একজন লোক অনেক বিত্তশালী হতে চায়। অনেক জমির মালিক হতে চায়। তো সেই লোককে একবার প্রস্তাব দেওয়া হলো: সূর্যোদয়ের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যতটা পথ সে যেতে পারবে সবটুকু জমির মালিক হবে সে। শর্ত হলো তাকে অবশ্যই সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে ফিরে আসতে হবে। সম্ভাব্য সাম্রাজ্যের উচ্চাভিলাষ নিয়ে মহা আনন্দে পরের দিন সকালে লোকটি শুরু করলো তার ছুটে চলা। যত দূর যাওয়া যায় ততটাই তার! সারাদিন সে দৌঁড়ালো, হাঁটলো। কোনো বিশ্রাম নিল না। “জমি আমার চাই!” দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। তখন ঐ লোকের অবস্থা- “আমি ক্লান্ত পথিক এক!” জীবনে এমন সুযোগ আসবে না ভেবে অবসন্ন শরীর নিয়ে ছুটে চলল তবু। হঠাৎ মনে হলো, শর্ত অনুযায়ী তাকে শুরুর জায়গায় ফিরে আসতে হবে সূর্যাস্তের আগেই। কিন্তু হাতে সময় বেশি নেই। শুরু হলো পেছনে ফেরা। সূর্যের দিকে তাকাচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। কিন্তু শরীর আর পারছে না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তবু হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছানো গেল ঠিক সূর্যাস্তের সময়টাতেই। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ! এমন ক্লান্ত বিধ্বস্ত দেহে প্রাণবায়ু আর থাকতে চায়নি। লোকটিকে কবর দেওয়া হলো। এবং শেষ পর্যন্ত সে পেল সাড়ে তিন হাতের ঐ ছোট্ট জমিটুকুই!
এভাবেই আমাদের জীবন শেষ হয়; চাহিদা শেষ হয় না। আমরা প্রত্যেকেই ছুটে চলেছি অনন্ত এক চাহিদাকে সঙ্গী করে। একটি চাহিদা পূরণ হলে আমরা বলি না- আমার আর কোনো চাহিদা নেই। আমরা থামতে জানি না, ফিরে আসতে জানি না। আরো চাই, আরো চাই- এই হলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় জিকির! পণ্যই আজ আমাদের উপাসনা। বস্তুগত অর্জনকেই বানিয়ে ফেলেছি সাফল্যের মাপকাঠি। টাকার অংকে মাপতে শিখেছি সমস্ত দেনা-পাওনা। জ্ঞাতে অজ্ঞাতে প্রত্যেকেই হয়ে পড়েছি পুঁজিবাদের প্রচারক! এক একজন মানুষ যেন পুঁজির এক একটি স্বয়ংক্রিয় আতুঁরঘর!
নানা কারণে সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগের প্রয়োজন হয়, সুযোগ হয়। টাকা পয়সার প্রসঙ্গ এলেই বলি- এতো টাকা টাকা করা ঠিক নয়। জীবনে খুব বেশি টাকার প্রয়োজন নেই। বিস্ময়করভাবে অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হয় না! বলে- টাকার দরকার আছে। টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। আমি পাল্টা বলি, নিশ্চয়ই জীবনে অর্থবিত্তের দরকার আছে। কিন্তু অর্থবিত্তকেই জীবনের উদ্দীষ্ট বানিয়ে ফেলার কোনো প্রয়োজন দেখি না। জীবন যাপনের জন্য অর্থ; অর্থের পাহাড় গড়ার জন্য জীবন নয়। বিশেষ করে এমন এক সমাজে আপনি উপুর্যপরি অর্থের পেছনে ছুটতে পারেন না, যেখানে অর্থের অভাবেই কারো জীবন চলে যায়।
পৃথিবীতে এখনো প্রতিরাতে আশি কোটি মানুষ না খেয়ে ঘুমাতে যায়। এই বাংলাদেশেই নিজের দেড় বছরের সন্তানকে অর্থের জন্য বিক্রি করে দেয় কোনো এক মা। অভাবের কষ্ট সইতে না পেরে কৃষক করে আত্মহত্যা! এই বাংলাদেশেই আবার দুই কোটি টাকায় ফ্ল্যাট কেনা হয়। কোটি টাকার গাড়িতে চড়ে প্রমোদভ্রমণে যেতে যেতে হয়ত কেউ কেউ ভেবে নেয়, কীভাবে এদেশ থেকে দারিদ্র বিমোচন করা যায়!
টাকা আছে বলেই গায়ে-হলুদ/বিয়ে/জন্মদিন/বিয়ে-বার্ষিকী উদযাপনের নামে কোটি টাকা নাই হয়ে যায়। টাকা আছে বলেই এদেশের কারো কারো সন্তানের গায়ে-হলুদ অনুষ্ঠানে বিদেশ থেকে শিল্পী এনে কনসার্ট করানো হয়। বিয়ের বাজার সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ড থেকে। কোনো কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যত টাকা খরচ করা হয় তা দিয়ে হয়ত একশ’ অসহায় পরিবারকে স্বাবলম্বী করে দেওয়া যেত। টাকা আছে বলেই লাখ টাকার পারফিউম না হলে অনেকের চলে না। এক হাজার টাকার এক টুকরো পিৎজা খাওয়ার ‘চাহিদা’ তৈরি হয় পকেটে কিংবা বাবার পকেটে টাকা থাকে বলেই। অথচ ঐ এক হাজার টাকা দিয়েই কয়েকজন পথশিশুকে একবেলা পেটপুরে ভাত খাওয়ানো যেত।
একটা সময় বলা হত, প্রয়োজনই আবিষ্কারের প্রসূতি। এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে, আবিষ্কারই প্রয়োজনের প্রসূতি! পুঁজিবাদের প্রবক্তারা তাদের পুঁজির প্রসারের জন্য নতুন নতুন পণ্য আবিষ্কার/উৎপাদন করে। আমরা ভোক্তারা অন্ধের মতো সেই পণ্যের পেছনে ছুটে বেড়াই। জীবনের জন্য সেই পণ্য হয়ত স্বাভাবিক কোনো প্রয়োজন নয়; কিন্তু এই অপ্রয়োজনীয় জিনিসটিই আমাদের সামনে উদ্দীষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। কখনো কখনো এই মেকি চাহিদা পূরণ করার জন্য অনেক প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদাকে উপেক্ষা করে ফেলি। সমাজ ও সভ্যতার বিনির্মাণে অবদান রাখার বিষয়ে বিস্মৃত হয়ে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর জীবন দর্শনে এবং জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়ি।
কোমল পানীয়’র নামে আমরা যা খাই, পুষ্টিবিদদের মতে তার খাদ্যমান প্রায় শূন্য। তবু বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো। কারণ তারা ভোক্তা তৈরি করতে পেরেছে। কোমল পানীয় যখন আবিষ্কৃত হয়নি, তখন এই জিনিসের চাহিদাও কারো মধ্যে তৈরি হয়নি। আবিষ্কৃত হওয়ার কারণে এই অপ্রয়োজনীয় পণ্যই হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘চাহিদা!’
এমন হাজারো ‘চাহিদা’র মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে আজকের আধুনিক সভ্যতার মানুষগুলো। হারিয়ে ফেলছে জীবনের সত্যিকারের বোধ। চাহিদার পেছনে ছুটতে ছুটতেই জীবন শেষ হয়। ভোগের জীবনে উপভোগ করা হয় না মানবিক ও নান্দনিক বিয়ষগুলো। সম্পদের স্তুপ হয়ে হয়ে গড়ে ওঠা পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ছে অমলিন হাসিগুলো। পাঁচতারকা হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে যে হাসি ধ্বনিত হয়, তার চেয়ে কোনো অনাহারী পথশিশুর মুখে একটু খাবার তুলে দেওয়ার আনন্দ যে কতো প্রাণময়, অকৃত্রিম; তা বুঝতে না পারলে সত্যিকারের মানবিক সমাজ আর হয়ে ওঠে না।
এক জীবনে একজন মানুষের কতো দরকার! শেষ পর্যন্ত গল্পের ঐ লোকটিই তো আমরা সবাই। সাড়ে তিন হাত মাটি ছাড়া আর কিছুই সঙ্গে যাবে না; যায় না!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)