একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত একটি প্রতিবেদন নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক হৈচৈ হচ্ছে। প্রতিবেদনে জিপিএ-ফাইভ পাওয়া কিছু শিক্ষার্থীকে কয়েকটি প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ওই প্রশ্নগুলোর ঠিকঠাক জবাব দিতে পারেনি। স্কুল পেরোনো এই শিক্ষার্থীদের দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য সম্পর্কিত প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা দরকার ছিল। কিন্তু প্রতিবেদনটি দেখার পর আমার প্রশ্ন, এই কিশোর-কিশোরীকে হেয় করা, লজ্জা দেওয়া ছাড়া এই প্রতিবেদন থেকে আর কী শিখতে পারলাম আমরা, কতখানি লাভ হলো আমাদের?
প্রতিবেদনটি এভাবে দেখানো উচিত হয়েছে কি না, এটা সাংবাদিকতার নৈতিকতার মধ্যে পড়ে কি না, কয়েকজন বাছাই করা শিক্ষার্থীকে এসব প্রশ্ন করে শিক্ষার মান যাচাই করা যায় কি না, যারা এই প্রতিবেদনটি ফেসবুকে শেয়ার করেছেন, তারা ‘বিকৃত আনন্দ’ পেতে এটা করেছেন কিনা, এসব নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। আমি আর সেই আলোচনায় যাব না।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে নিজের ছোটবেলার কথা। ছোটবেলায় পড়া লেখায় ফাঁকি দিতাম, আর ফল স্বরূপ শুনতে হত ‘গাধার দল, পড়া লেখা শেখ, শিখে একটু মানুষ হ’। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি হয়তো একটু ভিন্ন। গালিগুলোর একটু পরিবর্তন দরকার মনে হয়। যেমন- পড়া লেখা শেখ, বেশি বেশি করে ডিগ্রি নেও, আর বড় হয়ে গাধা হয়ে যা। আমার সবাই যেন গাধার মত আচরণ করছি। আসলে আমাদের সার্বিক অধঃপতনই যেন প্রতিফলিত হচ্ছে।
আমাদের শিক্ষার সামগ্রিক মানের যে অধঃপতন হয়েছে এটা বুঝতে কোন টিভি প্রতিবেদন দেখার দরকার নেই। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপ প্রতিবেদনেও তা উঠে আসছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘র্যাকিং ওয়েব অফ ইউনিভার্সিটি’র সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিক্ষার গুণগত মান বিচারে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই সেরা ২১০০ এর মধ্যে স্থান পায়নি। এমনকি এশিয়ার সেরা ৭০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও আমাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয় নাই। এ থেকেই বোঝা যায় যে, আমাদের শিক্ষার মান কত নিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে।
গত তিন বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া কথিত ‘মেধাবী’ দের ৮০ ভাগই পাস নম্বর পাননি! বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা ও ইংরেজিতে ৩০ নম্বরের মধ্যে ন্যূনতম ৮ নম্বর পাননি এমন পরীক্ষার্থীর হার যথাক্রমে ৫৫% ও ৫৬%! তাছাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত শিক্ষাবর্ষে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স পড়ার সুযোগ পেয়েছে মাত্র দুইজন! আসলে আমাদের কথা বলা দরকার শিক্ষা নিয়ে, শিক্ষার মানবৃদ্ধি নিয়ে। মধ্যবিত্ত- উচ্চবিত্ত তার সন্তানদের বাড়িতে পড়াবার জন্য মাসে পাঁচ থেকে বিশ হাজার পর্যন্ত অনায়াসে খরচ করছেন। দরিদ্র মানুষও এক দুই হাজার টাকা নাভিঃশ্বাস তুলে খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন। কেন আমরা শিক্ষার উন্নয়নের জন্য স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চআয়ের মানুষের ওপর শিক্ষাকর বসিয়ে সকলের জন্য একই পদ্ধতির এমন শিক্ষার ব্যবস্থা করছি না যেটা সারা দেশে একই মানের যোগ্য শিক্ষকদের তুলে দেবে শিক্ষার্থীদের সামনে?
বিদ্যালয়গুলোকেই এমন বানিয়ে ফেলার প্রস্তাব করুন না, চারদিকের বিপুল চুরিদারির টাকাগুলো শিক্ষায় বরাদ্দ করতে বাধ্য করে এমন আওয়াজ তুলুন না যেখানে নোটবই গাইড বইয়ের চাহিদাটাই উধাও হয়ে যাবে! এমন শিক্ষানীতি নিন যেন বিদ্যালয়গুলোই এমন হয় যেখানে ছেলেটা-মেয়েটা খেলাধূলা করবে, একটা নাশতা আর একটা ভারি খাবার খাবে, আর পড়াশোনার আগাপাশতলা সেখানেই শেষ করে বাড়িতে এসে বাবা-মার সাথে জেগে থাকার বাকি সময়টুকু হেসেখেলে কাটাবে। এসব নিয়ে আলাপ আলোচনা বেশি হওয়া উচিত।
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ মানবসম্পদ। এই সম্পদ রক্ষা করা ও তার উন্নয়নের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়নের ভ্রূণ রক্ষিত আছে, একজন মানুষকে কতদূর লেখাপড়া শেখানো হচ্ছে, মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত বানানো হচ্ছে, তার ওপর। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা প্রসারের ওপর। আজকের দুনিয়ার প্রায় সব দেশেই শিক্ষা প্রসারের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এই উদ্যোগ-আয়োজনে কোনো সরকারের কতটা ও কী ধরনের ভূমিকা হবে তা নির্ভর করে সরকারটি বিত্তবান বা বিত্তহীন কাদের পক্ষের সরকার তার ওপর। যে পক্ষ অবলম্বন করে সেই অর্থনৈতিক নীতি তার ওপরেই নির্ভর করে দেশের শিক্ষানীতি।
দেশের সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে নেওয়ার সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার নিয়ে আমাদের শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা-পরিকল্পনা করতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু যুক্ত করতে হবে। বুঝতে হবে, মানবসম্পদ উন্নয়নের অন্যতম কাজ শিক্ষার প্রসার আন্দোলন হলেও, এই আন্দোলন কেবল অক্ষরকেন্দ্রিক নয়। এই আন্দোলনের একটি বহুমাত্রিক দিক আছে। শিক্ষার আন্দোলন নতুন মানুষ চাষের আন্দোলন বলেই এই মানুষকে সচেতন ও সক্ষম করে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে উন্নত মানবসম্পদকে সংরক্ষিত ও বিকশিত করা সম্ভবপর। এই শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষসহ দেশ কাল ও সমাজকে আরও উন্নত করা সম্ভব হবে।
শিক্ষার প্রসার মানে কেবলমাত্র অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ তৈরি নয়। মানুষ একটি সমাজবদ্ধ জীব, সামাজিক মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা পদ্ধতির পরিচালনা ও তার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের দানাবাঁধা রূপ হলো প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান। এই প্রাকৃতিক ও সমাজবিজ্ঞানের বহুগ্রাহী সংক্ষিপ্তসার হল দর্শন। শিক্ষা ও জ্ঞান এই দুটি শব্দের আভিধানিক অর্থ যাই হোক না কেন, এ ক্ষেত্রে দুটিকে সমার্থক বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
শিক্ষার আরেকটি লক্ষ্য হওয়া উচিত নিরক্ষর ও সাক্ষর মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করা। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা, স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং সংস্কৃতি চেতনা বাড়ানোর প্রশ্নটি। প্রতিটি মানুষ তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেমন, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি ইত্যাদি।
নিরক্ষর মানুষকে যেমন লিখতে, পড়তে ও অঙ্ক কষতে শেখাতে হবে এর পাশাপাশি করে তুলতে হবে স্বাস্থ্যসচেতন, বিজ্ঞানমনস্ক। তাদের বোঝাতে হবে দৈনন্দিন স্বাস্থ্যবিধি, পুষ্টি সংক্রান্ত হাতে কলমে শিক্ষা, জলের সঠিক ব্যবহার, টিকাকরণ কর্মসূচি। এসব কোনো বক্তৃতা বা উপন্যাসের বিষয় নয়, দরকার ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োগ ও হাতে কলমে শেখা। এসবের প্রয়োগ করতে হবে পারিপার্শ্বিক ও আর্থিক সঙ্গতির মধ্যে সংহতি বজায় রেখে। স্বাক্ষর ও সচেতন মানুষকে করে তুলতে হবে যথার্থ অর্থে সক্ষম।
রোগের উপশমের জন্য দরকার চিকিৎসার। রোগ হলে চিকিৎসার প্রয়োজন। কোনো গুণীন, ঝাড়ফুঁক, ওঝা, মাদুলি, জলপড়া, তাগা তাবিজ রোগাক্রান্ত মানুষকে সুস্থ করতে পারে না, পারে না মানুষের আর্থিক বা মানসিক অবস্থার পরিবর্তন করতে। রোগ হলে যেমন দরকার চিকিৎসা, ঠিক তেমনই রোগাক্রান্ত না হবার জন্য কতকগুলি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। কোন রোগ কেন হয়, কীভাবে রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে, সে সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়ানো দরকার। রোগ প্রতিরোধ শুধু নয়, সচেতন হতে হবে রোগ প্রতিষেধক ব্যবস্থা সম্পর্কেও।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, বাড়ি ও তার আশেপাশে পানি জমতে দেওয়া উচিত নয়, চেষ্টা কর মশারি ব্যবহার করতে, রাস্তায় কাটা ফল খেও না, জল ফুটিয়ে খাও, যে কোনো খাবার খাওয়ার আগে হাত ধুয়ে নাও, যেখানে সেখানে থুতু ফেল না– এসব কাজ কোনো রোগের চিকিৎসা নয়, রোগ যাতে না হয় তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ। প্রিভেনসন ইজ বেটার দ্যান কিউর অর্থাৎ রোগ হলে চিকিৎসা নয়, রোগ না হওয়ার জন্য মানুষকে সচেতন ও সক্ষম করে তোলা।
একটা কথা এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা শব্দ দুটি সম অর্থ বহন করে না। স্বাস্থ্য আমার, আপনার সুস্থ জীবনযাপনের অধিকারকে বোঝায়। ফলে জনস্বাস্থ্য গড়ে তোলা মানে চিকিৎসক, বদ্যি, ডাক্তারখানা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল শুধু নয়। দরকার বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ে তোলা। বিজ্ঞানমনস্কতা মানে মোটা মোটা বিজ্ঞানের বই পড়া ও সূত্র মুখস্থ করা নয়।
বিজ্ঞানমনস্কতা মানে যুক্তিবাদী, অনুসন্ধিৎসু মন গড়ে তোলা। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাবলী ব্যাখ্যার চেষ্টা করা। এর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে আত্মনির্ভরতা, নিজের ওপর আস্থা, কাটবে দুর্বলচিত্ততা ও ভীরুতা। একই সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে স্বনির্ভর দল ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্পর্কে আগ্রহ।
অশিক্ষা, কুশিক্ষা বা যেন তেন শিক্ষা নয়, এমনকি গরিবের জন্য ‘উচিত শিক্ষা’ও নয়, মানসম্মত শিক্ষার জন্য দেশের নীতিনির্ধারক ও চিন্তাশীল মানুষের হৃদয়-মন একটু কাঁদুক, দ্রবীভূত হোক!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)