চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

জামায়াত বিষয়ক মূল দাবিটাই অপূর্ণ

নির্বাচন কমিশন (ইসি) জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। হাইকোর্টের রায়ের আলোকে এ প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। যে রায় এসেছিল ৫ বছর আগে। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট। হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছিল। এরপর সেই রায়ের আলোকে আগের বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জামায়াত দলীয়ভাবে অংশ নিতে পারেনি। সে হিসেবে এই জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন নতুন কোনো ঘটনা নয়, বরং বলা যায় এটা হাইকোর্টের রায়ের আলোকে ইসির হালনাগাদকরণ। যদিও এজন্যে তারা পাঁচ বছরের মত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছিল।

ইসির এই অপেক্ষা কী কারণে তা মোটামুটি পরিষ্কার, এবং হাইকোর্টের বিরুদ্ধে আপিল বিষয়ক। এরপর ইসি যখন আদালত কর্তৃক সবধরনের কাগজপত্র বা রায় হাতে পায় তখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কাগজেকলমে করল। তবে রায়ের পর পরই সেটা বাস্তবায়ন শুরু করে জামায়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ক বিধিনিষেধ আরোপে। এছাড়াও গত বছর ইসি নির্বাচন কমিশনের দলীয় প্রতীকের তালিকা থেকে জামায়াতের প্রতীক দাঁড়িপাল্লাও প্রত্যাহার করে। ফলে এই প্রজ্ঞাপন নতুন কিছু নয়, এটা ধারাবাহিকতা। কারণ এ সম্পর্কীয় কার্যক্রম চলমান ছিল ইসির পক্ষ থেকে। এবার প্রজ্ঞাপন জারিতে নথিভুক্ত হলো। ফলে প্রজ্ঞাপন কার্যকরের তারিখটা স্বভাবত থাকবে হাই কোর্টের রায়ের তারিখ থেকেই।

জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দুই রাষ্ট্রেই একাধিকবার নিষিদ্ধ হওয়া রাজনৈতিক দল। দলটি বাংলাদেশের জন্মের বিরোধীতা করতে গিয়ে রঙে হাত রাঙিয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দলীয়ভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগি হয়ে বাংলাদেশে গণহত্যা চায়। এই গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্যে দলটির শীর্ষ নেতারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অপরাধী সাব্যস্ত হয়, এবং অনেকের দণ্ড কার্যকরও হয়েছে-হচ্ছে, অনেকের মামলা বিচারিক আদালতসহ সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীনও।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতারাই কেবল দণ্ডিত হননি, জামায়াত দলীয়ভাবে এই গণহত্যার সহযোগি ছিল বলে বিভিন্ন মামলার রায়ে আদালত কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের দণ্ড এবং দলীয়ভাবে গণহত্যার অংশীদার হওয়ায় এই দলটিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠেছে। এই দাবি স্বপক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠার পরও দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়নি।

২০১৩ সালের যুদ্ধাপরাধীবিরোধী গণজাগরণ গণআন্দোলন হওয়ার সময়ে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিটি ব্যাপক জনসমর্থন পায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এই দাবি পূরণে প্রতিশ্রুতি দিলেও অদ্যাবধি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেনি। উল্টো জামায়াতের নিবন্ধনের মামলা উচ্চ আদালতে চলমান উল্লেখে দায় এড়ানোর চেষ্টা করে গেছে। ইত্যবসরে দলটি প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে দুরে থাকলেও গোপনে তাদের কর্মকাণ্ড থেমে থাকেনি। এবং ওভাবেই তারা সংগঠিত হচ্ছে বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে জানাচ্ছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। এছাড়াও জামায়াতের অনেক নেতা আওয়ামী লীগে ভিড়ে নিজেকের নিরাপদ করেছে। জামায়াতের নেতারা প্রকাশ্য রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও অনেকটা প্রকাশ্য ভাবে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য সহ বিভিন্ন সম্পর্কে জড়িত হয়ে পড়েছে। ফলে ক্ষমতায় না থাকলেও, প্রকাশ্য রাজনীতি করতে না পারলেও জামায়াত কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির কর্মীভিত্তিক রাজনীতিতে অভ্যস্ত। ওভাবেই চলে তাদের কর্মকাণ্ড। গোপনে তারা ঠিকই তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। জনভিত্তি না থাকায় তাদের জনসমর্থন বাড়ছে না ঠিক কিন্তু দলকে টিকিয়ে রাখতে পারছে তারা। এর প্রমাণও মিলেছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে, যেখানে মহানগর জামায়াতের আমিরের পক্ষে পুরো বিভাগের নেতাকর্মীরা সারামাঠ চষে বেরিয়েছে। ওই নির্বাচনে স্বতন্ত্রের মোড়কে জামায়াতের প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে জামায়াত প্রমাণ করতে পেরেছে জনসমর্থন না থাকলেও তাদের একটা সুনির্দিষ্ট কর্মী-ভিত্তি রয়েছে।

দেশের মানুষের কাছে দেশবিরোধি, আদালত কর্তৃক স্বীকৃত গণহত্যাকারী এই সংগঠনটিকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করার প্রবল দাবি থাকলেও এই গণদাবি নিয়ে সবচেয়ে বড় লুকোচুরি খেলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ ১০ বছরের শাসনামলেও সন্ত্রাসী এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করেনি তারা, এবং নিষিদ্ধ করার সম্ভাবনা আছে বলেও মনে হচ্ছে না। উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে সরকার এই দাবিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফলে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও জামায়াতের রাজনীতি যেমন থেমে নেই, তেমনি ক্রমশ বাড়ছে তাদের নিয়ে শঙ্কাও। কারণ ধর্মের নাম নিয়ে পরিচালিত এই সন্ত্রাসী সংগঠনটি ধর্মের নামেই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ক্ষেত্র প্রসারে গোপনে ডালপালা মেলছে। ফলে দেখা যায়, জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্তদের অনেকেই কোনো না কোনো সময়ে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল।

নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারির সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই জামায়াতের রাজনীতি শেষ বলে ভুল ব্যাখ্যায় যাচ্ছেন। এটা অনেকের জন্যে অতি-আবেগ কিংবা সরকারের প্রতি অতি-দরদের প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ এই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ যা কিছু তা গত পাঁচ বছর ধরে বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। গত পাঁচ বছর ধরেই জামায়াত তাদের দলের নামে নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। ইসি এই প্রজ্ঞাপন এই মুহূর্তে প্রকাশ না করলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে জামায়াত দলীয়ভাবে অংশ নিতে পারত না।

জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের এই প্রজ্ঞাপন হলেও দলটি নিষিদ্ধ হয়নি। এই নিষিদ্ধ করার বিষয়টি ইসির এখতিয়ারভুক্ত নয়, এটা সরকারের সিদ্ধান্তে হতে হবে। কিন্তু জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে সরকারের কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি, পড়ছেও না। এখানে উল্লেখ্য যে, নিবন্ধন বাতিল আর নিষিদ্ধ বিষয়টি একদিকে যেমন ভিন্ন ভিন্ন অর্থের প্রকাশ এবং অন্যদিকে প্রভাবগত দিক থেকেও দৃশ্যমান পার্থক্য রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, জামায়াতুল মোজাহেদিনসহ অনেকগুলো সংগঠনকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের নিষিদ্ধ করা মানে তাদের যেকোনো তৎপরতা-কর্মকাণ্ড আইনবিরুদ্ধ, এবং এর আইনি প্রতিবিধান রয়েছে। জামায়াতকে ওই পর্যায়ে নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত অদ্যাবধি না আসায় জামায়াত স্রেফ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক তৎপরতাকে আইনবিরুদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়নি। ফলে ২০ দলীয় জোট সহ যেখানেই জামায়াত নেতারা যাবে তাদের আটকানোর আইনি উপায় থাকছে না। কিন্তু দলটি নিষিদ্ধ হলে জেএমবি, হুজি সহ জঙ্গিনেতাদের মত যেখানেই জামায়াত নেতাদের পাওয়া যেত সেখান থেকেই গ্রেপ্তার করা সম্ভব হত, এবং সেটা আইনবিরুদ্ধ কিছুই হতো না। বরং সেটাই ছিল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নিষিদ্ধ হলে ওদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাটাই হত ভবিতব্য।

ইসিতে নিবন্ধন না থাকা মানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হওয়া নয়। এটা স্রেফ নির্বাচনে দলীয় নামে ও প্রতীকে অংশগ্রহণ করতে না পারা। এই হিসাবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না থাকায় আগের মত জামায়াত দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, যেমনটা পারবে না ইসিতে নিবন্ধন না থাকা মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, কিংবা জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন সহ দেশের মোট ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের বাইরের বাকি সকল দল। এখানে ইসির নিবন্ধন না থাকা আর নিষিদ্ধ হওয়ার পার্থক্য।

সম্প্রতি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নির্বাচন কমিশনে বৈঠক করে পাঁচ দফা দাবি উপস্থাপন করেছে। ওই পাঁচ দফার অন্যতম দাবি ছিল ‘জামায়াতের অনুসারিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা’। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে দলের সঙ্গে সকল নেতাকর্মীও নিষিদ্ধ হত, কিন্তু এখন যেহেতু দলটি নিষিদ্ধ নয় সেহেতু নির্মুল কমিটির এই দাবি কীভাবে অথবা আদৌ পূরণ হয় কীনা কে জানে। এক্ষেত্রে জামায়াত নেতাদের কেউ কোথাও স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে নির্বাচন কমিশন তাদের আটকাবে কীভাবে?

ইসির এই প্রজ্ঞাপনে নতুনত্বের কিছু নাই; তবে এই প্রজ্ঞাপনকে ঘিরে সরকার সমর্থক একটা শ্রেণি ক্রেডিট নিতে মরিয়া। অথচ এই ক্রেডিট নিয়ে টানাটানি করা দলভুক্তরা বুঝতে অক্ষম নিবন্ধন বাতিল অনেক আগেই হয়েছে এবং এই নিবন্ধন বাতিল মানে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের মত তারাও নিশ্চিত ভুলে গেছে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি গণদাবি ছিল, এবং এখনও আছে।

এছাড়া তারা এও বুঝতে অক্ষম যে নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান; এটা রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যম নয়। ইসি স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। এখন সরকার সমর্থকরা যদি ইসির এই প্রজ্ঞাপনকেও সরকারের সিদ্ধান্ত বলে সরকারকে ‘ধন্যবাদ বার্তা’ দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে তখন এর মাধ্যমে তারা নিজেরাই সরকারবিরোধিদের প্রচারণাকে সমর্থন করে গেল নির্বাচনের আগ মুহূর্তে যখন ‘ইসি স্বাধীন নয়’ বলে একটা জোর প্রচারণা চলমান।

ইসি কর্তৃক জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন আমাদের আনন্দিত করে ঠিক, কিন্তু স্রেফ এটাই আমাদের চাওয়া ছিল না। সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া ছিল জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের, কারণ বাংলাদেশে দেশবিরোধিদের রাজনীতি করার অধিকার থাকার কথা নয়, থাকার কথাও ছিল না।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)