রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যার ৩৬ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। ১৯৮১ সালের ২৯ ও ৩০ মে’র মধ্যবর্তী রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জিয়া হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ওই বছরের ৪ জুলাই যে কোর্ট মার্শালটি গঠিত হয় সেখানে মূলত : সেনা বিদ্রোহের বিচার হয়েছে। এই বিচারে মোট ২৯ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। যাদের মধ্যে ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ২০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল, তিন-চারজনকে চাকরিচ্যুত এবং বাকীদের খালাস দেওয়া হয়।
এছাড়া একই অভিযোগে গঠিত অন্য একটি কোর্ট মার্শালে আরেকজন সেনা অফিসারকে ফাঁসি দেওয়া হয়। দণ্ডিত অফিসারদের মধ্যে কয়েকজন জুনিয়র অফিসার ছাড়া সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, যাদের অনেকেই ছিলেন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৮১ সালের ৩০ মে দলীয় সফরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অবস্থানকালীন কিছু সেনাসদস্যের হাতে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
জিয়া হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে যে কোর্ট মার্শাল গঠিত হয় তাতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় তিনটি: ১. বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটানো, ২. বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে সংঘটিত বিদ্রোহে যোগদান করা, ৩. বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহের উস্কানি দেওয়া।
ওই কোর্ট মার্শালের কোথাও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জিয়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়নি।
তৎকালীণ সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি) নির্দেশে গঠিত এবং তার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ওই কোর্ট মার্শালের আসামীপক্ষের ডিফেন্ডিং অফিসার তৎকালীন কর্নেল আয়েনউদ্দিন (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হিসেবে ১৯৯৬ সালে চাকরিচ্যুত) এবং ওই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করা সাংবাদিক জুলফিকার আলি মানিকের মতে বিচারটি ছিল নীল নকশা বাস্তবায়নের বিচার। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিযোদ্ধা নিধন।
জুলফিকার আলি মাণিক তার ‘জিয়া হত্যাকাণ্ড: নীল নকশার বিচার’ গবেষণামূলক বইয়ে লিখেছেন: রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীতে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে গোপন বিচারটি ছিল পুরোপুরি প্রহসন এবং সাজানো নাটক। সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা নিধনের নীল নকশার অংশ হিসেবে আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখা হয়েছিল কাদের বিচার হবে এবং কী শাস্তি হবে।
আয়েনউদ্দিন এক সাক্ষাতকারে বলেছেন: কিছু জুনিয়র অফিসার ছাড়া ওই কোর্ট মার্শালে যারা শাস্তি পেয়েছিলেন যেমন মেজর জেনারেল, লেঃ কর্নেল, কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ এক প্রবন্ধে ওই কোর্ট মার্শাল সম্পর্কে লিখেছেন: কোর্ট মার্শালে অভিযুক্ত ছিলেন কেবল মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররাই। সে সময় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে চার জন ব্রিগেড কমান্ডারের তিনজন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা- ব্রিগেডিয়ার মহসীন, কর্নেল নওয়াজেশ ও কর্নেল রশিদ। এই তিনজনকেই কোর্ট মার্শাল করে ফাঁসি দেওয়া হয়। অন্য ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার লতিফ ছিলেন পাকিস্তান-প্রত্যাগত। তাকে কোর্ট মার্শালে অভিযুক্তই করা হয়নি।
ওই কোর্ট মার্শালে মোট ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ৫ জনই ছিলেন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে তিন জন ছিলেন বীরবিক্রম এবং দুই জন বীরপ্রতীক।
১৯৮১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যে ১২ জন অফিসারকে ফাঁসি দেওয়া হয় তারা হলেন, ব্রিগেডিয়ার মহসীন উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, কর্নেল নওয়াজেস উদ্দিন, কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ বীরপ্রতীক, লে. কর্নেল এটিএম মাহফুজুর রহমান বীরবিক্রম, লে. কর্নেল মোঃ দেলোয়ার হোসেন বীরবিক্রম, মেজর এ জেড গিয়াসউদ্দিন আহমদ, মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঁইয়া বীরপ্রতীক, মেজর কাজী মমিনুল হক, মেজর মোঃ মুজিবুর রহমান, ক্যাপ্টেন আবদুস সাত্তার, ক্যাপ্টেন জামিল হক এবং লেফটেন্যান্ট রফিকুল হাসান খান।
৩০ সেপ্টেম্বর বিচারের জন্য শারীরিক সক্ষমতা না থাকার পরও অন্য এক কোর্ট মার্শালে ফাঁসি দেওয়া হয় লে. কর্নেল শাহ মোঃ ফজলে হোসেনকে।
৭ সদস্যের ওই কোর্টের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আব্দুর রহমান ছিলেন পাকিস্তান ফেরত একজন সেনা কর্মকর্তা। তিনি দায়িত্বপালনকালীন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের গালিগালাজও করতেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এছাড়া বাকী সদস্যদের মধ্যে এক মাত্র কর্নেল মতিউর রহমান বীরপ্রতীক (পরে মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর নেন) ছাড়া আর কেউ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, সবাই ছিলেন পাকিস্তান ফেরত। তবে মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও মতিউর রহমানের নানা কর্মকাণ্ড ছিলো মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বিরুদ্ধে। তাছাড়া জজ অ্যাডভোকেট এবং তিনজন প্রসিকিউটর বা সরকার পক্ষের কৌসুলীর সবাই ছিলেন পাকিস্তান ফেরত কর্মকর্তা।
আয়েনউদ্দিন অভিযোগ করেন, কর্তৃপক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে এমন একজনকে (মতিউর রহমানকে) বেছে নিয়েছিলেন যার কাছ থেকে তারা মন মত ব্যবহার পাবে।
বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে জুলফিকার আলি মাণিক লিখেছেন: ওই বিচারের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা নিধনের আরেকটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে অভিযুক্তদের যেসব অভিযুক্ত বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে তাদেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়। একই ধরনের হিসেব কষে অভিযুক্তদের প্রত্যেকের জন্য চূড়ান্ত করা হয় নানা শাস্তি।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং ১৯৮১ সালে ওই হত্যাকাণ্ডকেন্দ্রিক নানা ঘটনাবলীর ওপরে রচিত বিভিন্ন বইপত্র থেকে জানা যায়, তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ৯০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। এ সময় তিনি জিয়া হত্যার বিচারের কোন উদ্যোগ নেননি। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর জিয়া হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করলেও সরকারের দিক থেকে এ নিয়ে বিশেষ কোন তাগিদ ছিল না। অবশেষে ২০০১ সালে পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে জিয়া হত্যার বিচার সম্ভব হয়নি।
পরবর্তী (শেষ) কিস্তি: জিয়া হত্যাকাণ্ড: যে রহস্যের জট খোলেনি