গত ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ ও আলোচনা সভায় খালেদা জিয়া মন্তব্য করেন; ‘বলা হয়, এত লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে, আসলে কত শহীদ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, এটা নিয়েও বিতর্ক আছে।’ (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ২১ ডিসেম্বর)
খালেদা জিয়ার বক্তব্যের রেশ কাটতে না কাটতেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ‘নির্বোধের মতো মারা গিয়েছিলেন’ বলে মন্তব্য করেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে গত ২৫ ডিসেম্বর এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন যে, ‘একাত্তরে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা পাকিস্তানের বেতন ভাতা খেয়েছে তারা নির্বাধের মতো মারা গেল। আর আমাদের মতো নির্বাধেরা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ফুল দিই। আবার না গেলে পাপ হয়। তারা যদি এতো বুদ্ধিমান হয়, তাহলে ১৪ তারিখ পর্যন্ত নিজের ঘরে থাকেন কীভাবে?’
তিনি আরো বলেন, ‘নেতৃত্বের অজ্ঞতা ও আগাম সতর্কতার অভাবে ২৫ মার্চ যারা মারা গেছেন, তারা না জানার কারণে মারা গেছেন। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বর যারা মারা গেছেন, আদেশে তারা প্রতিদিনই তাদের কর্মস্থলে যেতেন এবং পাকিস্তানের বেতন খেয়েছেন।’ (সূত্র: ভোরের কাগজ, ২৬ ডিসেম্বর)
মূলতঃ স্বাধীনতার ৪ দশক পরে এসে মুক্তিযুদ্ধের সাবেক সেক্টর কমাণ্ডার ও সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, যিনি নিজেও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তার দলের অত্যন্ত প্রভাবশালী এক নেতা যখন একই সুরে এদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের সংখ্যা ও অবদান নিয়ে প্রশ্ন তুলেন, তখন সারা দেশেই তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কুখ্যাত হামিদুর রহমান কমিশন রিপোর্টে যা বলেছিল, তারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় আবারো। প্রতিবাদে ফেটে পড়েন ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো পরিবারের মানুষেরা ও ৭১ এর চেতনায় বিশ্বাসী প্রতিটি বাঙালী হৃদয়। অনলাইন, অফলাইনে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। আর সেই সাথে সামনে চলে আসে GENOCIDE DENIAL LAW প্রণয়নের দাবিটিও।
GENOCIDE DENIAL LAW বলতে এমন এক ধরণের বিশেষ আইনকে বোঝায়, যার দ্বারা কোন গণহত্যা অস্বীকারকারীকে আইনত দণ্ডে দণ্ডনীয় করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বহুদেশে এটি অত্যন্ত ঘৃণিত ও আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা বা হলোকাস্টে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রশ্ন তোলাও সেখানে আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ।
এই প্রসঙ্গে মুক্তমনা বাংলা ব্লগের মডারেটর ফরিদ আহমেদ সিলেট টুডেতে লিখেছেন, “ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সংসদে পাশ করা ‘ল এগেইনস্ট ডিনায়াল অব হলোকাস্ট’ ইউরোপের অনেকগুলো দেশে চালু রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানির নাৎসি বাহিনী ইউরোপে যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তাকে অস্বীকার কিংবা এর তীব্রতাকে হালকা করে দেখার যে কোনো হীন প্রচেষ্টাকেও আইনগতভাবে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এই আইনে।
গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, এমনকি প্রশ্ন তোলাকেও ক্রিমিনাল অফেন্স হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই আইনে। আর্নস্ট জুন্দেল একজন জার্মান। হলোকাস্ট ডিনায়ালের প্রকাশক হিসাবে স্বীকৃত তিনি। ১৯৫৮ সালে তিনি জার্মানি থেকে ক্যানাডায় চলে আসেন। তখন তার বয়স মাত্র ১৯।
সেই থেকে কানাডাতে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। ১৯৭৭ সালে তিনি প্রকাশনা সংস্থা খুলে বসেন। নাম সামিসদাত প্রকাশনা। এখান থেকেই প্রকাশিত হয় তার নিজের লেখা ‘দ্য হিটলার উই লাভড এন্ড হোয়াই’ এবং রিচার্ড ভেরালের পুস্তিকা ‘ডিড সিক্স মিলিয়ন ডাই? দ্য ট্রুথ এট লাস্ট’।
নাজি এবং নিও নাজি প্রচারণার বই-পুস্তক, পুস্তিকা প্রকাশ করে তা ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে সামিসদাত। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে বিপুল সংখ্যক বই, জার্নাল, নাজি প্রতীক, চলচ্চিত্র, ক্যাসেট এবং অন্যান্য সামগ্রীর প্রায় দুইশো চালান হস্তগত করে পশ্চিম জার্মানির পুলিশ।
এর বেশিরভাগই আসছিলো কানাডা থেকে। ১৯৮১ সালের এপ্রিল মাসে পশ্চিম জার্মানির সরকার কানাডার জুয়িশ কংগ্রেসকে চিঠি লিখে জানায় যে, এই সব জিনিস সব আসছে সামিসদাত প্রকাশনী থেকে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে জুন্দেলের চিঠিপত্র পাঠানোর অধিকারকে খর্ব করে দেয় দেশটির সরকার। তাদের যুক্তি ছিল যে, জুন্দেল ঘৃণার প্রচারণা চালাচ্ছেন।
ঘৃণা প্রচারণা কানাডায় ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত। কানাডা থেকে এগুলো পাঠাতে না পেরে, জুন্দেল সীমান্তের ওপারে নায়াগ্রা ফলস থেকে পাঠানো শুরু করে।
১৯৮৩ সালে হলোকাস্টের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সাবিনা সাইট্রন তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। নানা ঘাট পেরিয়ে ১৯৮৮ সালে অন্টারিও কোর্ট তাকে পনেরো মাসের জেল দেয়। কিন্তু, ১৯৯২ সালে সুপ্রিম কোর্ট এতে নাক গলায়, মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে তার শাস্তিকে বাতিল করে দেয়।
২০০০ সালে তিনি টেনেসিতে চলে যান। ২০০৩ সালে ইমিগ্রেশন আইন ভঙ্গ করার জন্য গ্রেফতার হন। আমেরিকান কর্তৃপক্ষ তাকে কানাডায় ডিপোর্ট করে দেয়। জুন্দেল প্রায় চল্লিশ বছর ধরে কানাডায় থাকলেও তার নাগরিকত্ব ছিল না। এই সুযোগ নিয়ে ২০০৫ সালে কানাডা তাকে ফেরত পাঠায় জার্মানিতে।
জার্মানিতে জুন্দেলের বিচার হয়। ২০০৭ সালে তাকে পাঁচ বছরের জেলদণ্ড দেওয়া হয়। যেহেতু আগেই দুই বছর জেল খেটেছেন তিনি, সে কারণে ২০১০ সালে মুক্তি পান। তবে কানাডায় ফেরার ব্যাপারে এখনো তার উপরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।”
সাব্বির খান সিলেট টুডে ডট কমে প্রকাশিত তার প্রবন্ধ ‘চক্রান্ত চলমান: ‘বার্গম্যান থেকে খালেদা; মজহার থেকে গয়েশ্বর’-এ লিখেছেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নাৎসি বাহিনী কর্তৃক গণহত্যাকে (হলোকাস্ট) ঠিক ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করতে চাননি বলে ডেভিড আর্ভিঙ নামের পশ্চিমের একজন খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ ১৩ মাস জেল খেটেছিলেন।
অন্য এক ঘটনায় ‘প্রফেসর বার্নার্ড লুইস একজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ, যিনি যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যার মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তিনি ফরাসী পত্রিকা Le Monde তে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন ‘গণহত্যার সংজ্ঞায় পড়ে না বলে আর্মেনিয়ায় গণহত্যা হয়েছে বলা যাবে না।’
তার এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আর্মেনিয়ানরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয় এবং এর সূত্র ধরে ফরাসি এক আদালত তাকে এক ফ্রাঙ্ক জরিমানা করেছিলো। আরেক ঘটনায় মার্কিন অধ্যাপক ও আইনজীবী পিটার আর্লিন্ডার রুয়ান্ডার গণহত্যাকে অস্বীকার করে এটাকে যুদ্ধের একটি বাই প্রোডাক্ট বলে অভিহিত করেছিলেন। এ কারণে গণহত্যা বিষয়ক মামলায় একটি পক্ষের আইনি পরামর্শক হওয়া সত্ত্বেও রুয়ান্ডার আদালত তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল।
“গণহত্যা কি? যুদ্ধকালীন সময়ে নির্বিচারে অসংখ্য বেসামরিক লোককে হত্যা করাই হলো গণহত্যা। আর এই গণহত্যার সত্যতা অস্বীকার করার নাম হলো জেনোসাইড ডিনায়েল। আর এ ডিনায়েলের ধৃষ্টতার বিরুদ্ধে করা আইনের নামই GENOCIDE DENIAL LAW.
গণহত্যা অস্বীকার আইন সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে, “Genocide denial is an attempt to deny or minimize statements of the scale and severity of an incidence of genocide. Some of the better-known examples are Holocaust denial, the Armenian Genocide denial, the Serbian Genocide denial, the Rwandan Genocide denial, Denial of the Holodomor and the Bosnian Genocide denial.Where there is near universal agreement that a genocide occurred, genocide denial is usually considered a form of illegitimate historical revisionism. However, in circumstances where the generally accepted facts do not clearly support the occurrence of a genocide, the use of the term may be an ad hominem by those who argue that a genocide occurred.The extremely serious nature of the crime of genocide, along with the terrible reputation it creates, and potential repercussions that may come against a nation as a result of committing it, ensures that whenever genocide is charged, there will be parties that attempt to avoid or divert blame.[1] However Larissa van den Herik has pointed out there is a gap in international law that encourages the use of the charge of genocide when other charges might be more appropriate “The only way for Bosnia to go to the ICJ was to allege genocide. There is no Crimes against Humanity Convention providing for jurisdiction for the ICJ”
তরুণ মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা গবেষক আরিফ রহমান aaj24.com এ লিখেছেন, “Genocide Denial অর্থাৎ গণহত্যা অস্বীকার। বক্তব্য, সাহিত্য, বই, লিফলেট, পোস্টার, সমাবেশ, পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, ইন্টারনেট কিংবা যেকোনো মাধ্যমে, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা ব্যক্তিগতভাবে কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত প্রমাণিত এবং স্বীকৃত গণহত্যাকে অস্বীকার করা কিংবা ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে বলাকে Genocide Denial বলে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই আইনের কয়েকটি উদাহরণ: National Socialism Prohibition Law অনুসারে অস্ট্রিয়ায় ন্যাশনাল সোশ্যালিস্টদের গণহত্যার ইতিহাস অস্বীকার বা তাদের অপরাধ হালকা করা চেষ্টা, অন্য কারো করা এ জাতীয় কাজ সমর্থন অথবা ন্যাশনাল সোশ্যালিস্টদের কোনো কাজের বৈধতা খোঁজার কোনো চেষ্টা কোনো ধরনের মিডিয়ায় প্রকাশ করা যাবে না। যদি কেউ করে তাকে দেয়া হয় ১ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড।
এছাড়া বেলজিয়ামের Negationism Law অনুসারে জার্মানির ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট আমলের গণহত্যার ব্যাপ্তি হালকা করা চেষ্টা, সমর্থন বা বৈধতাদানের সকল চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই আইনে শাস্তির মেয়াদ ৮ দিন থেকে ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও সেইসঙ্গে ৫ থেকে ২৬ হাজার ফ্রাঙ্ক জরিমানা।
চেক রিপাবলিকে এই আইনের নাম Law Against Support and Dissemination of Movements Oppressing Human Rights and Freedoms নাৎসি গণহত্যার ইতিহাস অস্বীকার, সন্দেহ, অনুমোদন/স্বীকৃতি বা তাদের কাজের বৈধতা দেবার চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এই আইনে শাস্তি ৬ মাস থেকে ৩ বছরের কারাদণ্ড। জার্মানির 130 Public Incitement অনুসারে (1985, Revised 1992, 2002, 2005) জনসমক্ষে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট আমলের অপরাধসমূহ অস্বীকার, সমর্থন বা তাদের অপরাধ লঘুকরণের চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। এ সংক্রান্ত কোনো সিম্বল প্রচার ও প্রদর্শন করাও দণ্ডনীয় অপরাধ। শাস্তি ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং/অথবা জরিমানা।
লুক্সেমবুর্গ Criminal Code, Act of 19 July 1997 অনুসারে ১৯৪৫ সালের আন্তর্জাতিক ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে ঘোষিত যুদ্ধাপরাধ অস্বীকার, সমর্থন, লঘুকরণের প্রচেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই আইনে শাস্তির মেয়াদ ৮ দিন থেকে ৬ মাস কারাদণ্ড।
রোমানিয়ায় Emergency Ordinance No. 31 of March 13, 2002 অনুসারে গণহত্যার ইতিহাস অস্বীকার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রেসিস্ট, জেনোফোবিক বা ফ্যাসিস্ট সিম্বল প্রচার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। শাস্তি ৬ মাস থেকে ৫ বছর কারাদণ্ড (কিছু আইনসঙ্গত অধিকার রহিতকরণসহ)।
ফ্রান্সে LAW No 90-615 to repress acts of racism, anti-Semitic and xenophobia (1990) ১৯৪৫-অনুসারে লন্ডন চার্টার এর আওতাভুক্ত অপরাধসমূহের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ বা প্রশ্ন উত্থাপন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এতে শাস্তির মেয়াদ ১ মাস থেকে ১ বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা।”
কাজেই এই কথা নির্ধিধায় বলা যায়, গণহত্যা ডিনায়েল আইন অবশ্যই একটি বাস্তবসম্মত আইন।
বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছিল কিনাঃ বাংলাদেশের গণহত্যা যে হয়েছিল, এটি একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ৩০ লক্ষ নিরীহ বেসামরিক বাঙ্গালীকে হত্যা করে। দুই থেকে ৫ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানী করে।
পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ দীর্ঘদিন ধরেই মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের সংখ্যা নিয়ে অনলাইন, অফলাইনে প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে আসছে। তাদের প্রপাগাণ্ডার মূল ভিত্তি হলো বিতর্কিত ভারতীয় লেখিকা শর্মিলা বসুর “ডেড রেকনিং” নামের একটি বই এবং পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গঠিত কুখ্যাত “হামিদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট”।
মজার ব্যাপার হলো শর্মিলা বসু তার এই তথাকথিত গবেষণা কর্মটি সম্পাদন করেছিলেন পাকিস্তানের আর্কাইভে সংরক্ষিত তথ্যাদির উপর ভিত্তি করে। বলাবাহুল্য এই গবেষণা কর্মটি আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত হয়নি। উপরন্তু ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে।
তথাপি একশ্রেণীর উচ্ছিষ্টভোগী মানুষ এই মিথ্যাকেই সত্য বলে চালানোর অপচেস্টা করে চলেছে প্রতিনিয়ত।বাংলাদেশের গণহত্যা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাংবাদিক এন্থনি ম্যাসকারানহাসের একটি রিপোর্ট যুদ্ধকালীন সময়ে প্রকাশিত হয়। সেটির প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সানডে টাইমস বলে, “Nobody knows exactly how many people were killed, but certainly a huge number of people lost their lives. Independent researchers think that between 300,000 and 500,000 died. The Bangladesh government puts the figure at three million.”
গবেষক • Sharlach, Lisa তার প্রখ্যাত গবেষণা কর্ম Rape as Genocide: Bangladesh, the Former Yugoslavia, and Rwandahttp://www.tandfonline.com/doi/abs/10.1080/713687893 এ উল্লেখ করেন “During the nine-month-long conflict an estimated 300,000 to 3 million people were killed and that Pakistani armed forces raped between 200–400,000 Bangladeshi women and girls in an act of genocidal rape”Payaslian, Simon.
“20th Century Genocides”. Oxford bibliographies এর মতে, “An academic consensus holds that the events that took place during the Bangladesh Liberation War constituted genocide”
“Pakistan: The Ravaging of Golden Bengal”. Time. 2 August 1971. এ বলা হয়েছে ,“The Guinness Book of Records lists the Bengali atrocities as one of the largest five genocides in the twentieth century.”
Guinness World Records (2006). Guinness World Records 2007. London: Guinness World Records Ltd. pp. 118–119. ISBN 1-904994-12-1 এ উল্লেখ আছে “The Guinness Book of Records lists the Bengali atrocities as one of the largest five genocides in the twentieth century.”
“Kennedy Charges Genocide in Pakistan, Urges Aid Cutoff”. The Washington Post. 17 August 1971. Archived from the original (PDF) on 16 December 2011. Retrieved 7 March 2013 এ বলা আছে “Even in the US, senator Kennedy charged Pakistan with committing genocide and called for a complete cut-off of American military and economic aid to Pakistan”.
R.J. Rummel, professor of Political Science at the University of Hawaii এর মতে “The genocide and gendercidal atrocities were also perpetrated by lower-ranking officers and ordinary soldiers. These “willing executioners” were fueled by an abiding anti-Bengali racism, especially against the Hindu minority. “Bengalis were often compared with monkeys and chickens. Said General Niazi, ‘It was a low lying land of low lying people.’ The Hindus among the Bengalis were as Jews to the Nazis: scum and vermin that [should] best be exterminated. As to the Moslem Bengalis, they were to live only on the sufferance of the soldiers: any infraction, any suspicion cast on them, any need for reprisal, could mean their death. And the soldiers were free to kill at will. The journalist Dan Coggin quoted one Pakistani captain as telling him, “We can kill anyone for anything. We are accountable to no one.”
This is the arrogance of Power”এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা যে এদেশের বুকে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিল, সে ব্যাপারে কোন মতদ্বৈততার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।
কেন এই বিরোধীতাঃ হঠাৎ করেই ৪৪ বছর পরে তবে কেন এই প্রশ্ন উত্থাপন করলেন ম্যাডাম জিয়া ও তার দল? উত্তরটা একেবারেই সহজ। বিএনপি নামক দলটি বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিগত বছরগুলোতে সরকার বিরোধী তেমন কোন উল্লেখযোগ্য আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে পারেনি। তাদের জোটের অন্যতম শরীকদল জামায়াতে ইসলামীর অধিকাংশ নেতাই ৭১ এর চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী।
মানবতাবিরোধী অপরাধে তাদের পাশাপাশি, বিএনপির অন্যতম শীর্ষ নেতা সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর ও ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। ফলে সরকারের প্রতি অনেকাংশে অসন্তুষ্ট হলেও জনমত এখলো বিএনপির নাগালের বাইরে।জন্মলগ্ন থেকেই দলটি এদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা পেয়ে প্রথমে জাগদল ও পরে বিএনপি গঠন করে।
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ বা বামপন্থী দলগুলোর সমর্থন না পেয়ে তিনি ৭১ এর পরাজিত মুসলীগ লীগ, পিডিপি, নেজামে ইসলাম আর চৈনিক বামপন্থীদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। কুখ্যাত কলাবেরটার শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানান। বহুদলীয় গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে ৭৮ সালে জামায়াতে ইসলামীকে পুনরায় এদেশের মাটিতে রাজনীতী করার অধিকার ফিরিয়ে দেন।
খালেদা জিয়া ক্ষমতায় গিয়ে দুই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীকে মন্ত্রীত্ব প্রদান করে শহীদদের রক্তের সাথে চরম বেইমানী করেন। বিএনপির রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি ভারত ও হিন্দুবিরোধিতা তাদের অজান্তেই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীতায় পর্যবাসিত হয়। তাই এ ধরণের বক্তব্য তাদের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত নয় বটেই।
প্রতিবাদঃ ম্যাডাম জিয়া ও গয়েশ্বরের বক্তব্যে ফুসে ওঠেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রতিটি বাঙালী। অনলাইন অফলাইনে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মন্তব্যের প্রতিবাদে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ’৭১ মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে।
সভায় শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘খালেদা জিয়া বা গয়েশ্বররা যা বলছেন, সেগুলো গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। এর সঙ্গে পাকিস্তান জড়িত। এদের সমূলে ধ্বংস করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন কেউ এভাবে মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করতে না পারে, সে জন্য আইন করতে হবে। যারা এত দিন এই অপরাধ করেছে তাদেরও বিচার করতে হবে।’
মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘আমরা এমন একটি দেশ স্বাধীন করেছি যেখানে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক হয়। বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে অপমানসূচক কথা বলা হয়। অথচ আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যম ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরেই বলেছিল নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ। এগুলো তারাই বলেন, যারা যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিলেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার মেয়ে মেঘনা গুহ ঠাকুরতা বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। ১৯৫ জন পাকিস্তানির বিচার করার কথা চলছে। কাজেই এখন মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করে অনেক কথাই শুনব। দেশি-বিদেশি এই ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।’
শহীদ আলিম চৌধুরীর মেয়ে নুজহাত চৌধুরী বলেন, খালেদা জিয়া যে এমন কথা বলবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। এভাবেই তাদের স্বরূপ প্রকাশিত হচ্ছে।
শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর বলেন, মুক্তিযুদ্ধকে যারা বিকৃত করে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে তাদের বিচার করা উচিত।
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে জাহিদ রেজা নূর বলেন, স্কুল-মাদ্রাসা-ইংরেজি মাধ্যমসহ সব জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়াতে হবে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার বলেন, স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসীরা সবাই মিলে এই ষড়যন্ত্র রুখতে হবে।
শহীদ জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হান বলেন, সময় এসেছে এদের সব জায়গায় বর্জন করার।
শহীদ রাশিদুল হাসানের মেয়ে রোকাইয়া হাসিনা বলেন, ‘শহীদের সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত। আর ঘৃণা হয় তাদের জন্য, যারা শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করে।’
শহীদ মুনীর চৌধুরীর পুত্রবধূ মঞ্জুলি কাজী বলেন, যে গয়েশ্বর আজকে বুদ্ধিজীবীদের অবমাননা করছেন, একাত্তরে তিনি কোথায় ছিলেন? দেশে এমন আইন করা হোক, আর কেউ যেন এভাবে কটূক্তি করতে না পারে।
পরিশেষে শুধু এটাই বলবো মুক্তিযুদ্ধ শুধু আমাদের নিজেদের একটি দেশই দেয়নি। দিয়েছে স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে আত্মমর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার অধিকার। আর এই অধিকারের জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন ৩০ লক্ষ মানুষ। বয়ে গেছে একনদী রক্ত। তাই অবিলম্বে GENOCIDE DENIAL LAW প্রণয়ন করতে হবে।
এই শহীদদের নিয়ে ভবিষ্যতে যেন আর কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে। আমাদের জন্য আত্মত্যাগকারী বীর শহীদদের প্রতি এতোটুকু রক্তের ঋণ যে শোধ করতেই হবে। না হলে, আগামীর ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)