জীবনানন্দ দাশ হয়তো কবি নন; গল্পকার, ঔপন্যাসিক কিংবা প্রাবন্ধিক নন। তিনি হয়তো ইতিহাসবিদ নন; না জ্যোতির্বিদ, না প্রকৃতিবিশারদ, না বৃক্ষলতাগুল্মের পরিচায়ক; তিনি হয়তো নদীর বর্ণনাকারীও নন।
জীবনানন্দ হয়তো পুরাণের দেবতাদের কথা বলেননি। তিনি গাঁথেননি মানুষের দুঃখবোধের মালা। বিপন্ন বিস্ময়ে কেন মানুষ মরে যেতে চায়, কেন সব শান্তি আর সুখের ভিতরেও একজন মানুষ ফাল্গুনের রাতের আঁধারে একগোছা দড়ি হাতে অশ্বত্থের নিচে গিয়ে দাঁড়ায় এবং ঝুলে পড়ে জীবনের সব লেনদেন চুকিয়ে; তিনি হয়তো তার ব্যাখ্যাকারীও নন…।
জীবনানন্দ হয়তো হাজার বছর ধরে পথচলা পরিব্রাজক নন। তিনি হয়তো দেখেননি দারুচিনি দ্বীপ। বনলতা সেনের সাথেও হয়তো তার দেখা হয়নি। হয়তো ওই নারী কেবলই কল্পনা। তিনি হয়তো ধানসিড়ির তীরে শঙ্খচিলের কথা বলেননি। তিনি হয়তো পক্ষিপ্রেমিকও নন। কিন্তু তিনি যা, তা হলো-তিনি একজন জাদুকর; তিনি একজন আক্রমণকারী।
আমরা যখন তাকে পড়ি, এক অদ্ভুত মায়াজাল আমাদের চারিপাশ ঘিরে ধরে। আমরা মোহাবিষ্ট হই। আমরা যেন এই জীবনের জটিলতার ভিতরে থেকেও জীবনের থেকে বহুদূরে চলে যাই। যেন ওই দূর নক্ষত্রের ভিতরে আমরা নিজেদের হাতড়ে বেড়াই। এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের গ্রাস করে। এক দুর্দান্ত ভালো লাগা, নিজের ভেতরে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এক মসৃণ পথ তিনি খুলে দেন।
তিনি আামাদের মগজে আক্রমণ করেন। আমরা আক্রান্ত হই- ‘সে এক বিস্ময়; পৃথিবীতে নাই তাহা-আকাশেও নাই তার স্থল-
চেনেনাই তারে ওই সমুদ্রের জল!
রাতে রাতে হেঁটে নক্ষত্রের সনে
তারে আমি পাই নাই; কোনো এক মানুষীর মনে
কোনো এক মানুষের তরে
যে জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে।’
জীবনানন্দ আমাদের মোহগ্রস্ত করে রাখেন। আমরা বুঝি না কী বুঝতে পারিনি। আমরা পড়ি। ভেতরে এক অদ্ভুত ভালো লাগা খেলা করে। কিন্তু আমরা তার সব শব্দের, সব বাক্যের পাঠোদ্ধারে ব্যর্থ হই। যেন এই ব্যর্থতাই কাম্য। যেন এই বুঝতে না পারার ভেতরেই আমাদের শান্তি। যেন এই অস্পষ্টতা, দুর্বোধ্যতাই আমাদের মায়াজালে বন্দি করে রাখে।
দুপুর রাতে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে অস্থির পেট্রল ঝেড়ে চলে যায় মোটর কার। আমরা গাড়লের মতো তার কাশির শব্দও শুনি। আমরা দেখি রাস্তার পাশের হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী জল পান করে। অথবা চেটে নেয়। তিনটা রিকশা তখন ছুটে মিশে যায় শেষ গ্যাস ল্যাম্পে মায়াবীর মতো জাদুবলে।
আমরা এই মায়ায়, এই জাদুর ভিতর আটকে থাকি চিনেবাদামের মতো বিশুষ্ক বাতাসে। আমাদের গালে চুমো খায় মদির আলোর তাপ। তখন আমাদের মহৎ রাত্রির ভিতরে নেমে আসে লিবিয়ার জঙ্গলের নিরবতা।
‘আমার টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা।’
এই বিরুদ্ধস্রোতের ভিতরে আমরা বসবাস করি। আমরা জানি পৃথিবীতে কোনো বিশুদ্ধ চাকরি নেই। মানুষের হাতে মানুষ নাজেহাল হয়। চারিদিকে বিকলাঙ্গ অর্ধ ভিড়-অলীক প্রয়াণ। আমরা জানি মানুষের লালসার শেষ নেই। উত্তেজনা ছাড়া কোনো দিন ঋতু ক্ষণ, অথবা অবৈধ সঙ্গম ছাড়া সুখ কিংবা অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় কোনো সাধ নেই। আমাদের জীবনের সব সাধ অগাধ মৃত্যুর ঢেউয়ে ঘেরা।
…কিন্তু নদী, অজস্র অসংখ্য নদী আমাদের রক্তের ভিতর বয়ে যায়। আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। সমুদ্রচিলের সাথে রৌদ্রের প্রভাবে আমরা কথা বলি। তারপরও একদিন এই নদী শব্দ করে হৃদয়ে বিস্ময় আনিতে পারে না আর ; আমাদের মন থেকে নদীরা হারায়-শেষ হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)