জীবনের গল্প বড়ই অদ্ভুত, রঙ্গমঞ্চের বিভিন্ন দোলাচলে মানুষের জীবন আবর্তিত ও প্রবর্তিত হয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে নানা রকমের ঘাত প্রতিঘাতের মাধ্যমে মানুষের জীবনে চড়াই উৎরাই পাড়ি দিতে হয়। সে জীবনের কালে মানুষের মধ্যে কতই না রকমফের, বিভেদ এবং বৈচিত্রতা দেখা যায়।
এক শ্রেণির মানুষ কারোর চলার রাস্তাকে যেমন প্রশস্ত করতে সহায়তা করে ঠিক তেমনি ভিন্ন শ্রেণির কেউ কেউ অন্যের চলার পথকে বাধাগ্রস্থ করতে নানারকম ফন্দিফিকির পায়তারা করে থাকে। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষের সংখ্যাই খুব বেশি। এরাই বিভিন্ন পদ্ধতিতে মানুষের ক্ষতি সাধন করার চেষ্টা করে থাকে, যার ভিত্তিতে সমাজে স্ট্রেইন/চাপ/সংকটের সৃষ্টি হয় এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজে নানা রকমের অপরাধ অপকর্ম ঘটে। কাজেই এ শ্রেণির মানুষদের ছোঁয়া থেকে সমাজকে দূরে রাখতে হবে এবং এদের কেউই যেন নেতৃত্বে আসার সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়। কেননা এ রকম দুষ্টু-কূট শ্রেণির মানুষদের দ্বারা জনসাধারনের কোন উন্নয়ন তো দূরের কথা অপকার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
সমাজের মধ্যে উদ্ভূত নানাবিধ সংকট মোকাবেলায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পশ্চাদপদের ভিত্তিতে মানুষ অপরাধ করতে দ্বিধা করে না। ধরুন, আপনি আপনার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করে আপনার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চান এবং সমাজের প্রত্যেকে যদি উক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে ফলাফল পেতে চায় তাহলে সমাজে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে এবং সেটি হওয়াই সকলের জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে দেখা যায়, পশ্চাদপদ পদ্ধতি অনুসরণ করে অনৈতিক উপায়ের উপর নির্ভর করে যখন অনৈতিক সুবিধা পাবার পায়তারা করে থাকে ঠিক তখনি সমাজব্যবস্থায় অপরাধের ভয়াবহতা প্রকট আকারে দেখা যায়। সমাজকে সুষ্ঠুভাবে বিনির্মাণের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে চলা সকলের জন্যই মঙ্গলের এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান শর্ত।
উদাহরণস্বরূপ ধরা যায়, গ্রামের কৃষক কিংবা সাধারণ মানুষ ব্যাংক ঋণ পেতে নানারকম ঝক্কি ঝামেলা পোহায় কিন্তু যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে ঋণ মওকুফ করার পায়তারা করে তারাই কিন্তু খুব সহজেই ব্যাংক থেকে অল্প সুদে ঋণ পেয়ে যায়। যার যেখানে যা প্রাপ্য সেটা অবশ্যই কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বুঝিয়ে দেওয়া উচিত অন্যথায় এক শ্রেণি সর্বদা ভিক্টিম হবে এবং ভিক্টিমরা হীনমন্যতা থেকে অপরাধসহ নানা ধরনের জঘন্য কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না। কেননা অধিকার বঞ্চিত মানুষেরা অধিকার আদায়ের জন্য যে কোন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে দ্বিধা করে না।
কাজেই মানুষের জীবনকে বহুমুখী বৈচিত্র্যতায় ব্যাখা করার অবকাশ রয়েছে। সমাজে সাধারণত দু শ্রেণির মানুষ দেখা যায়।
প্রথমত: যারা মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং জীবন চলার পথ নানাবিধ কারণে তাদের জন্য মসৃণ হয়। কেননা তারা তাদের জন্মগত, পারিবারিক ও সামাজিক কারণে রাষ্ট্র তথা সমাজ থেকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে যার প্রেক্ষিতে তারা তাদের জীবনে কোথাও কোনরূপ বাধা বিপত্তির সন্মুখীন হয় না। তাদের অনেকেই মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনায় না নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের চোখে দেখে এবং শোষণবৃত্তিক মানসিকতার কারণে অন্যের ক্ষতি করতেও দ্বিধা করে না। এই শ্রেণির মানুষেরা জীবনের মানে বোঝে না এবং তারা জীবনকে ভিন্ন মাত্রায় দেখানোর চেষ্টা করে থাকে।
দ্বিতীয়ত: অন্যদিকে দেখা যায় এক শ্রেণির মানুষ রয়েছে যারা তাদের নিজের যোগ্যতা, প্রচেষ্টা এবং কর্মসাধনার ফলে সমাজের একটি প্রতিষ্ঠিত জায়গায় অবস্থান নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে। যেখানে তাদের পারিবারিক পরিচয়, সামাজিক মর্যাদা মুখ্য হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। এ শ্রেণির মানুষ সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য পদে পদে বাধাকে অতিক্রম করে জীবনের প্রকৃত স্বাদকে আস্বাদনের সুযোগ পায়। জীবনে চলার পথে যদি বাধাই না আসে তাহলে জীবনের কোন মানেই হয় না। চাওয়া মাত্র সব পাওয়া গেলে সে পাওয়ার মধ্যে তেমন স্বার্থকতা দেখা যায় না। আবার কিছু পাওয়ার জন্য যদি পরিশ্রম মেধা এবং যোগ্যতার প্রয়োজন হয় তবে সে পাওয়ার মধ্যে অন্য রকম অনুভূতি ও স্বার্থকতা রহিত হয়।
কাজেই বলা যায়, জীবনের গল্প প্রত্যেকের জন্য আলাদাভাবে সাজানো থাকে এবং সেখানে লেখকের ভূমিকায় আমরা প্রত্যেকে অবতীর্ণ হই। প্রত্যেক লেখকই তাঁর জীবনের গতি প্রকৃতি সুবিন্যস্তভাবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন, কেউ যথার্থ রূপ দিতে সক্ষম হন আবার কেউবা নানা কারণে স্বরূপে রূপ দিতে ব্যর্থ হন। যারা স্বমহিমায় রূপ দিতে পারেন তারা সফলতার সোপানে দাঁড়াতে সমর্থ হয় আবার যারা রূপ প্রদানে ব্যর্থ হয় তারা জীবনের যুদ্ধে হেরে যায়। তবে তারা প্রকৃত জীবনমুখী যারা বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত অতিক্রম করে নিজের মতো করে জীবনের জয়রথ করে থাকে। যেখানে সামান্য সুযোগ পাবার প্রত্যাশায় ব্যক্তিত্বের অবলোকন করে না কখনো। ব্যক্তিত্ব এক ধরনের অহংকারের বার্তা প্রদান করে থাকে এবং জীবনে ব্যক্তিত্ব ধরে রাখা প্রকৃতঅর্থে কঠিন।
কেননা সামান্য লোভ লালসাকে চরিতার্থ করার প্রয়াসে আমরা ব্যক্তিত্বকে বিলীন করতে দ্বিধা করি না। তবে আমার মনে হয় প্রত্যেকের নিজস্বতা ধরে রাখা জরুরী। যদিও নিজস্বতা ধরে রাখতে যেয়ে আপনি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন হয়তো তথাপি দীর্ঘমেয়াদে নিজের কাছে সৎ এবং সততার বীজ বপন করার প্রয়োজনীয় সাহস অর্জন করতে পারবেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)