদকের মতে, তেলের দাম আসলেই কমানোর জন্য জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আর যদি দাম না কমানো হয়, তবে কেনো কমানো হচ্ছে না, তা জনগণকে স্পষ্টভাবে জানানো উচিত।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ জানান, বাজারে জ্বালানির খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়। গ্যাস ও অপরিশোধিত তেলের দাম মূলত: ঠিক করে বিইআরসি। তেলের দাম নির্ধারণের আগে অর্থমন্ত্রী বিইআরসি’র সঙ্গে আলোচনা করে নেন।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের আগে শুনানীর প্রয়োজন হয়। কিন্তু তেলের দাম নির্ধারণ হয় তাৎক্ষণিকভাবে, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে। সুতরাং সরকার চাইলে যখন প্রয়োজন তখনই তেলের দাম কমাতে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে জ্বালানি তেল আমদানি হয় সরকারিভাবে। যখন তেলের দাম বেশি ছিলো, তখন সরকারকে দামের ওপর ভর্তুকি দিতে হতো। এখন আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারে দাম না কমায় লাভ করছে বিপিসি। অর্থাৎ এতে সরকার লাভবান হচ্ছে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে সরকার তার সঙ্গে সমন্বয় করে দেশে তেলের দাম বাড়ায়। কিন্তু দাম কমলে আর তা সমন্বয় করে না। বলা হয়, কয়েকদিন পর দাম বাড়লে আবার দাম পাল্টাতে হবে; তাই বারবার সমন্বয় করা হয় না।
‘কিন্তু এখন তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে পড়তির দিকে। সাম্প্রতিক সময়ে দামে খুব বেশি হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই সরকারের এখন উচিত আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে দেশে তেলের দাম কমিয়ে আনা। ভোক্তা এবং বাজার, উভয়ই এটা চায়। এক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে যুক্তি রয়েছে,’ বলে মনে করেন তিনি।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎকে আলাদাভাবে হিসাব করে দাম নির্ধারণ করা হয়। এই তিনটিকে মিলিয়ে দাম ঠিক করার ব্যবস্থা করা হলে কোনো একটির দাম যেমন খুব বেশি বাড়বে না, তেমনি খুব বেশি কমবেও না। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ জ্বালানি হিসেবে যে তেল বেশি ব্যবহার করে সেগুলোকে আগে বিবেচনা করে দামের সমন্বয় করতে হবে। সেখানে কম আয়ের মানুষের জন্য সুযোগ রাখতে হবে।
তিনি বলেন, বিপিসি এতোদিন অনেক লাভ করেছে, আগের লোকসান কাটিয়ে উঠেছে। এখন চাইলে সরকার তেলের দাম কমাতেই পারে। এতে রাজস্ব কিছুটা কমবে ঠিকই। কিন্তু তাতে ভোক্তা লাভবান হবেন; উৎপাদকেরও খরচ কম হবে। এর ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে, দাম আরো কমার সুযোগ থাকবে। ফলে রাজস্ব কমলেও সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি লাভবান হবে।