আবু বকর আল-বাগদাদী নামটার সঙ্গে বিশ্বের পরিচয় খুব অল্পদিনের হলেও মাত্র দু’বছরের ব্যবধানের হালকা পাতলা গড়নের এই মানুষটি ঘুম হারাম করেছেন বিশ্বের সব হেভিওয়েট নেতাদের।
১৯৭১ সালে বাগদাদের সামারায় জন্ম গ্রহণ করা বাগদাদী ইসলামিক ইউনিভার্সিটি বাগদাদ থেকে ইসলামী সংস্কৃতি, ইতিহাস, শরিয়া, এবং আইনশাস্ত্রের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করা পর্যন্ত তার কোন জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে হুট করে বাগদাদীর উত্থান এবং তার সংগঠনের নৃশংসতা কাঁপিয়ে দিয়েছে পুরো বিশ্বকে। গোয়েন্দা সংস্থা থেকে শুরু করে সংবাদ মাধ্যমে তার সম্পর্কে অপর্যাপ্ত তথ্য এক রহস্য মানবে পরিণত করেছে তাকে।
২০০৩ সালের ইরাকের সুন্নি মুসলমানদের নিয়ে সশস্ত্র গ্রুপ খোলার অপরাধে ২০০৫ সালে তিনি মার্কিন বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। চার বছরের মাথায় ছাড়াও পান। তবে, জেলে থাকার ওই সময়ে তার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কাব্বুখার জেলে আটক ছিলেন তিনি। সেসময় সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় আল-কায়েদার বেশ কয়েক জন নেতার। তবে প্রচার আছে, ইরাকে সংখ্যালঘু সুন্নিদের ওপর শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ নুরি আল মালিকির সরকারে নির্যাতনের প্রতিরোধে তিনি ২০০৩ সালে সুন্নি মুসলমানদের নিয়ে সশস্ত্র সংগঠন দাঁড় করান।
২০১০ সালে জেল থেকে বের হয়ে তিনি আল-কায়েদার হয়ে কাজ করা শুরু করেন। সে সময়ে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। ২০১১ সালে আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের প্রসংশা করে একটি চিঠি ইন্টারনেটে প্রচার করেন। এরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো তাকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করে। ওই বছর অক্টোবরেই মার্কিন কর্তৃপক্ষ তাকে জীবিত অথবা মৃত পাওয়ার জন্য ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে।
২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ইরাকে মার্কিন হামলায় বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ আল-কায়েদা নেতা নিহত হলে খুব দ্রুত তিনি নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে পৌঁছান। ২০১২ সালের জুলাইয়ে এক অডিও বার্তায় তিনি সর্বপ্রথম ইসলামিক স্টেটের ধারণা দেন। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি আল-কায়েদা নেতা ওসামা-বিন লাদেনের পাঁড় ভক্ত ছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালে মার্কিন হামলায় লাদেন নিহত হওয়ার পর আল-কায়েদা নতুন প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির সঙ্গে নেতৃত্ব প্রশ্নে বাগদাদীর বিরোধ বাড়তে থাকে।
নিজেকে তিনি জাওয়াহিরি সমপর্যায়ের নেতা মনে করেন। বিন লাদেনের মৃত্যুর পর তিনি আফগানিস্তান এবং ইরাকে আল-কায়েদার নেতৃত্ব চেয়ে বসেন। এক পর্যায়ে বাগদাদীর সঙ্গে জাওয়াহিরির মতবিরোধ চরমে পৌঁছালে ২০১৩ সালে আল-কায়েদা ছেড়ে বের হয়ে আসেন।
তবে ২০০৬ সালে মার্কিন হামলায় আল-কায়েদার ইরাক শাখার প্রধান আবু মুসাব আল জারকাবি নিহত ও অধিকাংশ নেতা কারা বরণ করলে আলকায়েদা নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়ে। জেল থেকে বেরিয়ে এই সুযোগটিই কাজে লাগান বাগদাদী। বলা হয়ে থাকে, বিন লাদেনের মৃত্যু তার এ পথ আরও সুগম করে। বিভিন্ন ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে ঐক্য ও সংহতির পতাকা তলে এনে গড়ে তোলেন জেহাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)।
ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার এবং সিরিয়ার রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সুযোগ কাজে লাগিয়ে খুব অল্প সময়ে ইসলামিক স্টেট ব্যাপক সাফল্য পায়। বিস্ময়কর সামরিক সাফল্যে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সিরিয়ার রাক্কা থেকে শুরু করে উত্তর-পশ্চিম ইরাকের ফালুজা-রামাদি-মসুল এবং তিকরিতের দখল নেয়।
আল-কায়েদা থেকে আদর্শিক ভাবে আলাদা হলেও বিন লাদেনের প্রতি ভালবাসা এখনও রয়ে গেছে বাগদাদীর। সম্প্রতি লাদেনের হত্যাকারী হিসেবে পরিচিত মার্কিন সেনা ও’নেইলকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে তার সংগঠনের পক্ষ থেকে। অনলাইনে দেওয়া ওই হুমকিতে ও’নেইলের বাড়ির ঠিকানা পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে বরাবর পশ্চিমা বিরোধী কট্টর এই নেতা পশ্চিমা জিনিস বর্জনের কথা বলে আসলেও ২০১৪ সালে জুনে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক অনলাইন সংবাদ ডেইলি মেইলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন তার সম্পর্কে বেশ কৌতুহল সৃষ্টি করে। প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ভিডিওতে দেখা যায় বাগদাদী উচ্চ প্রযুক্তির হাত ঘড়ি ব্যবহার করছেন। যাকে স্পোর্টস ওয়াচ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিলো।
সাধারণত জেমস বন্ড সিরিজের নায়কদের উচ্চ প্রযুক্তির এই ঘড়ি ব্যবহার করতে দেখা যায়। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। ধারণা করা হয়, তার উচ্চ শিক্ষা এবং প্রযুক্তি জ্ঞানের কারণে আইএস মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্বে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে।